:: রনেন্দ্র তালুকদার পিংকু ::
বীর মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান ১৯৫৩ সালে সুনামগঞ্জ শহরের তেঘরিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সুনামগঞ্জ সরকারি জুবিলী স্কুলে পড়া অবস্থায় ছাত্র ইউনিয়ন মতিয়া গ্রুপের সঙ্গে জড়িত হন। বীর মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমানের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি নিয়ে ১৯৯০ সালে একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি। ওই সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন- ১৯৬৯-য়ের গণঅভ্যুত্থানে আমরা মিছিল-মিটিংয়ে অংশ নেই। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের প্রথম দিকে আমরা প্রতিদিন মিছিল-মিটিংয়ে অংশ নিতাম। ২৫ মার্চ সারাদিন মিছিল-মিটিং করি। রাতে বাসায় আসি অনুমান সাড়ে ১০টার দিকে হোসেন বখ্ত সাহেব আমার বাসায় আসলেন। তিনি আমাকে ওবায়দুর রেজা সাহেবের বাসায় যাওয়ার জন্য বলেন। একটি সাইকেল নিয়ে রাতেই আমি বের হই। রাত পৌনে ১২টায় ওবায়দুর রেজা সাহেবে বাসায় গিয়ে দেখি সেখানে শহরের বিশিষ্ট লোকজন উপস্থিত হয়েছেন। সেখানের সিদ্ধান্ত মতে আমি, মালদার আলী ও তাঁরা মিয়াকে সিলেট-সুনামগঞ্জ আঞ্চলিক সড়কের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ডাবর ফেরী উড়িয়ে দেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়। একটি জিপ নিয়ে ভোর ৪টায় আমরা ডাবর পৌঁছি। মালদার আলী ও তাঁরা মিয়া রাইফেল তাক করে ফেরিঘাটের স্টাফদের জিম্মি করে ছয়ারা নিয়ে যান। সেখানে ফেরি ভাঙচুর করা হয়। প্রায় সকাল ১০টা পর্যন্ত আমরা ফেরিঘাট দখল করে চলে আসি। ২৭ তারিখ সন্ধ্যায় সুনামগঞ্জ ট্রাফিক পয়েন্টে হঠাৎ দেখি একটি নতুন জিপ। মুহূর্তেই সেই জিপ থানায় পৌঁছে। থানায় পৌঁছে জিপে বসা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন মাহবুব তথ্য কর্মকর্তাকে দিয়ে শহরে কারফিউ জারি করেন। ২৭ তারিখ রাতে রঙ্গারচর ইউনিয়ন থেকে লোকজন এনে প্রতিরোধ করার জন্য আমাকে দায়িত্ব দেয়া হয়। আমি লোকজন নিয়ে আসার পর শহরে ঢুকে দেখি গোলাগুলি চলছে। এভাবে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি পর্ব শুরু। আমাদের এই অপারেশন প্রায় দুই দিন চলে। ফলে পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন মাহবুবের দল সুনামগঞ্জ থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। প্রাথমিক প্রস্তুতি পর্বের প্রায় দেড় মাস পর ট্রেনিংয়ের জন্য ভারতের জোহাই জেলায় যাই। অনুমান আমরা মোট ২৬ জন এবং আমরাই মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম ব্যাচ। সেখানকার গহীন অরণ্যে ট্রেনিং শেষে মে মাসের শেষ দিকে চেলা সীমান্তের পাথরঘাটা নামক স্থানে আসি। পাথরঘাটা থেকে আমরা অপারেশন শুরু করি। মাস খানেক পাথরঘাটা এলাকায় অবস্থান করি। ওই এক মাসে অসংখ্য খণ্ডযুদ্ধ হয়। পাথরঘাটা থেকে বাংলাবাজারের বালিউড়ায় আসি সেখান থেকে রেঙ্গুয়া এবং পরে বাঁশতলায় আসি। আমার প্রথম অপারেশন ছিলো ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরিতে অভিযান। আমাদের দলের সবাই ছিল সুনামগঞ্জের। ছাতকের কোনো লোক নেই আমাদের দলে। তাই রাস্তাঘাট চিনতে কিছুটা অসুবিধা হয়। আমাদের দলনেতা ছিলেন সাধন ভদ্র। সাধন দা’র নেতৃত্বে আমরা অপারেশনে রওয়ানা হই। নরসিংপুর যাওয়ার পর স্থানীয় লোকজন আমাদের বাধা দেয়। রাতে এক বস্তিতে থাকি। পরের দিন মালেক পীর, সুফিয়ান পাকবাহিনীর অবস্থান নিশ্চিত করার জন্য সিমেন্ট ফ্যাক্টরিতে যায়। পরের দিন স্থানীয় গাইড নিয়ে রাতের অন্ধকারে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাতব্যাপী পাকবাহিনীর সাথে আমাদের গুলি বিনিময় হয়। আমাদের লোকবল কম থাকায় আমরা পিছু হটি। খাল-বিল সাঁতরিয়ে পাথরঘাট ক্যাম্পে যাই। সেখান থেকেও যুদ্ধ করতে থাকি। এভাবে ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত যুদ্ধ চলতে থাকে। পরবর্তীতে একদিন শুনি দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। আমি এবং মোসাদ্দেক রাজা অস্ত্র জমা দিয়ে সুনামগঞ্জে ফিরে আসি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমি বাংলাদেশ ছাত্রলীগ সুনামগঞ্জ মহকুমা শাখার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পাই। ১৯৭৫ সালে জাতির জনকের মৃত্যুর পর আমাকে গ্রেফতার করা হয়। পরে ছাড়া পেয়ে ১৩ মাস আত্মগোপনে থাকি। ১৯৮৫ সাল থেকে দীর্ঘ দিন মুক্তিসংগ্রাম স্মৃতি ট্রাস্টের সাধারণ সম্পাদক ছিলাম।”
বীর মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। অল্প কিছু দিন পূর্বে মতিউর ভাইয়ের সাথে আমেরিকা থেকে ফোনে কথা হয়েছিলো মরহুম আব্দুর রইছ সম্পর্কে একটি লেখা দেয়ার জন্য। তিনি আমাকে বলেছিলেন পিংকু লেখা প্রায় শেষ পর্যায়ে। সেই লেখা শেষ হয়েছিল কিনা জানতে পারেনি। তবে আমি সেই লেখার অপেক্ষায় মতিউর ভাই। কতো সরল-সহজভাবে লিখতেন আপনি। আপনার লেখাগুলো পড়লে চোখে ভেসে উঠতো সেই লেখার চিত্রপট। আজ আপনি নেই, এ কথা ভাবতেই পারছি না। সহজ-সরল মতিউর ভাইয়ের মুখটা বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। ভেসে উঠছে তার সাথে নানা স্মৃতি। আর অন্তরের গহীনে শূন্যতা অনুভব করছি বারবার। শ্বাসটা যেন বারবার দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে। লিখতে গিয়ে কী-বোর্ডে আঙুল আর নাড়াতে পারছি না। কিছুতেই যেন মানতে পারছি না- আমাদের সবার প্রিয় মতিউর ভাই আর নেই। আমার চোখের কোণে জল গড়িয়ে পড়ছে। আর লিখতে পারছি না। মতিউর ভাই না ফেরার দেশে ভালো থাকবেন।