স্টাফ রিপোর্টার ::
নিজের ক্রয়কৃত জমির ভাগ না দেয়ায় গ্রাম্য মাতব্বরদের নানা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন ৯টি পরিবারের লোকজন। ষড়যন্ত্রের কৌশল হিসাবে সালিশ ডেকে তাদের করা হয়েছে সমাজচ্যুত। সমাজচ্যুত পরিবারের সাথে তাদের আত্মীয়-স্বজন সম্পর্ক রাখতে পারবেন না। পঞ্চায়েতের এমন সিদ্ধান্ত না মানলে সামাজিক দ- পেতে হবে। এছাড়া প্রভাবশালীদের একাধিকবার প্রাণনাশের হুমকিতে ভয়ে গ্রামছাড়া হয়েছেন নির্যাতিতরা। ‘সমাজচ্যুতি’র এক বছরেও বিচার পাননি কেউ। ঘটনাটি জামালগঞ্জ উপজেলার সাচনা বাজার ইউনিয়নের চানপুর গ্রামের।
গত রবিবার (২৭ নভেম্বর) সকালে সরেজমিনে গিয়ে জানাযায়, এক বছর আগে চানপুর গ্রামের দক্ষিণপাড়া নিবাসী ভরত চন্দ্র তালুকদারের নামে পশ্চিম চানপুর মৌজার ৪৯ নং জেএল সংক্রান্ত ১৮৪ খতিয়ানের ৮২ নং দাগের ১ একর ২ শতক জমি, একই খতিয়ানের ৩৫৯ নং দাগের ২ একর জমি, ৩৮১ নং দাগের ৭ একর ৫৩ শতক সহ মোট ১০ একর জমি রয়েছে। এই জমি তিনি অন্যের কাছ থেকে কিনে নিয়েছেন। জমি কিনতে গ্রামের মাতব্বরদের আপত্তি ছিল। জমি কেনার পর মাতব্বরদের দাবির প্রেক্ষিতে একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য গ্রামবাসীকে কিছু জমি দান করেন ভরত চন্দ্র তালুকদার। জমি দানের পরও মাতব্বরদের দাবি পূরণ হয়নি। শুরু হয় ভরত চন্দ্র তালুকদার ও তার স্বজনদের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র। একে একে ৯ পরিবারকে করা হয় সমাজচ্যুত।
রবিবার সকালে চানপুর গ্রামে গিয়ে সমাজচ্যুত ৯ পরিবারের ১১টি ঘর তালাবদ্ধ পাওয়া যায়। তারা কোথায় আছেন, কোনো ঘটনা ঘটেছে কি না, এমন নানা প্রশ্নের উত্তর দিতে পাশের বাড়ির বাসিন্দা আরতি বিশ্বাস, বাসন্তী সরকার, শিখা তালুকদারসহ অনেকে মুখ খুলতে নারাজ। আরও বেশ কয়েকজনের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেও কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি। তারা কৌশলে বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন।
ওইদিন দুপুর ১টায় পার্শ্ববর্তী শালমারা গ্রামে এসে পাওয়া যায় সমাজচ্যুত হওয়া আশু তালুকদার ও রাম চন্দ্র তালুকদারকে। তারা জানান, সমাজচ্যুত হওয়ার পর থেকে প্রাণনাশের ভয়ে অবস্থান নিয়েছেন শালমারা গ্রামে। ঘর-বাড়ির সব মালামাল লুটে নিয়েছে মাতব্বরেরা। গত কয়েকদিন আগে ভাই ভরত চন্দ্র তালুকদারকে রাতের বেলায় শালমারা গ্রামের রাস্তায় একা পেয়ে মারধর করেছে তারা। পরে তাকে শালমারা গ্রামের মানুষ উদ্ধার করে সদর হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দেন। বর্তমানে তাদের পরিবারের স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের লেখাপড়াও বন্ধ রয়েছে।
একই কথা বলেন শালমারা গ্রামের অজিত দে। শালমারা গ্রামে অবস্থান নেয়া সুনিত্রা রানী তালুকদার ও অপরজন বাসন্তী তালুকদার। তারাও মারধরের হুমকি দেয়ায় চলে এসেছেন চানপুর গ্রাম ছেড়ে।
বেলা ২টায় নিয়ামতপুর গ্রামে এসে পাওয়া যায় আরও দুইজন মহিলাকে। একজন ভরত চন্দ্র তালুকদারের স্ত্রী মিতালী রানী তালুকদার। অপরজন রামচন্দ্র তালুকদারের স্ত্রী শেফালী তালুকদার। তারা জানান, সমাজচ্যুত করার পর তাদেরকে প্রাণে মারার উদ্দেশ্যে মাতব্বরের লোকেরা খোঁজাখুঁজি করে। তাদের ভয়ে তারা গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে এসেছেন সন্তানদের নিয়ে।
নির্যাতিতরা জানান, এক বছর আগে গ্রাম্য সালিশ ডেকে সুকৌশলে ভরত চন্দ্র তালুকদারকে আরও বেশি জমি দেয়ার জন্য প্রস্তাব দেয়া হয়। এই প্রস্তাবে ভরত চন্দ্র তালুকদার জমি দিতে রাজি হননি। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন চানপুর গ্রামের মাতব্বর পা-ব সরকার, চিতু বিশ্বাস, কৃষ্ণ বিশ্বাস, গুরুদাস তালুকদার, নিরঞ্জন সরকার, নিশি সরকার, সুজন হালদার, সুনীল বিশ্বাস, অখিল বিশ্বাস, কাঞ্চন বিশ্বাস ও বিমল বিশ্বাস। সালিশে সিদ্ধান্ত নিয়ে ভরত চন্দ্র তালুকদারকে সমাজচ্যুত করা হয়। বন্ধ হয়ে যায় তাদের জন্য গ্রামের রাস্তা-ঘাটে চলাফেরা। এমনকি যেখানে সেখানে পাওয়া মাত্র মারপিট করার সিদ্ধান্ত দেন মাতব্বরেরা। এমন কঠিন সিদ্ধান্ত ভরত চন্দ্র তালুকদারের স্বজনেরা মেনে নিতে পারেন নি। তাই সমাজচ্যুত করার পরও তার জীবন-জীবিকা নির্বাহে সাহায্য করে আসছিলেন স্বজনেরা। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে তখন মাতব্বররা একে একে ৯টি পরিবারকে সমাজচ্যুত করে।
নির্যাতিতদের অভিযোগ, ৯টি পরিবারকে সমাজচ্যুতির পর শুরু হয় কৌশলে সম্পদ দখলের নানা ষড়যন্ত্র। বাড়ি ঘরে ‘বন্দি’ থাকা লোকজনকে নানাভাবে ভয়ভীতি দেখানো এবং প্রাণনাশের হুমকি দেয়া হয়। এক পর্যায়ে ২-৩ জনকে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে মারধর করা হয়। নানা ষড়যন্ত্র ও হয়রানির শিকার হয়ে গ্রামছাড়া হয়ে পড়েন ৯টি পরিবার। এদের মধ্যে ভরত চন্দ্র তালুকদার, রাম চন্দ্র তালুকদার, লক্ষণ চন্দ্র তালুকদার, জয় চরণ তালুকদার, জয় চান তালুকদার, আশু তালুকদার, হরেকৃষ্ণ তালুকদার, পলিন্দ্র তালুকদার, বিরেন্দ্র তালুকদার। তারা পেশায় কেউ কৃষক, কেউ দিনমজুর, আবার কেউ চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করেন।
প্রাণনাশের হুমকির পর বাড়ি-ঘর ছেড়ে কেউ জামালগঞ্জে আবার কেউ কেউ বিশ্বম্ভরপুরে আশ্রয় নিয়েছেন। এই সুযোগে তাদের গৃহপালিত পাতিহাঁস, রাজহাঁস এবং ঘরের মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে নিয়েছে প্রভাবশালীদের লোকজন। সমাজচ্যুত পলিন্দ্র তালুকদারকে দেয়া সরকারি ঘরের কাজও বন্ধ রাখা হয়েছে। এমন নির্যাতনের শিকার হয়ে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারের শরণাপন্ন হলেও বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়নি। এমনকি জামালগঞ্জ থানায়ও ভরত চন্দ্র তালুকদারের অভিযোগ রাখা হয়নি।
গত কয়েকদিন আগে রাতের বেলায় শালমারা গ্রামের পাশে রাস্তায় একা পেয়ে ভরত চন্দ্র তালুকদারকে বেধড়ক মারপিট করে মাতব্বরেরা। শালমারা গ্রামের মানুষ তাকে উদ্ধার করে সদর হাসপাতালে ভর্তি করেন। একের পর এক এমন ঘটনায় আতঙ্কে রয়েছেন ৯টি পরিবারের লোকজন।
চানপুর গ্রাম পার্শ্ববর্তী শালমারা গ্রামের একাধিক ব্যক্তি জানান, চানপুরের সমাজচ্যুতদের বাড়ি-ঘর পাহারা দেয়ার জন্য কয়েকদিন ধরে কামলাবাজ গ্রামের মো. আবুল মিয়া ও মো. আরিফ মিয়াকে এনে রাখা হয়েছে। তারপরও প্রতিনিয়ত সম্পদের ক্ষতি করে চলেছে মাতব্বরের লোকেরা।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চানপুর গ্রামের ‘মাতব্বর’দের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) রিপন কুমার মোদক বলেন, সমাজচ্যুত হওয়ার বিষয়টি আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। কোনো অভিযোগও আমি পাইনি। অভিযোগ পেলে দ্রুত ব্যবস্থা নেবো। তিনি বলেন, জামালগঞ্জ থানার ওসি জানিয়েছেন, অভিযোগ দেয়া হয়েছিল, পুলিশ ঘটনাস্থলও পরিদর্শন করেছে। ওসি ১ ডিসেম্বর ছুটি কাটিয়ে আসলে বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখা হবে।