বিশেষ প্রতিনিধি ::
আজ বৃহস্পতিবার (১০ নভেম্বর) হাওরভাটির বিপ্লবী ও দেশখ্যাত বাম কিংবদন্তি রাজনীতিবিদ কমরেড প্রসূন কান্তি বরুণ রায়ের শততম জন্মবার্ষিকী। কমরেড বরুণ রায় ১৯২২ সালের ১০ নভেম্বর জামালগঞ্জ উপজেলার বেহেলী গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। জমিদার পরিবারে জন্ম নিলেও তিনি আজীবন মেহনতি মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি ও তাদের ন্যায্য অধিকারের দাবিতে লড়াই করে গেছেন।
সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক আন্দোলনের কিংবদন্তি পুরুষ কমরেড প্রসূন কান্তি বরুণ রায়। তেভাগা আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, ভাসানপানি আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধসহ কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি জনতার মুক্তির সংগ্রামের প্রতিটি আন্দোলনে তিনি সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন। বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামের কারণে তাঁকে অনেক সময় কারাবরণ করতে হয়েছে। শুধু পাকিস্তান আমলেই তিনি ১৪ বছর জেলে কাটিয়েছেন।
বরুণ রায়ের পিতার নাম করুণাসিন্ধু রায়। সামন্ত পরিবারে জন্ম নিলেও তিনি বেছে নিয়েছিলেন কৃষক প্রজার পক্ষের রাজনীতি। তিনি আসাম প্রাদেশিক পরিষদের এমএলএ ছিলেন। মহান মুক্তিযদ্ধের সংগঠক, বাংলাদেশ বাম রাজনীতির প্রবাদপ্রতিম পুরুষ বরুণ রায় ছাত্রাবস্থা থেকেই পিতার রাজনৈতিক আদর্শে প্রলুব্ধ হয়ে লাল পতাকার ঝা-া হাতে তোলে নেন। মানুষের কাতারে থেকে মানুষের পক্ষে কথা বলায় একাধিকবার পাকিস্তান সরকারের রোষানলে পড়ে বিভিন্ন সময়ে ১৪ বছর জেল খাটেন। সেময় তার পিতার নামে ভাটি বাংলার অলিতে গলিতে “কৃষক বন্ধু করুণা সিন্ধু, পাড় হয়ে যায় মহা সিন্ধু” স্লোগান তার শিশুমনে তোলপাড় তোলে। তার পিতা তৎকালীন আসাম পার্লামেন্টে প্রথম শ্রীহট্ট প্রজাস্বত্ব আইন উত্থাপনকারী ব্যক্তি। ১৯৩২ সালে অসহযোগ আন্দোলনে এই অঞ্চলের নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে তার পিতা করুণা সিন্ধুকে পুলিশ গ্রেফতার করে জেলে নিয়ে যায়। কিশোর বয়সে তিনি তাঁর পিতার কাছ থেকেই রাজনৈতিক দীক্ষা লাভ করেন বরুণ রায়।
প্রথম জীবনে বরুণ বায় ছাত্র ফেডারেশনের একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে কমিউনিস্ট পার্টির সং¯পর্শে আসেন। ১৯৪২ সালে মাত্র ২০ বছর বয়সে পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। এই সময় স্বাধীনতা দিবস পালনের ‘অপরাধে’ প্রথম বারের মতো জেলে যান তিনি। ১৯৫০ সালে কমিউনিস্ট পার্টির জেলা প্রতিনিধি নির্বাচিত হন। ১৯৪৮ সালে সিলেট গোবিন্দচরণ পার্কে বাংলা ভাষার সপক্ষে সভা করতে গিয়ে পাকিস্তানীদের রোষানলে পড়েন। ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের পরপরই পাকিস্তান সরকার তাঁকে গ্রেফতার করে ৫ বছর কারান্তরীণ করে রাখে। জেলে থাকাবস্থায় তিনি কমরেড মনি সিংহ, রবি ধামসহ বিখ্যাত বাম রাজনীতিবিদদের সংস্পর্শে আসেন। ১৯৫৩ সালে মুক্তি পেয়ে নিজ গ্রাম বেহেলীতে ফিরে গিয়ে কৃষকদের অধিকার আদায়ে জোতদার-সমান্তবাদীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। সে সময় একটি পৃথক নির্বাচনী বিধিমালার আওতায় সুনামগঞ্জের সাধারণ হিন্দু নির্বাচনী এলাকায় তাকে প্রার্থী করা হলে মনোয়ন প্রাপ্তির কয়েকদিন পর আবারও কারাবন্দী হন। জেলে থেকেই নির্বাচন করে এই গণমানুষের নেতা বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করেন। সারাদেশে ৯২ (ক) ধারা জারি করা হলে ১৯৫৪ সালে আবার গ্রেফতার করে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত তিনি টানা পাঁচ বছর কারাভোগ করেন। আত্মগোপনে থাকাবস্থায় বরুণ রায় ১৯৬৬ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সিলেট জেলা শাখার সাধারণ স¤পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৮-১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের পর তিনি প্রকাশ্য রাজনৈতিক তৎপরতা সীমিত করে আত্মগোপনে থেকে সাংগঠনিক কাজ চালিয়ে যান। আত্মগোপন থাকাকালে ১৯৬৮ সালে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। একই সঙ্গে তিনি কেন্দ্রীয় কৃষক সমিতির সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৫ সালে আয়ূব খান সরকার তার উপর হুলিয়া জারি করে। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে দিরাই শাল্লা এলাকায় আত্মগোপন থেকে সুরঞ্জিত সেনের পক্ষে কুঁড়েঘর মার্কার পক্ষে কাজ করেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হলে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের কাজ করেন। ১৯৮৬ সালে তিনি সংসদ নির্বাচিত হন। ১৯৮৭ সালে সরকার বিরোধী আন্দোলনের জন্য তিনি কারাবরণ করেন।
১৯৩৭ সালে প্রজাদের জোতস্বত্ব প্রতিষ্ঠা, নানকার বিদ্রোহ, খাজনার ভিত্তিতে প্রজাদের জোত স্থায়ীকরণসহ সাধারণ মানুষের জীবনঘনিষ্ঠ অনেক আন্দোলন সংগ্রাম তিনি খুব কাছে থেকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। সা¤্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ, বুর্জোয়া, পেটি বুর্জোয়া, সাম্প্রদায়িকতা, মহাজনি প্রথা, নিজে জমিদার হয়েও জমিদারদের অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্বে সংগ্রাম করেন।
১৯৮০ সালে জেনারেল জিয়াউর রহমানের আমলে তাঁকে আবার গ্রেফতার করা হয়। ১৯৮৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (১৫ দলের প্রার্থী হিসাবে) কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী হিসাবে তিনি সুনামগঞ্জ-১ আসন থেকে জয়লাভ করেন। ১৯৮৭ সালে এরশাদবিরোধী আন্দোলন চলাকালে তাঁকে আবার গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হয়। তিনি ১৯৯০ সালে বার্ধক্যের কারণে সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর নেন। শেষ বয়সে তিনি মণি সিংহ-ফরহাদ স্মৃতি ট্রাস্টের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর কমরেড বরুণ রায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর স্ত্রী শীলা রায় নারীনেত্রী এবং একমাত্র ছেলে সাগর রায় বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী।
কমরেড বরুণ রায় অল্পতুষ্টের এক নির্লোভ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। এদেশের মাটি, মানুষ জলহাওয়া ও প্রকৃতির প্রতি তাঁর ছিল অসম্ভব মমতা। তাঁর চেতনা এবং আদর্শকে নতুন প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে। শত জন্মদিনে এই মহান বিপ্লবীকে লাল সালাম।