:: ড. মিথিলা চক্রবর্তী রিমঝিম ::
ক্লাস/ল্যাব শেষ হতে হতে প্রায়দিনই বিকেল হয়ে যেতো। তখন ক্যা¤পাসেই থাকতাম, ক্লান্ত হয়ে ফিরতাম হেটে হেটে। দুপুরের খাবার প্রায় দিন ছিল সিংগারা, পুরি। ফুলার রোডের বাসাও ছিল তিন তলায়। দরজায় কলিংবেল দিতেই দরজা খুলে বিশাল এক হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করত “আইছছ!”
আমি তড়িঘড়ি করে ফিল্টার থেকে জল খেতে নিলে বলত “জলও নাই নি ডিপার্টমেন্ট! ভগবান!”
স্নান, পূজা শেষ করে খেতে বসলে আমার চেয়ারের ঠিক উলটো পাশে বসত, যদিও তখন তার ঘুমের সময়। আমি খাই আর সে দেখে, আর এই সেই নিয়ে ক্ষেপানো চলে। ‘স্যুপ খাইলা আরেকটু’ এর উত্তরে বলতাম ‘ইটারে ডাইল কয়, ডাইল, স্যুপ নায়’, তার উত্তরে বলত ‘এলিট সোসাইটিতে স্যুপ বলে, ডাইল না, গ্রাম্য মেয়ে তাই বুঝিনা’।
আহা! আমাদের বড় আদরের ‘বড়কাকু’। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে এক গালভরা হাসি দিয়ে আমার খাওয়া যখন দেখতে তখন আমি যদি ঘুনাক্ষরে বুঝতাম এই সুখ খুব কম দিনের, আমি কোথাও যেতাম না আর। রোদে পুড়ে যখন আমরা ঠিক একটা গাছের ছায়ায় বসি, যখন প্রাণ জুড়ানো বাতাস বয়ে যায়, এক পশলা বৃষ্টি যেমন তপ্ত গরমকে শান্ত করে, বড়কাকুকে আমার একদম তেমনই মনে হতো। কখনো ইচ্ছে করে একই কথা বারবার বলতাম যেনো বড়কাকুর রিয়েকশন দেখতে পারি। এখনো ভাবি, আসলে কই তুমি এখন? সে জায়গায় কি আমাদের কথা মনে পড়ে? তখন কি আগের মতোই বলো ‘বড়রার ধৈর্য্য রাখা লাগে!’
যখন বাবা চলে যায় তখন আমি অনেক ছোট, তেমন কিছুই মনে নেই। কিন্তু বড়কাকুর সব কিছু আমার মনে আছে। বড়কাকুর হাটা, খাওয়া, কথা বলা বা ডাক দেয়ার ধরন সব মনে আছে। প্রায় শুক্রবার, বড়কাকু শুটকি রান্না করত, ডাল দিয়ে খাসির মাংসও করত তবে শুটকি প্রায় সপ্তাহেই হত।
কলাভবন থেকে এসেই, রিমঝিম পেঁয়াজ রসুন রেডি কর। সেই শুটকি আবার কাচা শুটকি। উপজাতিদের রেসিপির মতন করে রান্না। আমি, আমরা কোন ¯েপসিফিক কিছু না খেলে সেও খেতোনা। প্যাপিরাসে গেলেই এটা সেটা নিয়ে আসা ছিল খুবই কমন। বাবা যখন বেঁচে ছিলেন তখনও বড়কাকু যতবার সুনামগঞ্জ আসত ঠিক ততবার ম্যাচিং জামা-জুতা-ব্যাগ নিয়ে আসত।
বড়কাকুকে রোজ বিকালে আমি চা বানিয়ে দিতাম। সেই চা নিয়ে যে কত গল্প তার! মাঝেমধ্যে চা এর লিকার বেশি হয়ে গেলে বড়পিসিকে মজা করে বলত ‘খাইসস নি তাইর হাতের চা!’
বড়কাকুর জন্যই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই চান্স পেতে হবে এমন জেদ চাপে আমার। কিন্তু শুধুমাত্র আমার প্রথম বছরের রেজাল্ট আমি বড়কাকুকে জানাতে পেরেছিলাম। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাবার খবর পাপন দা বড়কাকুকে জানায়। বড়কাকু শুধু আমার মা কে ফোনে জানায় সে খুশির প্রকাশ। আমার মায়ের বড় আশ্রয় ছিল বড়কাকু। যখন অনার্স প্রথম বছরের রেজাল্ট হলো, তার আনন্দ জানাতে বড়পিসিকে রাত ১২ টায় ফোন দিয়ে বলেছিল, ‘দেখসস নি তাই নু ফার্স্ট ক্লাস থার্ড অইগেসে!’ এরপর কত কিছু হল, ডিনস থেকে শুরু করে আজ অব্দি যা কিছু সামনাসামনি কিছুই বলতে পারলাম না। কিন্তু আমি তোমাকে সকিছু জানিয়েছি বড়কাকু। হেন কোন মুহূর্ত নেই আমি মনে করিনি বড়কাকুকে।
আমার যেন এখনো চোখে ভাসে, জগন্নাথ হলের বাসার বারান্দার চেয়ারে সাদা গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরে বই হাতে বসা বড়কাকু। অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করত কিভাবে সম্ভব এত ভালোবাসা? নিজের সন্তানের মত করে কি আসলে ভালোবাসা যায়? আমিও জানিনা আসলে কিভাবে সম্ভব। আমি শুধু জানি আমার আজকের অবস্থানের পিছনে আমার কোন হাত নেই, ঈশ্বরের পর আমার মা, কাকারা, পিসিরা ছাড়া কোনভাবেই সম্ভব ছিল না কিছু।
প্রায়ই মনে হয়, যদি আমরা বড়কাকুকে জোর করে হাসপাতালে না পাঠাতাম, যদি বাসায়ই থাকত, তাহলে তো সে থাকত। আমার সমাবর্তনে যে ছবি তোলার কথা ছিল তার সাথে সে নিশ্চিত আমাকে তা নিয়েও ক্ষেপাতো! কল্পনা করে করে বড় হয়েছি বাবা থাকলে কি হতো, কিছুদিনের সুখের পর বড়কাকু কি বলত এও কল্পনাই করি! সংগীত বিভাগের হেন কোন ছাত্রছাত্রী নাই যে বড়কাকুকে দেখেছে, ক্লাস করেছে, কথা বলেছে আর তাকে ভালোবাসেনি! আমাদের ভিতরটা একদম শূন্য হয়ে গেছিল যেদিন ভুল চিকিৎসায় বড়কাকুকে মেরে ফেলল ল্যাবএইড হাসপাতাল! তারা কি বুঝে একজনকে মেরে আরো কতজনকে একেবারে শেষ করে দিল!
বড়কাকুর চলে যাওয়া এমন এক শূন্যতা যা কাউকে বলেও বোঝানো যায় না, কারোর উপস্থিতি তাকে কমায়ও না। অনেক গুণের মধ্যে, বড়কাকুর একটা অদ্ভুত গুণ ছিল কথা বলে মোহিত করে ফেলার। আমি, অর্ক আর বড়কাকু যখন কথা শুরু করতাম, বড়কাকুর ছাত্র এনামুল ভাই, সবুজ ভাই, পাপন দা এরা সবাই ঘিরে বসত। বড়কাকুর বাসাটা যেনো একটা আনন্দধাম, হাসি-খুশি-গানে ভরা আর তার মধ্যমণি বড়কাকু। একবার রোকেয়া হলে উঠার চেষ্টা করলাম হলে থাকার লোভে। বড়কাকুকে বলার পর এমন এক পরিস্থিতি হলো আমি আমার এপ্লিকেশনটিই ফেলে দিয়েছিলাম। বড়কাকুর চোখ বেয়ে জল গড়াচ্ছে আর আমাকে বলছে ‘কারণ কি? আমি থাকতে হলে কেন? এ বাসায় জায়গা না হলেও, কষ্ট হলেও তুই এখানে থাক।’
আমার বড়কাকু সারাজীবন শুধু করেই গেছে, কারো থেকে কিছু চায় নি, আশাও ছিল না। যে সংগীত বিভাগ সে চালু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, সেই সংগীত বিভাগের নতুন ভবনের উদ্বোধনের ফান্ডিং সেই এনে দেয় ইন্ডিয়ান হাইকমিশনের থেকে। অনুষ্ঠানের দিন আমি যখন এমনি ক্ষেপানোর জন্য বললাম, ‘কিতাবা তারা দেখি তোমারে ফালাইয়া কেক কাটিলিল?’ সে খালি বলল, ‘কাজ করে যাও, ফলের আশা করো না!’ এমন বাউল হওয়া কি এই দুনিয়ায় এত সহজ!
বাবা মারা যাবার পর আমি প্রায় তিনমাস অসুস্থ ছিলাম। আমি আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়তাম খুব সহজে। সেই আমি সুস্থ হতে হতেই আবার বড়কাকু চলে যায়। আমাকে যখন কেউ বলে কেন এত চিন্তা, কিসের এত কস্ট! আমি কোন উত্তর দিতে পারিনা। আঁকড়ে ধরতে গিয়ে তীর যখন ছুটে যায় তখন আসলে কেমন লাগা উচিত?
বড়কাকু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানসহ অসংখ্য গুণে গুণান্বিত মানুষটা আমাদের কাছে ছিল ম্যাজিশিয়ান, আমাদের খিলখিল করে হাসির কারণ, আমাদের অনন্ত ভরসার জায়গা। ঈশ্বর নিশ্চয় এই বাউলকে অনেক আদরে রেখেছেন।