নিতাই চন্দ্র রায় ::
শরতের শান্ত নদীর চরে যখন সাদা কাশকন্যারা নৃত্য করে, শেফালির শুভ্রতা ও মোহনীয় গন্ধে প্রকৃতি যখন আনন্দে আত্মহারা, যখন বিলের জলে পাখা মেলে লালপদ্ম, ঠিক তখনই মা দুর্গার আগমন ঘটে শস্যের সবুজ সংগীতে, বৃক্ষের বন্দনায়, ঢাকের শব্দে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সোনার বাংলায়, নজরুলের বাংলাদেশ ও জীবনানন্দের রূপসী বাংলায়।
দুর্গা হিন্দুধর্মের জনপ্রিয় দেবী। মা দুর্গাকে হিন্দুধর্মে দেবী পার্বতী এবং মহাশক্তির এক অনন্য শক্তিরূপ হিসেবে মনে করা হয়। দুর্গা শব্দের অর্থ হলো যিনি দুর্গতি বা সংকট থেকে রক্ষা করেন। দেবী পার্বতীর নানা রূপ রয়েছে, তার মধ্যে দশভুজা অধিক জনপ্রিয়। সিংহকে দেবী দুর্গার বাহন হিসেবে মান্য করা হয়। দুর্গম নামে এক অসুরকে বধ করেছিলে পার্বতী এজন্যই দেবী পার্বতীকে দেবী দুর্গা নামে অভিহিত করা হয়। দেবী দুর্গার অস্ত্র হিসেবে ধরা হয় ত্রিশূল, চক্র, গদা, শঙ্খ, ধনুক ইত্যাদি। দেবী দুর্গার পিতা হলেন হিমালয় এবং মা হলেন মেনুকা রানী। কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী ও সরস্বতী হলেন মা দুর্গার সন্তান।
দুর্গাপূজার নিয়ম অনুযায়ী, আশ্বিন মাসের প্রথমে যে অমাবস্যা হয় সেটি মহালয়া। এরপর যে চাঁদ ওঠে, সেই চাঁদের ষষ্ঠ দিনে দেবীর বোধন বা মহাষষ্ঠীর মাধ্যমে দুর্গাপূজার শুরু হয়। পুরাণ অনুযায়ী, মহাষষ্ঠীর দিনে দেবী পৃথিবীতে নেমে আসেন। ব্রহ্মার বরে মহিষাসুর অমর হয়ে উঠেছিলেন। তবে সেই বরে বলা হয়েছিল, শুধু নারীশক্তির কাছে তার পরাজয় হবে। ফলে অসুরদের কারণে যখন দেবতারা অতিষ্ঠ, তখন ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর মিলে দেবী দুর্গাকে সৃষ্টি করেন। দেবতার দেওয়া অস্ত্র দিয়ে তিনি অসুরকে বধ করে স্বর্গে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলার কৃষির সঙ্গে দুর্গাপূজার রয়েছে এক নিবিড় স¤পর্ক। মন্ত্রে বলা আছে, বর্ষার শেষে কৃষক যখন নতুন শস্য উৎপাদন শুরু করেন, সেই শস্যের ওপর ভিত্তি করেই দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। কারণ, জগতের মা যিনি, তিনি শস্যরূপেই আমাদের জীবন রক্ষা করেন। দুর্গাপূজা বাঙালি সনাতনী সমাজে একটি অন্যতম বিশেষ ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব। সাধারণত আশ্বিন মাসের শুল্কপক্ষের ষষ্ঠ থেকে দশম দিন পর্যন্ত শারদীয় দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। এই পাঁচটি দিন যথাক্রমে ‘দুর্গা ষষ্ঠী’, ‘দুর্গা সপ্তমী’, ‘দুর্গাষ্টমী’, ‘মহানবমী’ ও ‘বিজয়া দশমী’। আশি^ন মাসের শুল্কপক্ষটিকে বলা হয় ‘দেবীপক্ষ’। দেবীপক্ষের সূচনায় অমাবস্যারটির নাম মহালয়া। এই দিনে হিন্দুরা তর্পণ করে তাদের পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ইংরেজ দুঃশাসন ছিন্ন করে স্বাধীনতার জন্য মা দুর্গাকে আহ্বান জানিয়েছেন তার ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতায়। সেই বিখ্যাত কবিতায় তিনি বলেন : ‘আর কতকাল থাকবি বেটি মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল? স্বর্গ যে, আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল/দেব-শিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবকদের দিচ্ছে ফাঁসি/ভূ-ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী?’ এ বছর মা দুর্গা আসবেন ১৪ আশ্বিন শনিবার এবং শ্বশুরালয়ে ফিরে যাবেন ১৮ আশি^ন বুধবার। তিনি এবার গজে আসবেন, যাবেন নৌকায়।
সম্প্রতি ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির মিলনায়তনে সাংবাদিকদের সঙ্গে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের এক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় দুর্গাপূজা সুন্দরভাবে স¤পন্ন করার জন্য গুজব রটালে ৯৯৯ নম্বরে ফোন দেওয়া, ম-পে সিসিটিভির ব্যবস্থা করা, ষষ্ঠী থেকে বিজয়া দশমী পর্যন্ত স্বেচ্ছাসেবকের ব্যবস্থা করাসহ ২১ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়। সংবাদ সম্মেলনে পূজা উদযাপন পরিষদের নেতারা জানান, গত বছর সারা দেশে ৩২ হাজার ১১৮টি ম-পে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। এ বছর সারা দেশে পূজা হবে ৩২ হাজার ১৬৮টি মন্ডপে, এ সংখ্যা গতবারের চেয়ে ৫০টি বেশি। এবার ঢাকা মহানগরে ২৪১টি ম-পে পূজা হবে, যা গতবারের চেয়ে ৬টি বেশি। তারা আরও বলেন, গত বছর কুমিল্লার একটি ম-পে প্রতিমার ওপর কোরআন শরিফ রাখার অভিযোগে বিভিন্ন মন্দির ও পূজাম-পে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এ ঘটনার জের ধরে দেশের আরও কয়েকটি জেলায়ও হামলার ঘটনা ঘটে। বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণেই বারবার ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হচ্ছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইনের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু এখনো তা বাস্তবায়ন হয়নি। তাই আগামী নির্বাচনের আগেই এটি বাস্তবায়ন করতে হবে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, বাংলার মাটিতে সাম্প্রদায়িকতার কোনো স্থান নেই। মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান, বাংলাদেশে যারা বাস করেন, তারা সবাই এ দেশের নাগরিক। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তারা সম-অধিকার ভোগ করবেন। তিনি আরও বলেছেন, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আমাদের অবশ্যই সজাগ থাকতে হবে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে গড়া রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকাকালে কুমিল্লার নানুয়া দিঘীর পাড়ের মতো, পীরগঞ্জের রামনাথপুর ইউনিয়নের বটতলার মাঝিপাড়ার মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা মেনে নেওয়া যায় না। যে দেশের মাটিতে ত্রিশ লাখ শহীদের রক্ত মিশে আছে, যে দেশে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করে প্রাণ দিয়েছেন দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা, জিসিদেব, মুনীর চৌধুরী, শহিদুল্লা কায়সার, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, সে দেশে কেন পূজার মন্দিরে হামলা হবে? হিন্দুদের বাড়িঘর, দোকান-পাট লুটপাট হবে? অগ্নিসংযোগ হবে? তা আমাদের বোধগম্য নয়। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে দেশের আপামর জনসাধারণ বিশেষ করে যুবসমাজকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে দেবী দুর্গা পরম ভক্তিময়। তার এক রূপ অসুর বিনাশী, আরেক রূপ মমতাময়ী মাতার। তিনি অশুভর প্রতীক অসুরদের দলপতি মহিষাসুরকে বধ করে দেবকুলকে রক্ষা করেন। এর মধ্য দিয়ে অন্যায় অশুভর বিপরীতে ন্যায় ও শুভশক্তির জয় ঘোষিত হয়। তিনি কেবল সৌন্দর্য-মমতা-সৃজনের আধারই নন, অসহায় ও নিপীড়িতের আশ্রয়দানকারী এবং নির্যাতিত-নিপীড়িতের নির্ভরযোগ্য ভরসাস্থল।
লেখক : সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি), বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন