:: রণেন্দ্র তালুকদার পিংকু ::
১৯৭১ সালে সুনামগঞ্জ সরকারি জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয়ের ৯ম শ্রেণির ছাত্র মালেক হুসেন পীর। ১৭ বছরের এক দুরন্ত কিশোর এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের একজন সক্রিয় কর্মী। কোনো রকম সামরিক প্রশিক্ষণ ছাড়াই বঙ্গবন্ধুর ডাকে এই কিশোর মুক্তিযোদ্ধা দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সুনামগঞ্জ শহরের তেঘরিয়া পীর বাড়ির মরহুম মছব্বির হোসেন পীরের ছেলে মালেক হুসেন পীর। সততার কারণে মুক্তিযোদ্ধা মালেক হুসেন পীর আক্ষরিক অর্থেই দীনহীনভাবে জীবন-যাপন করে গেছেন। মুক্তিযোদ্ধা মালেক হুসেন পীর নিজের দীনতার কথা প্রকাশে যারপরনাই কুণ্ঠিত থাকতেন। কিন্তু ভাঙাচাল গলিয়ে চাঁদের আলো দেখার মতোই তাঁর অসহায়ত্ব বড় বেশি পরিষ্কার ছিল। একজন মালেক হুসেন পীরের আত্মত্যাগ আমাদেরকে আত্মগ্লানির আগুনে পুড়ে মারে। বয়স কম হলেও রাজনৈতিকভাবে উদ্বুদ্ধ হয়েই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন কিশোর মালেক হুসেন পীর। স্বৈরশাসক আয়ূব খানের ছবি ভাঙায় অংশগ্রহণ থেকে তিনি স্থানীয় ছাত্রনেতাদের সঙ্গে থাকতেন। পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে ছাত্রলীগের দেওয়ান সুবক্ত রাজা, আবুবক্কর সিদ্দিকী, শফিকুল চৌধুরী প্রমুখ ছাত্রনেতাদের পাশে পাশে থাকতেন। এভাবেই ৭১’র মার্চে গঠিত সুনামগঞ্জ সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের সংস্পর্শে তিনি আসেন। বয়সে কনিষ্ঠ হলেও সংগ্রাম পরিষদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ তিনি করতেন। সুনামগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধাদের পিটিআই স্কুলের ক্যাম্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রশিক্ষক শফিকুল চৌধুরীর সঙ্গে মালেক হুসেন পীর ক্যাম্পের অনেক দায়িত্ব পালন করতেন। ১৯৭১ সালের ২০ মে ভারতের মেঘালয়ে ইকোওয়ান ট্রেনিং সেন্টারে সুনামগঞ্জ জেলার প্রথম ব্যাচ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যে ২৬ জন ট্রেনিংয়ে যান তাঁদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন মালেক হুসেন পীর। প্রথম ব্যাচের অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন সত্য গোপাল দে, তোফাজ্জল হোসেন, মতিউর রহমান, সুশান্ত রঞ্জন ভদ্র, প্রভাত রঞ্জন কর, শামসুল হক, শফিকুল হক চৌধুরী, দেওয়ান মোসাদ্দেক রাজা চৌধুরী, রতিশ রঞ্জন চৌধুরী, জয়নাল আবেদীন, নিতাই চন্দ্র কর্মকার, আ ত ম সালেহ, যতীন্দ্র কুমার দে, মো. আব্দুর রশিদ, প্রীতিশ চৌধুরী, হিরন্ময় কর, প্রভাত শুক্লবৈদ্য, সুনিল শুক্লা, মতি লাল দে, প্রাণেশ দাস, সৈয়দ আতাউর রহমান প্রমুখ।
মালেক হুসেন পীর ৫নং সেক্টরের বালাট সাব-সেক্টরের অধীনে সি-কোম্পানি কমান্ডার এনাম চৌধুরী ও সিরাজ চৌধুরীর নেতৃত্বে বহুবার বেরীগাঁও এলাকায় সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেন। ভারতে ট্রেনিংয়ে যাওয়ার পূর্বপর্যন্ত স্থানীয়ভাবে সংগঠিত মুক্তিযোদ্ধাদের স্থানে স্থানে খবর, আহার, পৌঁছানোর অনেক দায়িত্ব তিনি ও আবু সুফিয়ান পালন করতেন। মালেক হোসেন পীর পরিবারের কাউকে না জানিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তাঁর স্মরণীয় যুদ্ধস্মৃতি হলো ১৬ জুলাই ১৯৭১ ইং তারিখে সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে গোবিন্দপুর নামক স্থানে এন্টি ট্যাংক বিধ্বংসী মাইন স্থাপন করে শত্রুকে বিপর্যস্ত করে তোলার কাহিনী। ভারতীয় মেজর ডি-সুজার নির্দেশনায় তিনি সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের পাশে লক্ষ্মণশ্রী ইউনিয়নের গোবিনপুর গ্রামের উত্তর দিকে লন্ডনীর বাড়ির পাশের রাস্তায় ফেলানো ভাঙা পাথরের নিচে সন্ধ্যাবেলায় একটি এন্টি ট্যাংক মাইন স্থাপন করেন। কিছুক্ষণ পর সিলেট থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি গাড়ি মাইনের ওপর ওঠামাত্রই বিস্ফোরণ ঘটে। মালেক হুসেন পীর এই অপারেশন করে বালাট পৌঁছার পূর্বেই মেজর ডি-সুজা, দেওয়ান ওবায়দুর রাজা চৌধুরী ও যোগেন্দ্র শর্ম্মার নিকট সংবাদ পৌঁছে যায়। মালেক হুসেন পীর যোগেন্দ্র শর্ম্মার কাছ থেকেই খবর পান পাকিস্তানী আর্মির ৭জন সেনা সদস্য এই বিস্ফোরণে মারা যায়।
মালেক হুসেন পীর তাঁর পিতার মৃত্যুর পর সংসারের দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় পারিবারিক বিষয় সম্পত্তির কাগজপত্রের মধ্যে দেখতে পান পুরাতন একটি স্ট্যাম্পে ইংরেজিতে লেখা একটি হলফনামা। ১৯৭১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর তারিখে তাঁর পিতা এ হলফনামামূলে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার কারণে ত্যাজ্যপুত্র হিসেবে ঘোষণা দেন। ১৯৭১ সালে ত্যাজ্যপুত্রকরণের এফিডেভিটটি ২৭ জানুয়ারি ২০০৮ইং তারিখে মালেক হুসেন মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর ট্রাস্টি ও মেম্বার সেক্রেটারি ডা. সারোয়ার আলীর কাছে হস্তান্তর করেন। মালেক হুসেন পীর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেও বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্র আমাদেরকে উপহার দেওয়ার কারণে আজীবন আমাদের হৃদয়ে সমুজ্জ্বল থাকবেন। স্যালুট হে বীর…।