1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
শুক্রবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৮:২২ পূর্বাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

নিশ্চিহ্ন গুঙ্গিয়ারগাঁও বধ্যভূমি কেউ মনে রাখেনি শহীদদের

  • আপডেট সময় সোমবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২২

শামস শামীম
‘অধমেরে মনে রেখো, পতাকার ভাঁজে ভাঁজে / একদিন আমিও ছিলাম’।
‘বধ্যভূমির বিস্মৃতজন’ কবিতায় কবি তারিক সুজাত বাঙলার নাম না জানা বেশুমার শহীদকে লাল সবুজের পতাকার ভাঁজে ভাঁজে মনে রাখার আকুতি জানিয়েছেন। এ যেন বাংলার হারিয়ে যাওয়া সন্তানদের জন্য এক অনিঃশেষ আকুতি। কবির মনে হয়তো বাংলার কত কত নিশ্চিহ্ন বধ্যভূমির ছবি আঁকা ছিল। গত অর্ধ শতাব্দী ধরে অবহেলা, অনাদর, জাতীয় উন্নাসিকতায় পাকিস্তানি হানাদার ও এদেশীয় রাজাকারদের হাতে শহিদের স্মৃতি সহজেই মুছে গেছে। পঁচাত্তরের পট পরিবর্তন ও রাজনৈতিকভাবে ঈর্ষান্বিত হয়েও মুছে ফেলা হয়েছে কতশত প্রোজ্জ্বল স্মৃতি। ইতিহাসের নিষ্ঠুর আখ্যানের খোঁজ কখনো জানতে পারবেনা পরবর্তী প্রজন্ম। এমনই অবহেলিত একটি বধ্যভূমি সুনামগঞ্জের দুর্গম হাওর উপজেলা শাল্লার ‘গুঙ্গিয়ার গাঁও’ বধ্যভূমি। আজকের দোতলা বিশিষ্ট যে থানা ভবন সেটাসহ থানা চত্বরের আশপাশে একাত্তরে হানাদার-মিলিশিয়ারা নির্যাতন ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করেছিল। সুরক্ষিত বাঙ্কারের সঙ্গে ছিল একাধিক নির্যাতন সেলও। নারী-পুরুষসহ নিরীহ কতশত মানুষকে অমানষিক নির্যাতন করেছে তারা তার কোন ইয়ত্তা নেই। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে এনেও নির্যাতন করতো হানাদাররা। নির্যাতনে নির্যাতনে হারিয়ে গেছে কতশত সংগ্রামী মানুষ। তাদেরকে কোন মতে একই সঙ্গে মাটিচাপা দিয়ে রেখেছিল হানাদার দল। স্বাধীনতার এতকাল পরেও সেই বধ্যভূমি চিহ্নিত করা যায়নি। গড়ে তোলা যায়নি কোন স্মৃতি স্থাপনা।
শাল্লা উপজেলা সদরের হেড কোয়ার্টার হলো গুঙ্গিয়ার গাঁও। হাওরঘেরা এক নিভৃত জনপদ। একাত্তরের বর্ষায় নৌকা ছাড়া পৌঁছানোর কোন পথ ছিল না। হেমন্তে হাওরের জাঙ্গাল ধরে যেতে হয়। এখনো সরাসরি সড়ক যোগাযোগ নেই। বর্ষায় নাওয়ে আর হেমন্তে পাওয়ে হেঁটে যেতে হয় গুঙ্গিয়ার গাঁও। এই এলাকায় স্বাধীনতার আগে অন্তত ৮০ ভাগের বেশি হিন্দু সম্প্রদায়ের বসবাস ছিল। এখন অর্ধেকেরও নিচে নেমে এসেছে। স্বাধীনতাবিরোধীদের ভয়ে চিরতরে জীবন নিয়ে দেশান্তরী হয়েছেন কতো মুক্তিযোদ্ধা। এখনো স্বাধীনতাবিরোধীদের ভয়ে পরিচয় গোপন করে দেশান্তরী জীবনযাপন করছেন সুকুমার দাস নামের এক যুদ্ধজয়ী বীর। তিনি টেকেরঘাট সাব সেক্টরের দুর্ধর্ষ যোদ্ধা ও কম্পানি কমান্ডার ছিলেন। শহিদ মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি-সুকুমার দাস-সালেহ চৌধুরী হানাদারদের এই দুর্গ ভেঙে দিতে একাধিকবার আক্রমণ করেছিলেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা ও প্রবীণরা জানান, গুঙ্গিয়ার গাঁও থানা ভবন ছিল হানাদার বাহিনীর শক্তিশালী একটি ক্যাম্প। আজমিরিগঞ্জ ও গুঙ্গিয়ার গাঁওয়ে অবস্থানরত হানাদার মিলিশিয়ারা নাশকতা চালাতো এলাকায়। লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ ও হত্যার মাধ্যমে প্রতিশোধের জিঘাংসা মিটাতো। গুঙ্গিয়ার গাঁওয়ের মতো শান্ত হাওরঘেরা দ্বীপপল্লীটি হানাদারদের সীমাহীন অত্যাচারে রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল। এখানকার সবাই হিন্দু সম্প্রদায়ের হওয়ায় হানাদারদের আক্রোশটাও ছিল বেশি। তাই গুঙ্গিয়ারগাঁওসহ আশপাশের অনেককেই হত্যা করে বর্তমান থানা ভবনের (দোতলা) নিচে গর্ত চাপা দিয়ে রাখতো। ৬ ডিসেম্বর সুনামগঞ্জ মুক্তদিবসের পর যখন যুদ্ধজয়ী বীরের গুঙ্গিয়ারগাঁও প্রবেশ করেন তখন তারা থানা ভবনের আশপাশে অনেক নিরীহ মানুষের হাড়গোড় দেখতে পান। মাটি ফুড়ে বেরিয়ে পড়া হাড়গোড় আবারও গর্তে চাপা দিয়ে রাখা হয়। এ ঘটনা প্রত্যক্ষ করে স্বাধীনতার পরে যারা থানায় কর্মরত ছিলেন রাতে ভয়ে অবস্থান করতেন না। রাতে শহিদদের আত্মা ঘুরে বেড়াতো বা কান্না করতো এমন ভয়ে কেউ এসব স্থাপনায় রাত্রিযাপন করতেন না। এক অজানা ভীতি কাজ করতো মন ও মননে। তাই বর্তমান (দোতলা থানা ভবন ও আশপাশের স্থাপনায়) কেউ ঘুমাতো না ভয়ে। অনেক দিন পর্যন্ত এই ভীতি ছিল।
১৯৭২ সনে পরাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ, জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশনার প্রিন্স সদর উদ্দিন আগা খান, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মোস্তফা চৌধুরীসহ অনেকে গুঙ্গিয়ার গাঁও থানার বধ্যভূমিতে শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি দিয়েছিলেন। তখন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতার পক্ষের লোকজন বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও সৌধ নির্মাণের দাবি জানিয়েছিলেন। স্বাধীনতার পরে ভঙ্গুর স্বদেশ নির্মাণে মনোযোগী ছিলেন সবাই। তাই বিস্মৃত হয়ে যায় বধ্যভূমি সংরক্ষণের বিষয়টি। এর মধ্যেই ১৯৭৫ সনে ঘটে ইতিহাসের নিষ্ঠুর ও হৃদয় বিদারক ঘটনা। জাতির জনক ও তার পরিবারকে হত্যা করে মুক্তিযুদ্ধের কক্ষপথ থেকে দেশকে ঘুরিয়ে ফেলা হয়। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও ইতিহাস মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র শুরু হয়। খোলস পাল্টে বেরিয়ে আসে স্বাধীনতাবিরোধীরা। যার ফলে দেশের অন্যান্য বধ্যভূমির মতো নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় গুঙ্গিয়ারগাঁও বধ্যভূমির চিহ্ন। এখন আর কেউ জানেনা বধ্যভূমির কথা। এই অঞ্চলের নতুন প্রজন্মও এ বিষয়ে জানেনা কিছুই।
সুখলাইন গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা জগদীশ চন্দ্র সরকার ছিলেন ৪ নম্বর সেক্টরের মোক্তারপুর সাব সেক্টরের বীর যোদ্ধা। তিনি জানালেন বিজয়ের পর তিনি বাড়িতে এসে গুঙ্গিয়ারগাঁও থানা এলাকা ও ডুমড়া আখড়া এলাকার তা-বের চিহ্ন প্রত্যক্ষ করেন। থানা ভবনের টর্চারসেলের আশপাশে অসংখ্য হাড়গোড় দেখতে পান তারা। স্থানীয়দের নিয়ে সেই হাড়গোড় মাটিচাপা দেওয়া হয়। ১৯৭২ সনে আব্দুস সামাদ আজাদসহ জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশনার প্রিন্স সদর উদ্দিন আগা খান এলে বধ্যভূমি সংরক্ষণের দাবি জানানো হয়েছিল। স্বাধীনতার পরে এখান থানার আবাসিক ও অনাবাসিক স্থাপনা করার পর ভয়ে কেউ অবস্থান করতে চাইতোনা বলে জানান তিনি। রাতে দুঃস্বপ্ন দেখতো। যারা প্রবীণ ও স্থানীয় তারা এসব বিষয় এখনো জানেন। কিন্তু এখন বধ্যভূমির বিষয়ে নতুন প্রজন্মের কেউ জানেনা।
বধ্যভূমির পার্শ্ববর্তী বাহাড়া গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা শিবধন দাস। তিনি ৪ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করলেও যুদ্ধের পরে ফিরে আসেন বাড়িতে। তখনো যুদ্ধের ক্ষত স্পষ্ট ছিল। থানা ভবনের আশপাশে পাকিস্তানি হানাদার-মিলিশিয়া-রাজাকারদের নাশকতার চিহ্ন ছিল। তিনি জানালেন, গুঙ্গিয়ারগাঁও থানা ভবন ছিল হানাদারদের ক্যাম্প। পুরো থানা ভবন এলাকাই ছিল নির্যাতন সেল। বহু নিরপরাধ মানুষকে খুন করে মাটিচাপা দিয়ে রাখা হয়েছে এখানে। কতশত মানুষ এখানে এসে চিরতরে হারিয়ে গেছে। এই বধ্যভূমি রক্ষা করতে না পারা ও কোন সৌধ তৈরি করতে না পারার ব্যর্থতার জন্য দায়ি আমরাও।
বাহাড়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বিশ্বজিৎ চৌধুরী নান্টু জানালেন, তার বাবা ও প্রবীণরা জানিয়েছেন একাত্তরের গুঙ্গিয়ারগাঁও থানা এলাকা শ্মশানে পরিণত হয়েছিল। স্বাধীনতার পর পর ভয়ে এখানে কেউ ঘুমাতোনা। রাতে দূর থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসতো। এতে ভয় পেয়ে থানায় কর্মরত অনেকে ঘুমাতে পারতোনা। একাত্তরের তরতাজা স্মৃতি বিস্মৃত হয়ে গেছে। নতুন প্রজন্ম জানেনা এই বধ্যভূমির কথা।
এই বধ্যভূমি বিষয়ে প্রশ্ন করেছিলাম শাল্লা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আবু তালেবকে। তিনিও কিছু জানেননা। তবে সম্প্রতি বীর মুক্তিযোদ্ধাদেরকে একাত্তরের স্মৃতি, বধ্যভূমি, গণহত্যা ও যুদ্ধক্ষেত্র এবং প্রতিরোধ যুদ্ধ নিয়ে লেখার অনুরোধ করেছেন। তাদের কাছ থেকে কাক্সিক্ষত সাড়া মিলছেনা বলে জানালেন তিনি।
বীর মুক্তিযোদ্ধারা জানান, শুধু গুঙ্গিয়ারগাঁওই নয় এই উপজেলার দৌলতপুর ও দিরাই উপজেলার শ্যামারচর বধ্যভূমির স্মৃতিও নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ২০১৩ সনে গণজাগরণের ঢেউয়ে মুক্তিযোদ্ধা জনতা এই বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণের দাবি জানালে সচেতনভাবে স্বাধীনতাবিরোধীদের স্বজনরা মামলা করে বসে। এখন তারা এখানে ব্যক্তিগত স্থাপনা করে নিয়েছে।
সচেতনভাবে এভাবে সারাদেশে অসংখ্য বধ্যভূমির স্মৃতি মুছে ফেলা হয়েছে। সরকারিভাবে আজো বধ্যভূমির সংখ্যা নিরূপণ করা যায়নি। ‘ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি’ তাদের এক পরিসংখ্যানে দেশে ৯৪২টি বধ্যভূমির কথা উল্লেখ করেছে। অন্য সূত্র বলেছে, দেশে এ পর্যন্ত হাজারখানেক বধ্যভূমি শনাক্ত করা হয়েছে। এক যুগ আগে হাইকোর্ট বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণের পক্ষে রায় দিয়েছিল। বিভিন্ন সময়ে বধ্যভূমি সংরক্ষণে বড় প্রকল্প নেওয়া হলেও তা বাস্তবায়িত হচ্ছেনা। তাই গুঙ্গিয়ারগাঁও নিশ্চিহ্ন বধ্যভূমির মতো অসংখ্য বধ্যভূমি দেখে এখন আর বুঝার উপায় নেই এখানে খান জল্লাদ ও দোসররা নীরিহ বাঙালিদের রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়েছিল।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com