1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
  3. [email protected] : wp-needuser : wp-needuser
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১২:৫৩ অপরাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

বোধ ও ভাবনায় শারদ উৎসব : সুখেন্দু সেন

  • আপডেট সময় বুধবার, ১৩ অক্টোবর, ২০২১

চিঠি এসেছে, এসেছে, চিঠি এসেছে। বিনি ডাকে বিনি খামের এ চিঠি প্রতি বছরই নিয়ম মেনে আমার কাছে আসে। সে চিঠিতে বড় আবেগ থাকে। সে আবেগে সৎ উৎসরণ আছে। মায়ের অকারণ মমতার মতো লেখাজোখা থাকে, ছত্রে ছত্রে প্রাণের টান থাকে। আঁকা থাকে নদীর তীর, মেঠোপথ। মাটির গন্ধ থাকে, গাঁয়ের একটা ছবি থাকে। কিছু চেনা মুখ ভাসে। পথ চেয়ে থাকা কিছু উন্মুখ চোখের দৃষ্টি থাকে। সে চিঠি আসে সাদা মেঘের ভেলায়, কাশবনের দোলায়। আসে শিশির ভেজা ঝরা শিউলির আল্পনায়। শরতের সে চিঠির জন্য আমার একটা মধুর অপেক্ষা থাকে তবু এ চিঠি আমি খুলে পড়িনা। প্রকৃতির আয়োজনে সে আমার আপন পাঠ। শরতে শারদীয়ার এমনি এক টান। আকাশে বাতাসে তার উদার মুক্তির পুলকিত আহ্বান। ঘরে ফেরার টান। যেখানেই থাকুক সে টান বাঙালির পিছু ছাড়েনা। পুজোকে কেন্দ্র করে সে টান তীব্র হয়। প্রতীক্ষার মাত্রা পারদ স্তম্ভের মতো চড়চড় করে বাড়ে। কখন পুজো আসবে। সে চিঠিতে অন্যান্য অনুষঙ্গের মতো পুজোর একটা গন্ধ মিশে থাকে। আকুলতা উথলে উঠে। ব্যাকুল হয়ে পুজোর দিনগুলি। সে আকুলতা, সে ব্যাকুলতা নৈষ্ঠিকতার টানে, তেমন নয়। পূজাআচ্চা অচলা ভক্তির জন্যও নয়। তাঁর চেয়েও বড় আকর্ষণে। পুজোর এ ক’দিন আমি অন্তত কিছু মানুষের মনের তৃপ্তি অনুভব করতে পারি। জীবনযুদ্ধে কার্যব্যপদ্দেশে যারা দূরে আছে, পুজোয় সন্তান বাড়ি আসবে অন্তত দু’চার দিনের জন্যও এমন বাসনা যারা পোষণ করে রেখেছেন, ঝাপসা চোখের প্রতিক্ষায় কী আলোর ঝিলিক খেলে তা আমি দেখতে পাই। অনেক দিন মেয়ে আসেনি, এবার পুজোয় আসবে এমন খুশির সংবাদ যে প্রতিবেশী নিজেই যেচে জানিয়ে গেলেন আমি তাঁর একাকী হৃদয়ের আকুলতাটা বুঝি। ছেলে আসতে পারতো কিন্তু বৌমা ছুটি পাবেনা এমন বিষাদে হতাশাগ্রস্ত বুড়ো-বুড়ির অন্তরবেদন, মর্মপীড়ন অনুভব করি।
শরতের পরিবেশে একটা আহ্বান থাকে, আবাহন থাকে। প্রকৃতগতভাবেই মিলনের তোড়জোড় থাকে। গ্রীষ্ম-বর্ষার দহন, বর্ষণ, প্লাবন শেষে সুচিস্নিগ্ধ এক স্বস্তি। হৃদবন্ধনের আবহ। মনছুট তাগিদ। কিন্তু ছুটি কি আর মেলে। কর্তব্য, রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব সেটা আটকে দেয়। প্রকৃতির যত আয়োজনই থাক, হৃদয়ের যত আবেদন থাক, তোমার প্রধান উৎসবকে কেন্দ্র করে সম্প্রীতির যতই মোড়ক থাক, ছুটি থাকবে একদিনই তাও হিসেবের নয়, পূজা শেষে। আবেগ আনন্দও সমান থাকতে পারবে না। অবশ্যই কম থাকতে হবে। লাশবাহী গাড়ির মতো। জন্মগতভাবে আকারে আকৃতিতে সমান হলেও, মৃত্যুর পর কোন পার্থক্য না থাকলেও তোমাকে বহন করা গাড়িটি ছোট হতে হবে। প্রকৃতিতে যতই সমতা থাক, উদারতা থাক মানুষের চিন্তায়-চেতনায় বিভক্তি দানা বেঁধে থেকে যায় কখনও সচেতনভাবে, কখনও অসচেতনতায়।
নিজের চাকুরী জীবনের প্রথম বছর ছুটির অভাবে পূজায় বাড়ি না আসায় কর্মস্থলে পুজো উপভোগের নতুন অভিজ্ঞতা খারাপ লাগেনি। ভালোই কেটেছিলো। বিজয়ার আশীর্বাদ নিয়ে ডাকযোগে বাবার চিঠি পৌঁছেছিল ছ’সাত দিন পর- “বাবারে, তুমি না আসায় এবারের পূজা আমাদের বড় নিরানন্দে অতিবাহিত হয়েছে। একাকীত্বের যাতনায় বৃদ্ধ মা বাবার দিনগুলি কেটেছে বড় কষ্টে। বিজয়ার প্রাণভরা আশীর্বাদ নিও।” চিঠি পড়ে আমার চোখ ভরে জল এসেছিলো। প্রিয় সান্নিধ্যের এ আকুলতা কেবল মন্ত্র উচ্চারণে তৃপ্ত হয় না।
এখন অখণ্ড অবসর। বাড়িতেই থাকি। মা-বাবা গত হয়েছেন। কয়েক বছর ধরে ছেলে বাড়ি নেই, মেয়েরও বিয়ে হয়েছে। কাছাকাছি থাকলেও পুজোয় মেয়ে বাবার বাড়ি আসবে সে এক অন্য অনুভব। পুজোর জন্য অপেক্ষা আর মেয়ের বাড়ি আসার অপেক্ষা আমার কাছে একই আবেগে একাকার হয়ে থাকে। দেব মন্দিরে দশপ্রহরণ ধারিণী দুর্গা পূজিতা হন দেবী রূপে কিন্তু গৃহ মন্দিরে আসেন নিতান্ত ঘরের মেয়ে উমা হয়ে। পুত্র কন্যাসহ। স্বামী গৃহ থেকে বাপের বাড়ি যেমন আসে মেয়ে তেমনি। আনন্দের মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়, সেতো গৃহ কোণে। কেবল ধর্মীয় বোধই নয় হৃদ্বোধ। ভক্তি ভাবে বাৎসল্য যুক্ত না হলে শারদীয় উৎসবের মাহাত্ম্য প্রস্ফূটিত হয় না। ধর্মীয় ভাবে দেবী স্বর্গের দেবতা হয়েই থাকেন আর হৃদয়বোধে হয়ে যান ঘরের কন্যা, জননী, আনন্দের উৎস। এ হৃদ্বোধটিকেই ঝুকি প্রিয় মন ‘ধর্ম’ বলে মানে। আমার কাছে শারদোৎসবের প্রাণময় সহজিয়া রূপ এটি। এ আবেগ শাস্ত্রের জটিলতায় বন্দী হতে চায় না। ধর্মীয় দর্শনকে অতিক্রম করে এক হৃদয়¯পর্শী ভাবকল্পনায় আপনা হতে ব্যপ্ত।
শারদীয়া উৎসবে কেবল রক্তের স¤পর্কে টান লাগে তেমন নয়। এ উৎসবের টান সর্বজনীন। শৈশবের যে সঙ্গীটি প্রায় বৃদ্ধের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, সংগত কারণেই এখন দূরে কোথাও অবস্থান করছে তার সান্নিধ্যও প্রত্যাশা করি। যদি না আসে তবে খারাপ লাগে। একাকীত্বটা জেঁকে বসে। অহেতুক হলেও দোষারোপ করি। বাড়ির টান কেমন করে ছেড়ে দিল। বউ আসতে দেয়নি। একেবারে স্ত্রৈন।
মৃদুল প্রতি বছরই আসতো। বৌ কেনো, বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকার বন্ধুরাও তাকে আটকাতে পারেনি। শুধু কি পুজোর টান। প্রাণের টান, নাড়ির টান। সে সাথে শহর বিতৃষ্ণ মনে গ্রাম তৃষ্ণা। তা নিজের গ্রাম না হোক, গাঁওগেরামের মানুষের সরল আনন্দ, জীবনের ধারা প্রায় একই।
খরচার হাওর পাড়ি দিয়ে যেতাম সীমান্তের কাছাকাছি। শহরের কৃত্রিম জৌলুস ছাপিয়ে প্রকৃতি ঘনিষ্ঠতায় পূজার সে আরেক আনন্দ। শরত সেখানে তার সকল পূর্ণতা নিয়ে আবির্ভূত। গাছের পাতায় ঝলমলে সোনারঙ রোদ। দৈন্য দগ্ধতায় রুক্ষশুষ্ক গ্রামমানুষের মুখায়বয়বে কিছুটা হলেও সোনারোদের সে আলো ঔজ্জ্বল্য ছড়ায়। সরলতা আর আড়ম্বরহীনতার এক পবিত্র আবহ থাকে পূজা মণ্ডপ ঘিরে নিত্যদিনের যাপিত জীবনের বাইরে এক ঝিলিক আনন্দ কাশফুলের মত উড়ে। সে আনন্দে শরীক হওয়ার প্রাপ্তিটাও কম নয়। এক পংক্তিতে মাটিতে বসে কলাপাতার পাতে ধুয়া উঠা গরম খিচুড়ির স্বাদ কোনো স্টারের সূচক দিয়ে পরিমাপ করা যায় না।
বন্ধু বান্ধবদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। কেউ কেউ মৃদুলের মতো নির্দয়ভাবে জীবিতদের নিসঙ্গ করে চলে যাচ্ছে। এক সময় যাদের নিয়ে গল্পে আড্ডায় হৈহল্লোড়ে রাত কাবার হয়ে যেতো তাঁদের অনেকেই এখন আর নেই। এরা যে আমার কেবল আপন জ্ঞাতিগোষ্ঠীর স্বজন তেমন নয়। জন্ম পরিচয়ে ভিন নামের, ভিন বিশ্বাসের পড়শী বান্ধবও এ তালিকায় কম নয়। পুজো আসে বলেই তাঁদের স্মৃতিটা নবায়ন হয়। একা হয়ে যাওয়ার যন্ত্রণাটা বাড়ে। উৎসবকে ঘিরে মিলন মেলার পরিসর যে সংকুচিত হয়ে আসছে সে অনুভবে কিছুটা বেদনাবোধও ক্রিয়শীল হয়। বয়স বাড়ছে। উৎসব আনন্দের মাত্রাটাও ভিন্নতর হচ্ছে। থেকেও যেনো অনেকেই নেই। অনেক কিছুই নেই।
উৎসবে উদ্যোগে প্রাণসঞ্চারী বিজিত অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে নির্জীব, ভাবলেশ হীন। অথচ এসময়ে সে’ই পূজার আনন্দে বেশি আন্দোলিত হতো। আন্দোলিত করতো অন্যদেরও। বয়স হার মানতো। বন্ধুবৎসল প্রাণচঞ্চল মানুষটি সবার আনন্দের ভাগ কমিয়ে দিয়ে একাকী দূরে পড়ে রইলো। তবুও শারদোৎসব প্রাণের মেলায় ভরে উঠবে। দুঃখ,কষ্ট, বিষাদ, দুর্যোগ, দুর্ঘটনা, মহামারীর তাণ্ডব ছাপিয়েও প্রাণ প্রাচুর্যের সরবতা মুখরতা জানান দিয়ে যাবে আমাদের মানবিক, হার্দিক অস্তিত্ব। আপন উপলব্ধির এ এক নব রূপায়ন। বেঁচে থাকার অনুভব। এ আমার বোধ, আমার বিশ্বাস। শাস্ত্রীয় আচরণের বাইরে। বোধ এবং বোধিতে যেটিকে আমি ধারণ করি সেটাই আমার ধর্ম হয়ে উঠে। অন্যেরটা এমন নাও হতে পারে। যার যার মনে কে কি ধারণ করবে সে তার নিজ নিজ ব্যাপার। চাপিয়ে দেয়ার নয়। মানুষ যে সর্ববিচারে মানুষ সেটি বুঝার জন্য বুঝাবার জন্য আচার আনুষ্ঠানিকতার প্রয়োজন যতটুক তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন মনুষ্যত্বকে খর্ব না করার শক্তি অর্জন। কোন বিশ্বাসই ধর্মের নামে বলেনি, তুমি নষ্ট হও। তবু প্রায় সবাই যে মানে নিজেরটি শ্রেষ্ঠ, কেউ বড় আপোসহীনভাবে নিজেরটির শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করণের আস্ফালনে মনুষ্যত্বটাকেই বলি দিতে প্রস্তুত হয়। তাহলে ধর্মটা রইলো কার জন্য। বিশ্বাসটা নিজের নিজের, স্বর্গস্বপ্ন আপন আপন কল্পনার। প্রার্থনার প্রকৃতি ভিন্ন ভিন্ন কিন্তু দেশটা সকলের। এ দেশটিকে যদি মায়ের মত ভালোবাসা যেতো, এ জ্ঞান, কাণ্ডজ্ঞানের যদি প্রতিফলন ঘটতো, তাহলে বড় একটা ধর্মের কাজ হতো। পৃথিবীর যেখানে মাটি আছে সেখানেই শান্তি থাকতো।

 

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com