অঞ্জন পুরকায়স্থ ::
গ্রামবাংলার মানুষ শীতল পাটির ইতিহাস ও ঐতিহ্য প্রশংসায় যেমন পঞ্চমুখ, তেমনি এ ঐতিহ্যকে লালন করে জীবিকা নির্বাহের ক্ষেত্রেও প্রচেষ্টার অন্ত নেই। কিন্তু সাধ থাকলেও পাটি শিল্পীদের সাধ্য হয়ে উঠেনা উন্নত প্রযুক্তিতে পাটি তৈরি ও রপ্তানিমুখী করতে। ফলে বিলুপ্তির পথে জামালগঞ্জের পাটি শিল্প। সিলেট বিভাগের প্রত্যন্ত অঞ্চল জামালগঞ্জেরও উন্নত পাটি তৈরিতে অবদান রয়েছে। তবে বর্তমান সময়ে ভালো নেই পাটি শিল্পীরা। তারা দাদন ব্যবসায়ীদের সুদের যাঁতায় যেমন পিষ্ট হচ্ছেন, তেমনি এনজিও’র ঋণের জালে আটকা পড়েছেন।
জামালগঞ্জ উপজেলার সদর ইউনিয়নের সোনাপুর, দুর্গাপুর, চাঁনপুর, কদলতলিসহ ভীমখালী ইউনিয়নের কালীপুর গ্রামে বাস করে প্রায় ৫শত পাটিরা সম্প্রদায়। তাদের জীবন জীবিকার একমাত্র অবলম্বন পাটি তৈরি। প্রায় দুই শত বছর ধরে পূর্বপুরুষ থেকে ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন আজকের শিল্পীরাও। কিন্তু দিন বদলের পালায় দারিদ্রতার যাঁতাকলে পড়ে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার তো দূরের কথা, ক্রমান্বয়ে এই শিল্পের ঘটছে বিলুপ্তি।
সোনাপুর গ্রামের পাটি শিল্প পরিবারের ৭০ বছরের বৃদ্ধ বিমল কর ও নির্মল কর জানান, পূর্বপুরুষ থেকেই তাদের জীবন ও জীবিকা অর্জনের একমাত্র অবলম্বন শীতল পাটি তৈরি ও বিক্রি করা। প্রতিবেশী ৩টি গ্রামের পাটিয়ারা সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে রয়েছে পরস্পরের রক্তের সম্পর্ক, সাহিত্য সংস্কৃতি, ইতিহাস ঐতিহ্যে এমনকি জীবন ধারণের ক্ষেত্রেও সমন্বয়। ৩টি গ্রামে রয়েছে ৩টি কুটির শিল্প সমবায় সমিতি।
সোনাপুর কুটির শিল্প মহিলা সমিতির সভাপতি মুক্তা রানী নন্দী, সাধারণ সম্পাদক হেপি রানী কর, পাটি শিল্পের উন্নয়নকর্মী ¯œাতকোত্তর ডিগ্রী ধারী মণিকা রানী কর, কলেজ পড়–য়া ইতি রানী ধর, তৃষ্ণা কর, স্কুল পড়–য়া সাগরিকা করের মতো অনেক মেয়েরাই পড়াশোনার ফাঁকে পাটি বুনতে সাহায্য করে তাদের মা-কাকিদের। তারা বলেন, অভাব আমাদেরকে সব সময় তাড়া করে বেড়ায়। অভিজ্ঞ পাটি শিল্পী অনিলা রানী, লক্ষ্মী ও সন্ধ্যা রানী কর বলেন, আমরা প্রত্যেক পরিবারেই ঋণের জালে বন্দি।
চাঁনপুর বিত্তহীন কুটির শিল্প মহিলা সমিতির সভাপতি খুকু মনি কর ও সাধারণ সম্পাদিকা স্বর্ণমণি কর, দুর্গাপুর ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প মহিলা সমিতির সভাপতি সবিতা রানী কর ও সাধারণ সম্পাদিকা নীলু রানী কর, মঞ্চবালা কর, হেমলতা বণিক, কানন বালা করের সাথে কথা হয় পাটি তৈরির কলা কৌশল ও অর্থনৈতিক কার্যক্রম নিয়ে।
মুক্তা রানী নন্দী বলেন, তাদের প্রাত্যহিক কাজের প্রধান হচ্ছে পাটি তৈরি করা। নববধূদের মধ্যেও রয়েছে পাটি বুননের প্রতিযোগিতা। যে মহিলা যত নিখুঁতভাবে পাটি বুনন করবে তাদের সম্প্রদায়ের কাছে তার যোগ্যতা ততো বেশি হবে। শিশুদের মধ্যে যারা আগে পাটি বুননের কাজ আয়ত্ব করবে মা বাবার কাছে আদরের পাল্লা ততো ভারী হয়। পাটি তৈরির উপাদান ও উপকরণ সংগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলে দুর্গাপুর মহিলা সমিতির সভাপতি সবিতা রানী কর বলেন, আমাদের পুরুষেরা পাটি তৈরির সরঞ্জাম যোগান দিয়ে থাকে। মুর্তা হচ্ছে পাটি তৈরির একমাত্র প্রধান উপাদান আর সেই মুর্তা পুরুষেরাই সুদূর চিনাকান্দি, কুমিল্লা, সিলেট শালিটিকর, মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর, বড়লেখা, বিয়ানীবাজার, দাসের বাজার, রাজশাহী ও কিশোরগঞ্জ জেলা থেকে ক্রয় করেন। পাটি তৈরির পর পুরুষরাই গ্রামে গঞ্জে হাট বাজারে বিক্রয় করেন। চিকন ও পাতলা বেত তৈরির জন্য কাঞ্চার কাঁটা দিয়ে মসৃণ করে শীতল পাটি তৈরির কাজ করে মেয়েরা।
সমিতির সদস্যা অরমিলা, মায়া, সন্ধ্যা ও সুনীতি রানী নন্দী বলেন, সংসারে কাজের ফাঁকে ৩ জনে ১টি শীতল রঙিন পাটি বুনতে সময় লাগে ৩ দিন। যার খরচ হয় ৫০০-৭০০ টাকা। কিন্তু বিক্রয় হয় ১০০০-১২০০ টাকা। অথচ বড় শহরে ও রাজধানীতে এর মূল্য ৩০০০-৪০০০ টাকা।
একটি অভিজাত শাহী শীতল পাটি তৈরিতে রঙ, বেত, শ্রম সহ খরচ হয় ২০০০-৩০০০ টাকা। রাজধানীসহ ভারতীয় বাজারে এর মূল্য ৫০০০-৮০০০ টাকা।
ভীমখালি ইউনিয়নের কালীপুরের পাটি শিল্পীদের মধ্যে শুক্লা কর, সুযতœ, বিশখা দত্ত ও শিক্ষার্থী মমতা, মায়া ও শিখা কর জানান, প্রায় ৭ শত টাকা খরচের বেতে ২ জনে ১টি পাটি ২দিনে বুনতে পারেন। পরিবারের পুরুষ সদস্যরা গ্রামে গ্রামে এই পাটি বিক্রি করেন ১০০০-১২০০ টাকায়। যা দিয়ে সংসার চলে না। মুর্তা বেতকে সিদ্ধ করে মিহি বেতের দ্বারা শীতল পাটিতে হরেক রকম দৃশ্য অংকন করে পাটি বুনতে পারে তারা। যার মূল্য ১০ হাজার টাকা হওয়ার কথা কিন্তু তারা কখনো ন্যায্য মূল্য পায় না।
পাটি শিল্পীরা অর্থনৈতিক দৈন্যদশায় নিমজ্জিত। তাদের পুঁজি নেই। ফলে সুদখোরদের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা আনতে হয়। টাকা এনে পাটি বিক্রয়ের লভ্যাংশ দাদন ব্যবসায়ীকেই দিতে হয়। সম্প্রতি সাপ্তাহিক কিস্তিকে পরিশোধযোগ্য এনজিওদের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করেছে বলে জানা যায় প্রতিটি পাটি শিল্প পরিবার। তারা আশা, ব্র্যাক, গ্রামীণ ব্যাংক নামক এনজিওর কাছে দায়বদ্ধ। সাপ্তাহিক কিস্তিতে প্রথমেই মূল ধন থেকে কমে যায় টাকা। ফলে বেতসহ উপকরণ দিয়ে পাটি তৈরি ও বিক্রয়ের পূর্বেই আরও ঋণী হতে হয়। এভাবে অনেক পরিবার অজান্তেই অসংখ্য এনজিওদের হাতে ঋণগ্রস্ত। ঋণের যন্ত্রণায় অনেক পুরুষ গ্রামছাড়া, মহিলারা শহরে পাড়ি জমিয়েছে। ঋণ নিয়ে শোধ করতে পারবেনা ফলে সঞ্চয়ী রেখেই গ্রাম ছেড়ে পাড়ি জমাচ্ছে শহরে। কিংবা শহর থেকে অনেক দূরে পাথরের কোয়ারিতে, ইট ভাটায়, কেউবা মুদি দোকানে কাজ করছে।
পাটি শিল্পীরা চায় মাসিক ও বাৎসরিক কিস্তিতে সুদমুক্ত পরিশোধযোগ্য একটি পুজি। যদি ঋণ পরিশোধে এক বছর সুযোগ দেয়া হয়, তবে গ্রাম ছেড়ে শহরে পালাতে হবে না। ফলে পাটিশিল্পীরা বিদেশে রপ্তানিযোগ্য আরো উন্নতমানের পাটি তৈরি করতে পারবেন।
জামালগঞ্জ উপজেলার এই পাঁচটি গ্রামে ৫০০ পরিবারের সবাই ভূমিহীন। পরিবারের পুরুষেরা পাটি বিক্রি ছাড়াও, রিকসা চালিয়ে সংসারের খরচ বহন করেন। তারা বলেন, বিলুপ্তির পথে পাটি শিল্পকে সুরক্ষা করার জন্য ও ৫০০ পরিবারের জীবন-জীবিকা নির্বাহের পথ সুগম করতে সরকারি সহযোগিতা এবং পৃষ্ঠপোষকতা জরুরি।
জামালগঞ্জ সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কামাল হোসেন ও ভীমখালি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. আখতারুজ্জামান তালুকদার বলেন, আমরা চেয়ারম্যান পদে নতুন নির্বাচিত হয়েছি। শীতল পাটি তৈরির এই দক্ষ শিল্পীদের জীবন-জীবিকার উন্নয়নে আর্থিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিব।
জামালগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিশ্বজিত দেব বলেন, সরকারিভাবে বাঁশ ও বেতসহ পাটি শিল্পীদের অনেককে ১৮ হাজার টাকা করে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। ক্রমান্বয়ে সকলেই পাবেন।
উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ইকবাল আল আজাদ বলেন, পাটিশিল্পীরা শুধু জামালগঞ্জের নয় আমাদের দেশের গর্ব। এমপি মোয়াজ্জেম হোসেন রতনের সহযোগিতায় মুর্তা চাষের জন্য খাস জমির বন্দোবস্ত করতে ভূমি মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ পাঠাব। বাৎসরিক কিস্তিতে পরিশোধে সুদমুক্ত ঋণ প্রদানে সরকারি ব্যাংকের কাছে অনুরোধ করবো।