ফাহমিদা ইয়াসমিন ::
সাদা কাশফুল, শিউলি, ¯িœগ্ধ জ্যোৎ¯œা, আলোছায়ার খেলা দিনভর- এমনতর সাজের পোশাক যে ঋতুর দেহে সেই তো শরৎ। তাকেই তো বলা হয় ঋতুর রাণী। ভাদ্র ও আশ্বিন এই দুই মাসকে বাংলা পঞ্জিকায় শরৎ বলা হয়। এজন্য ভাদ্রের আগমনের সাথে সাথে শরতের আবির্ভাব। ভাদ্র মাসের প্রথম থেকেই শরতের ¯িœগ্ধতা চোখে পড়ে। যা বলতে গেলে অসাধারণ! শরতের আগমন সত্যিই মধুর।
বর্ষার অবসান ধরা হলেও থেকে থেকে বৃষ্টি, এখনই রোদ তো এখনই সাদা মেঘের ডাকাডাকি। এই কারণেই এমন মধুর মাসে কবি-সাহিত্যিকরাও রোমান্টিক হয়েছেন। বিদ্যাপতি শরতের রূপে মুগ্ধ হয়ে তার আকুতি জানিয়েছেন কবিতায়। তিনি শরতে প্রেমিকার মিলনে নিজেকে সপে দিতে চেয়েছেন। তাই বলেছেন-“এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর।
এ ভরা বাদর মাহ ভাদর
শূন্য মন্দির মোর।”
শরতের আকাশে সাদা মেঘের ভেলা। সেই সাদা সাদা মেঘের গুচ্ছ যে কোনো সৃজনশীল মানুষতো বটে সাধারণ মানুষকেও বিস্মিত করে। বাংলাদেশের প্রকৃতির এই নব নব সাজ আকাশও ধারণ করে। আকাশে-বাতাসে নতুন নতুন রূপ। তাই হয়তো কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন-
“এসো শারদ প্রাতের পথিক এসো শিউলি বিছানো পথে
এসো ধুইয়া চরণ শিশিরে এসো অরুণ-কিরণ রথে।
দলি শাপলা শালুক শত দল এসো রাঙায়ে তোমার পদতল
নীল লাল ঝরায়ে ঢলঢল এসো অরণ্য পর্বতের।”
শরতের রূপে মুগ্ধ হয়নি এমন কবি খুঁজে পাওয়া কঠিন। বৈঞ্চব কবি কালিদাস থেকে শুরু করে আধুনিক কবিগণও শরতের রূপ দেখে মুগ্ধ হয়েছেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুক তাই হয়তো বলেছেন-
“শিউলির ডালে কুঁড়ি ভ’রে এল,
টগর ফুটিল মেলা,
মালতীলতায় খোঁজ নিয়ে যায়
মৌমাছি দুই বেলা।
গগনে গগনে বরষন-শেষে
মেঘেরা পেয়েছে ছাড়া
বাতাসে বাতাসে ফেরে ভেসে ভেসে,
নাই কোনো কাজে তাড়া।”
বাংলাদেশে ছয়টি ঋতু। তবে ছয়টি ঋতুর ভিন্ন রূপের সমাহার। তবু শরৎ ঘিরেই প্রকৃতির নানান আয়োজন। যে আয়োজন সাধারণের চোখও এড়ায় না। একারণেই শরৎকে বলা হয় শুভ্রতার প্রতীক! নদীর দুই পাড়ে সাদা কাশফুলের অপরূপ সৌন্দর্য পুলকিত করে মানুষকে। হালকা বাতাসে সেই কাশফুলে যখন ঢেউ খেলে তখন অপরূপ সৌন্দর্যের সৃষ্টি হয়। বর্ষা শেষে শরত আসে বলে সকল গাছে সবুজের রং মাখা থাকে। খালবিলে শাপলার খেলা করে। বাংলা আকাশে পরিযায়ী পাখির আগমন। প্রকৃতির এ অপরূপ যেন প্রিয় মানুষের সান্নিধ্য চায়। এমন দিনে কাশফুলের বনে ইচ্ছা হয় হারিয়ে যেতে প্রিয়জনের হাতটি ধরে।
শরতে রূপে মুগ্ধ হয়েছেন কবি জসীমউদ্দীন। গ্রামীণ পটভূমিকায় তিনি মানুষ ও প্রকৃতিকে কবিতায় জীবন্ত করেছেন বলে তাকে পল্লীকবিও বলা হয়। পল্পীকবি কতোটা প্রকৃতিকে আপন চোখে দেখতে পেরেছেন তা নিয়ে কোনো সংশয় নেই। কেননা তার মতো করে বাংলা সাহিত্যে প্রকৃতিকে আপন করে কেউ দেখতে পারেনি। কেউ বুকে আগলে রাখেনি। তার কবিতা মানেই তো প্রকৃতি অপার সৌন্দর্যের মাঠ। তিনিও শরতের রূপে মুগ্ধ হয়ে লিখেছেন-
“গুনিতে গুনিতে শ্রাবণ কাটিল, আসিল ভাদ্র মাস,
বিরহী নারীর নয়নের জলে ভিজিল বুকের বাস।
আজকে আসিবে কালকে আসিবে, হায় নিদারুণ আশা,
ভোরের পাখির মতোন শুধুই ভোরে ছেঁয়ে যায় বাসা।”
শরতের সকালে শিশিরের ফোটায় ঘাসের ডগা যে নতুন রূপ পায়। তার বর্ণনা দেয়ার ভাসা নেই। ধানের ক্ষেতে সবুজের যে হাতছানি তা শুধু গ্রামীণ জীবন যাপনে অভ্যস্তরাই জানে। কবি আল মাহমুদ বলেছেন-
“ঋতুর অতীত আমি। কে জিজ্ঞাসে এটা কোন মাস?
বাতাসে গড়িয়ে পড়ে বিদায়ের বিষণœ নির্যাস।
শ্রাবণেরও শক্তি নেই। কিন্তু ভাবি কোলাহল আছে
প্রতিটা বাড়ির রন্ধ্রে, ইটে ইটে আনাচে- কানাচে!
এটা কি শরৎ সন্ধ্যা? বাংলাদেশ?
কাঁশফুল ছেয়ে গেছে চর?
শরৎ বাংলার রূপবতী এক ঋতু। এক কথায়, সৌন্দর্যের পুরোধা। এই ঋতুর নিজস্ব একটা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তাই শরতের শরতের বন্দনা বাঙালির উৎসবে পরিণত হয়েছে। শিউলি ঝরার আনন্দ, কাশ ফুলের দুলুনি, মেঘ মুক্ত আকাশে নীলের সমারোহ প্রকৃতির নতুন রূপ দেয়। শরৎ নিয়ে শিল্প সাহিত্যের মতো প্রকৃতির নানান উৎসবমূখর পোশাকের নকশা হৃদয় কাড়ে।