1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
বৃহস্পতিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৫:৩৮ অপরাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

সেলফি রাজনীতি ও রাজনৈতিক মতাদর্শ

  • আপডেট সময় সোমবার, ৩১ অক্টোবর, ২০২২

:: হাবীব ইমন
এক.
বয়সে দুই কী তিন বছরের বড় হবেন তিনি। শহরের এর-তার পিছে ঘুরে বেড়াতেন। এ স্বভাব এখনও তার রয়ে গেছে। কয়েক বছরের ব্যবধানে ঢাকায় এসে সেটাকে তিনি কাজে লাগালেন। সারাদিন আওয়ামী লীগ অফিসে বসে থাকেন। যখন যে নেতা আসে, তারে ঘিরে ধরেন। নেতার সাথে সেলফি তুলেন। যেকোনো উপায়ে একখান সেলফি তার চাই-ই। নেতারাও চায় জব্বর একখানা ছবি, বিনে পয়সায় তার প্রচারণা হয়ে যাবে। এসব বড় বড় নেতার সঙ্গে সেলফি তুলে ফেসবুকে ছবি আপলোড করে নিজেকেও নেতা হিসেবে জাহির করাটা সহজ। এলাকার মানুষ জানছে তিনি তো ‘ইয়া বড় নেতা’। ‘ক্ষমতার বাহাদুরি’ বলে এটাকে। এ বাহাদুরিতে মানুষজনের কাছ থেকে চাকরি পাইয়ে দেওয়া, পোস্টিংসহ বিভিন্ন কাজে টাকা নেন। একসময় নামের সঙ্গে ‘চৌধুরী’ লাগিয়ে ফেললেন, চৌধুরী নামের লেজটা তার সঙ্গে ছিল না। একসময় মানুষ বিত্ত-বৈভব বাড়লে চৌধুরী, তালুকদার, সৈয়দ লাগিয়ে বংশগরিমা বাড়াত। ঠিক তেমনটাই হয়েছে তার ক্ষেত্রে। এখন তার খায়েশ হয়েছে এমপি হওয়ার। রীতিমতো পোস্টার ছাপিয়ে ফেলেছেন। যখন আমরা সংগঠন করতাম, তিনি পেছনের সারিতে ছিলেন। কখনো তাকে প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হতে দেখিনি। অনেক ঝড় আমরা সামলিয়েছি, তিনি ছিলেন পালিয়ে। রমরমা অবস্থায় তাকে ফের দেখা যেত।
দুই.
কয়েক দশক জুড়ে যে ‘গোধূলি সন্ধির নৃত্য’ চলছে, সেখানে প্রশ্ন উঠতেই পারে, আমরা আর কতদিন প্লেটোর গুহার মধ্যে অবস্থান করব, যেখানে ছায়াই একমাত্র ভ্রান্ত সত্য? কিছু ব্যক্তি ক্ষমতাচর্চার জন্য নতুন নতুন দোকান খোলে। তাদের স্বরূপ মাঝে-মধ্যেই উন্মোচিত হচ্ছে। শুধু আওয়ামী লীগ-বিএনপি নয়, অন্যান্য রাজনৈতিক দলের ভেতরেও এদের ছায়া আছে। যেটাকে আমরা রাজনৈতিক পরিভাষায় বলি, অনুপ্রবেশকারী; ক্ষমতাসীনদের মতে, ‘কাউয়া’। ব্যাপারগুলো মানুষ বোঝে না, তা বলা যাবে না। যখন আলোচনাগুলো সামনে চলে আসে, তখনই দেখা যায় অনেক রাজনৈতিক নেতা ফুঁসে উঠে এসবের দায় এড়াতে চান। মাঝে মাঝেই রাজনীতিবিদদের এসব নিয়ে ক্ষোভও প্রকাশ করতে দেখা যায়।
তিন.
রাজনীতি এখন আর ঠিক আগের মতো নেই কথাটি অনেকটা সঠিক। আদতে কোথাও রাজনীতি নেই। পুনর্বাসিত হচ্ছে হাইব্রিড, কাউয়া, ওয়ানটাইমার-রা। সামনে আরও পেশিশক্তি, টাকাওয়ালাদের দৌরাত্ম্য বাড়বে। আরও প্রকট হবে দুর্বৃত্তায়ন। একসময় ‘নীতি-আদর্শ-মতাদর্শ’ প্রতিষ্ঠার স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলো রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার জন্য প্রচেষ্টা চালাত। সময় বদলেছে। বর্তমানে এদেশেও ‘বাজার অর্থনীতি’র ব্যবস্থা চালু হয়েছে। এটা অবধারিতভাবে জন্ম দিয়েছে ‘বাজার রাজনীতি’র। ঘটেছে রাজনীতির বাণিজ্যিকীকরণ। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার প্রচেষ্টার পেছনে বাণিজ্যিক স্বার্থ প্রধান বিবেচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। ‘নীতি-আদর্শ-মতাদর্শের’ বিষয়গুলো হয়ে পড়েছে গৌণ।
চার.
যেকোনো মতাদর্শের মৌলিক উপাদান হচ্ছে তার দার্শনিক ভিত্তি। সেই দার্শনিক ভিত্তির স্বরূপটি কখনো সূত্রায়িত থাকে, কিংবা কখনো তা অসূত্রায়িত আকারে বিরাজ করে। তাই, যেকোনো মতাদর্শের স্বরূপ ও মর্মকথা বুঝতে হলে সেই মতাদর্শের দার্শনিক ভিত্তিটি স¤পর্কে প্রথমে স্বচ্ছ হওয়া আবশ্যক। সব মতাদর্শেরই যেমন সূত্রায়িত অথবা অসূত্রায়িত একটি দার্শনিক ভিত্তি রয়েছে, ঠিক তেমনি সব মানুষেরই একটি দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি আছে। যেহেতু দর্শনকে ঘিরে সৃষ্টি হয় নির্দিষ্ট মতাদর্শের, তাই মতাদর্শবিহীন মানুষের কোনো অস্তিত্ব নেই, থাকতে পারে না।
পাঁচ.
এক-সময় রাজনীতিবিদদের মধ্যে পড়ালেখার প্রতি একটা ঝোঁক ছিল, মুক্তচিন্তার গভীরতা ছিল, সংসদে ও সংসদের বাইরে তাদের প্রাজ্ঞ বক্তব্য শুনে মানুষ সমৃদ্ধ হতেন। মোহাবিষ্ট হতেন। সেই সময়ে রাজনীতিবিদদের যেমন কদর ছিল, তেমনি বুদ্ধিজীবী, লেখক, কবি, সাহিত্যিক, শিল্পীদের কদর দিতেন তারা। কিন্তু আজকাল সেইসবের কোনো বালাই নেই। আজ যারা সংসদে প্রতিনিধিত্ব করছেন, তাদের দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রশ্ন রয়েছে, এমনকি অনেকে তো গুছিয়ে কথাও বলতে পারেন না। এই শূন্যতায় নিজেদের স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে বের হওয়া যায় না।
ছয়.
রাজনীতির তীব্র সংকট ও শূন্যতায় শিক্ষিত ও বিদ্বান ব্যক্তিদের যে ভূমিকা থাকতে পারত, ‘বাণিজ্যমুখী গোলকায়নের যুগে’ মুক্তচিন্তা-সাংস্কৃতিক চেতনা স¤পর্কে নি¯পৃহতার মধ্যে তার সম্ভাবনা দেখছি না। আমি এখানে তাদের কথা বলছি না, যাদের ফরাসিরা বিদ্রƒপ করে বলে ‘কোলাবো’ (পড়ষষধনড়ৎধঃবঁৎং)। যারা আত্মবিক্রিত বুদ্ধিজীবী, যারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলার-নিয়ন্ত্রিত ভিশি সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন। ফ্রান্স আজও তাদের গ্রহণ করতে পারেনি। ক্রিস্টিন কুপার-এর ভাষায়, যে ‘পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল’ ক্ষেত্রবিশেষে কখনো হতেই পারেন ‘ইনএফেকচুয়াল’। নানা বাধা ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও একজন চিন্তাবিদ এক আদর্শ-বর্জিত রাজনীতিকের চেয়ে বেশি মূল্যবান। পাশ্চাত্যেও সক্রেটিস থেকে সার্ত্র বা চমস্কি পর্যন্ত মুক্তচিন্তার যে বিপুল ঐতিহ্যের বিস্তার, আজকের এই মিডিয়া বিস্ফোরণের যুগে সেটাও ক্রমশ ফিকে হয়ে এসেছে। জ্ঞানচর্চার বর্তমান বিচ্ছিন্নতা ও অগভীরতার পরিবেশে এই ফাঁক ভরাট করা সহজ নয়।
সাত.
আওয়ামী লীগ ১৩ বছর ধরে রাষ্ট্রক্ষমতায়। এ বারো বছরে তারা রাজনীতিটা ঠিকমতো করেনি, করেছে ক্ষমতার চর্চা। আওয়ামী লীগের শ্রেণি-চরিত্র বদলে গেছে। প্রাধান্য পেয়েছে ব্যবসায়ী শ্রেণির প্রভাব। গত দুই দশকে আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এক ধরনের অবক্ষয় ও স্থবিরতা গ্রাস করেছে। যা ভুঁইফোড় সংগঠনের ক্ষমতা চর্চাকে আরও বেশি অপ্রতিহত করে তুলেছে। দলীয় রাজনীতির দায়িত্বশীল পদে যারা আছেন, তাদের অনেকেই নিষ্ক্রিয় বা নিজেরা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। ফলে অনিবার্যভাবেই বাড়ছে ব্যবসায়ীনির্ভরতা। যা বিরাজনীতিকরণকে ত্বরান্বিত করছে। রাজনৈতিক দলগুলোতে গণতান্ত্রিক অনুশীলন ভীষণ কমেছে। একজন কর্মীর আদর্শের যে প্রেরণা নিয়ে দেশের সংকট মুহূর্তে কথা বলা প্রয়োজন, তা দেখা যাচ্ছে না। প্রশ্ন হলো, সরকার ও রাজনীতিতে এদের প্রভাব কেন? দেশে এমন পরিস্থিতি কেন সৃষ্টি হলো? ওরা কিন্তু জোর করে রাজনীতিতে ঢুকছে না। রাজনীতিবিদরা কি এর দায় এড়াতে পারবেন? এরা রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতার সুযোগ নিচ্ছে মাত্র। স্বাভাবিক নিয়মেই রাজনীতিবিদরা তখন সাইডলাইনে চলে যাবেন। যাচ্ছেনও।
আট.
আমরা আত্মসুখসর্বস্ব হয়ে উঠেছি। তাই তো কোনো আন্দোলন-সংগ্রাম ছুঁয়ে যাচ্ছে না। আমাদের সামনে এত এত ঘটনা ঘটছে, কিন্তু প্রতিবাদ-প্রতিরোধের আওয়াজটা খুব ছোট হয়ে আসছে। কিছুতেই এখন আমাদের কিছু যায়-আসে না। আমাদের ছুঁয়ে যাচ্ছে নানামাত্রিক ঝঞ্ছাটমুক্ত বিলাসী আলাপন কিংবা জীবনযাপন। বাসে কিংবা চায়ের কাপে ঠিকই আমরা ঝড় তুলছি। কিন্তু মিটিং-মিছিলে যাওয়াটা কিংবা আওয়াজ তুলে প্রতিবাদ জানানোটা এখন ‘ঝামেলা’ মনে হয়। এটাই হয়তো পুঁজিবাদের বাস্তবতা। এটাও ঠিক, রাজনীতিচর্চা না থাকলে ক্ষমতাচর্চা ব্যক্তিকে দখল করে ফেলে। ব্যক্তি তার নিজের ভেতরে কল্পরাজ্য হাজির করে। ফলে একের পর এক রাজনীতির দোকান খুলতে সহজ হয়। রাজনীতিতে এসব দোকান নিয়ামক শক্তি হয়ে উঠলে কিন্তু রাজনীতিই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কেবল সুযোগসন্ধানী বা সুবিধাবাদী রাজনীতি শেষ বিচারে ব্যক্তি, দল বা দেশ কারও জন্যই কল্যাণ বয়ে আনে না। রাজনীতির ভাষা হয়ে উঠবে আরও তিক্ত ও অশোভন। আমরা আরও আড়ষ্ট হয়ে যাব। এই সমাজকে পাল্টাতে সেজন্যই প্রয়োজন হয় সমাজ-অর্থনীতি-রাজনীতির দার্শনিক ভিত্তি ও তার গতিপ্রকৃতি স¤পর্কে যথাসম্ভব বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তা।
লেখক : সহ-সাধারণ স¤পাদক, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com