জাহাঙ্গীর আলম ভুঁইয়া ::
যেদিকে চোখ যায় শুধু লাল শাপলা। রক্তিম লাল শাপলার সৌন্দর্য পূর্ব আকাশে সূর্যের রক্তিম আলোকছটাকেও হার মানায়। যেন পানির ওপর ফুলে ফুলে সাজানো লালগালিচা। এখন লাল শাপলায় ঢেকে গেছে পুরো বিল। যেন বিলজুড়ে লাল শাপলার মেলা। এর সাথে দেশীয় নানা প্রজাতির পাখির কিচিরমিচির শব্দ প্রকৃতি তার রূপের সাথে নিজেই যেন বাদ্যযন্ত্রে সুরের ঝরণাধারা ছড়িয়ে দিয়েছে। এই সৌন্দর্য যেকোনো পর্যটককে মায়ার ইন্দ্রজালে জড়িয়ে রাখে। তবে রয়েছে অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ফলে দুর্ভোগ পোহাতে হয় আগত পর্যটকদের।
বলছিলাম মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে ‘লাল শাপলার হাওর’ বিকিবিলের কথা। জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি শাপলার উপস্থিতি দেখা যায় এই বিলে। বিলটি তাহিরপুর উপজেলার উত্তর বড়দল ইউনিয়নের কাশতাল গ্রামের পাশে অবস্থিত। পাহাড় আর হাওরের পাশাপাশি বিকি বিলের এমন সৌন্দর্য স্থানীয়দের পাশাপাশি মুগ্ধ করছে বিভিন্ন স্থান থেকে আসা পর্যটকদের।
উপজেলার উত্তর বড়দল ইউনিয়নের কাশতাল, বরোখাড়া ও আমবাড়ি গ্রাম বিকি বিলটিকে তিন দিক থেকে ঘিরে রেখেছে। বিকি বিল হাওরের ১০০ কিয়ারের অধিক (৩০ শতাংশে এক কিয়ার) জমি নিয়ে এই শাপলার গালিচা বিছিয়েছে। এখানে জন্মে লাল শাপলার পাশাপাশি সাদা ও বেগুনি রঙের শাপলাও। বছরের ছয় মাস এই বিলে পানি আর ছয় মাসই এই সময়ে লাল শাপলার সমারোহ ঘটে। কোনো রকম চাষাবাদ ছাড়াই গত ১৫-১৬ বছর ধরে প্রাকৃতিকভাবে লাল শাপলা ফুলের বিপুল সমারোহ ঘটে। তবে গত ৭ বছরের বেশি সময় ধরে লাল শাপলার এই অপরূপ দৃশ্য দেখতে দর্শনার্থীরা আসেন। এ জন্য ২০১৯ সালের ১২ অক্টোবর তৎকালীন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবদুল আহাদ এ বিলটিকে পর্যটন ¯পট হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন।
বিকিবিল পার্শ্ববর্তী বাসিন্দা কৃষক আমির আলী জানান, সূর্যের উপস্থিতি বাড়ার সাথে সাথে শাপলা তার আপন সৌন্দর্যকে গুটিয়ে নিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। সূর্যোদয় থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত লাল শাপলার সৌন্দর্য্য দৃশ্যমান থাকে। প্রাকৃতিকভাবেই এই হাওরে ফুটছে আকর্ষণীয় লাল শাপলা, যা হাওরের আশপাশের পরিবেশ আর গ্রামগুলোকে মনোমুগ্ধকর করে তুলেছে। বর্ষাকালে হাওরটি পানিতে নিমজ্জিত থাকে। আর বাকি ছয় মাস এখানে বোরো ধানের চাষাবাদ হয়। মাত্র কয়েক মাসের জন্য এখানে শাপলা ফোটে। সাদা ও বেগুনি রঙের শাপলা মূলত লাল শাপলার তুলনায় অপ্রতুল। স্থানীয়ভাবে সহজলভ্য হওয়ায় এলাকার লোকজন শাপলা তুলে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করেন এবং বিভিন্ন হাটে বিক্রি করে থাকেন।
স্থানীয় ফটোগ্রাফার অমিয় হাসান বলেন, এই জেলার উন্নয়নে নতুন স্বপ্নের ডানা মেলছে। উত্তরে বিশাল জৈন্তা-খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশে সুবিন্যস্ত হাওর, নদী, খাল, জনপদ। ধান, মাছ, বনজ ও খনিজ স¤পদের পরিচিতির সাথে পর্যটন স্পটের পরিচিতি এখন যোগ হয়ে। দেশের বৃহত্তম টাঙ্গুয়ার হাওর, শহীদ সিরাজ লেক, বারেকের টিলা, যাদুকাটা নদী, শিমুল বাগান, প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন হলহলিয়া জমিদার বাড়ির পাশাপাশি লাল শাপলার বিকিবিলটি পর্যটন সম্ভাবনার নতুন মাত্রা যোগ করেছে। সৌন্দর্যের সাথে নতুন করে আকৃষ্ট করেছে। এখন প্রয়োজন এলাকার অবকাঠামোগত উন্নয়ন।
উত্তর বড়দল ইউনিয়নের ছাত্রলীগের সাধারণ স¤পাদক আশরাফুল ইসলাম আকাশ বলেন ,প্রাকৃতিক স¤পদে ভরপুর ও পর্যটনসমৃদ্ধ নয়নাভিরাম মনোমুগ্ধকর লাল শাপলার বিকিবিল এলাকার সৌন্দর্য্য ঐশ্বর্য্যে পরিণত হয়েছে। আর পর্যটকদের জন্য নতুন পর্যটন ¯পটে রূপ নিয়েছে। এছাড়াও উত্তরে গাঢ় সবুজ পাহাড় আর লাল-সবুজে ভরা প্রকৃতির রূপ এযেন সবুজ পাহাড়ের সাথে লাল শাপলার মিতালী। প্রতিদিনেই পর্যটকদের আগমন ঘটছে।
উত্তর বড়দল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাসুক মিয়া বলেন, বাদাঘাট বাজার থেকে কাশতাল গ্রামের দূরত্ব এক কিলোমিটারের মতো হবে। সড়কের বাঁ পাশে চোখে পড়বে বিকি বিল। ডানে তাকালে মেঘালয় পাহাড়। পাহাড়ের ওপরে মেঘের খেলা। হাওর-পাহাড়ের সৌন্দর্য মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। বিলে শাপলার ফাঁকে ফাঁকে ছোট নৌকায় করে ঘুরছেন লোকজন। বিলের জলে নেমে শালুক তুলছে আশপাশের গ্রামে নারী ও শিশুরা। এগুলো বিক্রি করে কিছু বাড়তি আয় করেন তাঁরা।
তাহিরপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান করুণাসিন্ধু চৌধুরী বাবুল বলেন, টাঙ্গুয়ার হাওরসহ বিভিন্ন পর্যটন স্পটের পাশাপাশি লাল শাপলার বিকিবিল প্রকৃতির এক অপরূপ সৃষ্টি। বিকি বিলের উন্নয়নসহ এলাকার রাস্তাঘাট উন্নয়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
যেভাবে যাবেন :
সুনামগঞ্জ জেলা শহরের আব্দুজ জহুর সেতু এলাকা থেকে মটর সাইকেলে তাহিরপুর উপজেলার বাদাঘাট বাজারে হয়ে বিকিবিল। আর সিএনজি বা অন্য কোন যানবাহন চলাচল করে না সরাসরি। তবে জেলা শহর থেকে সিএনজি, লেগুনাযোগে লাউড়েরগড় অথবা মিয়ারচর খেয়াঘাট। এরপর নদী পার হয়ে মোটর সাইকেল দিয়ে বিকিবিল যাওয়া যায়।