সুখেন্দু সেন ::
শৈশব কৈশোরে দুরন্ত ডানপিটে, তারুণ্যে, যৌবনে স্বপ্নবাজ, তুখোড় আড্ডাবাজ, হাড় লিকলিকে তরুণটির স্কুল জীবনেই ছাত্ররাজনীতিতে হাতেখড়ি। গলাটা ভরাট ছিলো। চুঙ্গা ফুকাতো ভরাট গলায়। মাইকিংয়ে জুড়ি মেলা ভার। কলেজ জীবনে শুরু হয় সক্রিয় রাজনীতি। মিছিলে, মিটিংয়ে, স্লোগানে, জোরালো কণ্ঠস্বরে কমনরুম, পুকুর পাড়, ময়নার পয়েন্ট, পুরান কলেজ মাতিয়ে রাখতো। দুরন্তপনা সহজে সঙ্গ ছাড়েনি। কলেজ কর্তৃপক্ষও অতিষ্ঠ। বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে কলেজ কর্তৃপক্ষের সাথে একবার বিবাদে জড়িয়ে পড়লে প্রতিবাদী ছাত্রটি কলেজ থেকে সাময়িক বহিষ্কারও হয়। সে কালটা পাকিস্তান। জেনারেল ইয়াহিয়ার মার্শাল ল’র কঠোর সময় আর ডানপিটে ছাত্রটি মতিউর রহমান।
যৌবন ছুঁই ছুঁই উড়ন্ত সময়ে দেশমাতৃকার মুক্তির আহ্বান সেই দুরন্ত স্বপ্নবাজ এবং রাজনীতি সচেতন মানুষটিকে টেনে নেয় যুদ্ধের ময়দানে। ইকো ওয়ানে প্রথম ব্যাচে ট্রেনিং নিয়ে সরাসরি সশস্ত্র যুদ্ধে। বাঙালির হাজার বছরের গৌরবের অর্জন সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতার রক্তরাঙা সূর্যটা ছিনিয়ে আনতে যে দুরন্ত, ডানপিটেরা জীবন বাজি রেখেছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান তাঁদেরই একজন। সঙ্গীসাথি অনেকেই শহীদ হয়েছিলেন। তেমনি ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ স¤পাদক তালেব আহমদ শহীদ হলে যুদ্ধশেষে মহকুমা ছাত্রলীগের সাধারণ স¤পাদকের দায়িত্ব নেন আরেক মুক্তিযোদ্ধা এই মতিউর রহমান। যুদ্ধজয়ের পর অস্থির সময়ে টগবগ রক্তে বিপ্লবের মোহও জেঁকে বসেছিল। জড়িত হয়েছিলেন জাসদ ছাত্রলীগের সঙ্গে।
ছাত্রজীবন শেষে ভাগ্যান্বেষণে পাড়ি দেন মধ্যপ্রাচ্যে। স্থিতি ছিলো না কিছুতেই। অল্পকাল পরে দেশে ফিরে এসে ব্যবসায় মন দিলেও তেমন সুবিধা করতে পারেন নি। তবে সৎভাবে জীবন ধারণ, সংসার প্রতিপালনের সংস্থান হয়েছিল। রাজনীতি, আন্দোলন-সংগ্রাম, বিভিন্ন সংগঠন, সংস্থার সাথে সারাজীবন জড়িত থাকলেও আঙ্গুল ফুলে কদলী বৃক্ষ হওয়ার মোহে পায় নি। সুনামগঞ্জ জেলা বাস্তবায়ন আন্দোলন কমিটির তিনি ছিলেন সাধারণ স¤পাদক। মুক্তিসংগ্রাম স্মৃতি ট্রাস্টের সাধারণ স¤পাদক, সুনামগঞ্জ ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতিসহ আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল পদে ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন। সুনামগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয়ের ১২৫ বছর পূর্তি উদযাপন পরিষদের তিনি ছিলেন সদস্য সচিব।
পৌঢ়ত্ব পাড়ি দিতেই অনেকটা অবসাদগ্রস্ততায় যেন পেয়ে বসেছিলো। বর্তমান সময়ের রাজনীতির সাথে ঠিক তাল মিলিয়ে চলায় অভ্যস্ত হতে পারেন নি। ঘরে বসেই সময় কাটতো। মাঝে মাঝে বন্ধু, সহপাঠীদের সাথে আড্ডা।
লেখালেখির ঝোঁকও পেয়ে বসে। যুদ্ধকালীন অনেক অজানা অধ্যায় তিনি তাঁর লেখায় তুলে এনেছেন। অতীত দিনের স্মৃতি রোমন্থন করে সহজ ভাষায় বেশ কিছু বাস্তব জীবনচিত্র তিনি গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেছেন। বিস্তৃত জীবনের সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা আর পর্যবেক্ষণ থেকে টুকরো টুকরো ঘটনা নিয়ে তাঁর “গল্প নয় সত্য” গ্রন্থটি বেশ সুখপাঠ্য। “রক্তমাখা কথামালা” নামে বইটিতে তিনি অনেক তথ্যের সাথে প্রায় একশত জন মুক্তিযোদ্ধার ছবি সংযোজন করেছিলেন, কয়েক বছর আগে যা নিতান্তই একটি কঠিন কাজ ছিলো। আমার একটি লেখাও তিনি “হৃদয়ে বাংলাদেশ” নামে স¤পাদনা করে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেছেন।
অগ্রজ প্রতীম বন্ধু স্বজন মতিউর রহমান আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন, বলা যায় অকালেই। এখন নাকি গ্রহণের কাল চলছে। এই দু’তিন বছরে আমরা হারিয়েছি অনেক ভরসার মানুষ, অনেক নির্ভরতার প্রিয়জন আর বিগত বছরের এমন দিনে হারালাম এক বিশ্বস্ত আশ্রয়স্থল, ভালোবাসার মানুষ মতিউর রহমানকে। এক শূন্যতা, রিক্ততা, আঁধার যেন ঘিরে ধরেছে জলজ্যোৎ¯œায় অভ্যস্ত এই শহরটিকে। কতো স্মৃতিই আজ ভেতর ঠেলে বের হয়ে বুকটাকে ভার করে দিচ্ছে কেবল। আলস্য অবসাদগ্রস্ততা থাকলেও আগামী প্রজন্মের জন্য একটা নুতন কিছু করার টান তাঁর সবসময়ই ছিল। অসুস্থ হয়ে চিকিৎসার জন্য ঢাকা যাওয়ার ক’দিন আগে দেখা হয়েছিলো বাসাতেই। সেই পুরনো আড্ডার মেজাজে। সেই আদি অকৃত্রিম চিনিসহ দুধ চা। বাটা ভরা পান। আগের মতোই কিছু একটা করার গভীর পরিকল্পনা। যা এর আগে অনেকবারই প্রণয়ন করা হয়েছে কিন্তু বাস্তবে আর করা হয়ে উঠেনি। যদিও মনে কুডাক ডেকেছিলো তবুও একবুক আশা নিয়ে বলেছিলাম- ভাই সুস্থ হয়ে এসো। অনেক কিছুই যে করার বাকি রয়ে গেছে। এবার শেষ করে নেবো সব কিছু। শেষ আর করা হলো না। সে আক্ষেপটুকু রয়েই গেলো। ২০২১ খ্রিস্টাব্দের এর ৭ নভেম্বর তিনি ইহকালের বন্ধন ছিন্ন করে পাড়ি দিলেন পরপারে।
আজ প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি এবং একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার প্রতি, জানাচ্ছি শ্রদ্ধানত কুর্নিশ।