শামস শামীম ::
টানা একমাস পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে যুদ্ধ করে কোনোরকমে গোলায় তুলেছিলেন শ্রমঘামে ফলানো বোরো ফসল; কিন্তু শতাব্দীর ভয়াবহ বন্যায় সেই ফসলের একটা বড় অংশই গোলাতেই নষ্ট হয়ে মাথায় হাত পড়েছিল হাওরের কৃষকের। চলতি মৌসুমে সুনামগঞ্জ জেলায় আমন চাষের বাম্পার ফলনে সেই ক্ষত কাটিয়ে উঠার আশা দেখছেন চাষিরা। ফসলহারা চোখে এখন তৃপ্তির ঝিলিক লক্ষ করা গেছে। বন্যার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে ধানবীজ আর সারের সহায়তা নিয়ে কৃষকের পাশে দাঁড়িয়েছিল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। ফলে এবার হাওরে আগের বছরের তুলনায় বেশি জমিতে আমনের চাষ হয়েছে। সংস্থাটি আরো জানিয়েছে, চলতি মৌসুমে উফশি, হাইব্রিড ও স্থানীয় মিলিয়ে প্রায় ৮২ হাজার ২১৫ হেক্টর জমিতে আমন আবাদ হয়েছে। গত মৌসুমের তুলনায় এবার এক হাজার ১০২ হেক্টর জমিতে বেশি আমন ধান আবাদ হয়েছে।
রোববার ও সোমবার সদর উপজেলার মোল্লাপাড়া, কোরবাননগর ও মোহনপুর ইউনিয়ন এবং তাহিরপুর উপজেলার সীমান্ত এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, হলুদ রঙে সেজেছে আমন ধানের মাঠ। মাঠে মাঠে আমন ধান কাটার উৎসব চলছে। গত বন্যায় শূন্য ভাঁড়ার ‘পূর্ণ’ হচ্ছে আমনে। কেউ মাঠে ধান কাটছেন। পাশেই খলা করে সেই ধান মেশিন দিয়ে মাড়াই করা হচ্ছে। পরক্ষণেই আবার তা বস্তায় করে বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছেন কৃষক। স্ত্রী, কন্যা ও পুত্ররাও এখন খলায় ধান গোলায় তোলতে কাজ করছেন। আমনে ভাল ফসল পাওয়ায় খুশি বলে জানান কৃষকরা। পাশাপাশি শ্রমিকরাও ধান কেটে খোরাকি সংগ্রহ করতে পেরে খুশি।
কৃষকরা জানান, গত জুন মাসে সিলেট বিভাগে শতাব্দীর ভয়াবহ বন্যা আঘাত হানে। এতে জেলার ৯০ ভাগ ঘরবাড়ি নিমজ্জিত হয়। মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে অন্য জায়গায় আশ্রয় নিলেও গোলায় পড়ে রয়েছিল বছরের ‘একমাত্র’ ফসল বোরো ধান। ধানের সঙ্গে একমাত্র গোখাদ্য খড়ও নষ্ট হয়ে গেছে।
ভাঁড়ারের ধান, বীজধান ও খোরাকির ধান পানির মধ্যে থেকে নষ্ট হয়ে যায়। তখন মাঠঘাট ও সড়ক ডুবে থাকায় ভেজা ধান শুকাতে পারেননি কৃষকরা। ফলে কালচে হয়ে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল সেই ধান। যার ফলে কৃষকের ধানের ভাঁড়ার এখন প্রায় শূন্য।
কৃষি বিভাগ জানিয়ে বন্যার ভয়াবহতার কথা অবগত হয়ে এবং কৃষকদের দুর্দশার কথা চিন্তা করে সরকার ১৬ হাজার আমন চাষিকে বীজ ও সার দেয়। ১০ হাজার ১২০ জন চাষিকে সবজি বীজ দিয়েছে। বিশেষ প্রণোদনা এবং বন্যার পলিতে জমি উর্বর হওয়ায় আমন চাষের অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়। সেই আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে। হেক্টরপ্রতি এবার চার টন ধান (চাল ২.৬৭ মেট্রিক টন) উৎপাদন হয়েছে বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ।
কৃষকরা আরো জানান, এখন আমন ধান দিয়ে আবার শূন্য ভাঁড়ার পূর্ণ করছেন তারা। তবে বিআর-২৮ ও বিআর-২৯ ধানে চিটার কারণে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা জানিয়েছেন। তবে কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, তারা মওসুমের শুরু থেকেই এই ধান না লাগাতে কৃষকদের পরামর্শ দিয়েছিলেন। কৃষকরা খড়ের জন্য এই ধান কিছু চাষ করেছেন বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
সদর উপজেলার বুড়িস্থল গ্রামের আলম হোসেন মুন্না বলেন, ‘বন্যায় এবার আমাদের অনেক ক্ষতি করেছে। এখন আমন ধানে বন্যার ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি। খোরাকির সঙ্গে কিছু বিক্রিও করতে পারব। প্রতি বছর এভাবে আমন মৌসুম পেলে কৃষকরা লাভবান হবেন। তবে প্রকৃত কৃষকদের প্রণোদনা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান তিনি।
সদর উপজেলার মোল্লাপাড়া ইউনিয়নের বাদে সাদকপুর গ্রামের কৃষক উকিল মিয়া বলেন, “এ বছর বিআর- ২৮ আর বিআর-২৯ ধান ভালো হয়নি। তবে বিআর-৩২, বিআর-২২, বিআর-২০ ধান ভালো হয়েছে। বন্যার পর পর আমরা পলি পেয়ে আমন চাষ করেছিলাম। ভালো ফলন পেয়েছি। গত বন্যায় আমাদের ভাঁড়ারের ধান ভিজে পচে নষ্ট হয়েছিল। এখন আমন ধানে সেই শূন্য ভাঁড়ার ভরার চেষ্টা করছি’।
মোহনপুর ইউনিয়নের বর্মাউত্তর গ্রামের নিজাম উদ্দিন বলেন, ‘এবার আমাদের এলাকায় আমনের ফলন ভালো হয়েছে। বিঘাপ্রতি ১৫ থেকে ১৬ মণ ধান হয়েছে। তবে ট্রাক্টরে হাল দেওয়া, সেচ, মেশিনে ধান কাটা ও মাড়াইয়ে ডিজেল ব্যবহার করায় খরচ বেশি হয়েছে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, ‘ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ব্যয় অন্য বছরের চেয়ে বেশি হয়েছে। তবে বন্যামুক্ত বাম্পার আমন ফলন পেয়ে কৃষকরা অনেক খুশি’।
তাহিরপুর উপজেলার উত্তর বড়দল ইউনিয়নের কড়ইগড়া গ্রামের মান্দি নারী শ্রমিক সরোজিনি রিছিল বলেন, ‘আমরা শ্রমিক মানুষ। এখন আমন ধান কাটছি। প্রতিদিন ৫০০ টাকা পরিমাণের ধান খোরাকি পাচ্ছি। ১৫ দিন ধান কাটতে পারলে অন্তত তিন মাসের খোরাকি তুলতে পারবো।’
সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বলেন, ‘সুনামগঞ্জ জেলা মূলত হাওর অধ্যুষিত। সব উপজেলায় আমন আবাদ হয় না। এবার আমন আবাদ বেশি হয়েছে। ফলনও বাম্পার হয়েছে। প্রায় ৬৫ ভাগ জমির ধান কাটা হয়ে গেছে। চলতি সপ্তাহে ৮০ ভাগ জমির ধান গোলায় উঠবে। আমন ও বোরো মিলিয়ে জেলায় প্রায় চার লাখ চাষি পরিবার রয়েছে।’
সুনামগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘এবারের বন্যায় আমাদের কৃষকসহ সবশ্রেণির মানুষের বহুমুখী ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু এখন বাড়ি এসে দেখি, গ্রামের পর গ্রাম জুড়ে পাকা আমন ধানের বিস্তার। ধান কাটা, মাড়াই ও শুকানোর কাজ করছেন কৃষকরা। আমনের বাম্পার ফলনে বাজারে চালের দাম কমছে। শাকসবজিতেও মাঠ ভরে আছে। আশা করছি, আগামী বছর আমাদের ভালো যাবে। তাছাড়া আসছে বোরো মৌসুমে অনাবাদী সব জমি যাতে চাষাবাদের আওতায় আনা হয় সেজন্য সরকার নির্দেশনা দিয়েছে।’