:: শহীদনূর আহমেদ ::
ফসলরক্ষা বাঁধের কাজে সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে ২০১৭ সালে সুনামগঞ্জে হাওর ডুবি হয়। সকল হাওরের বোরো ফসল তলিয়ে যায়। হাওর দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেলা শহরে যে কয়েকজন মানুষ শুরু থেকে সোচ্চার ছিলেন তাদের মধ্যে বীর মুক্তিযোদ্ধা মালেক হুসেন পীর একজন। অসীম সাহস আর আপোষহীন মানুষ ছিলেন তিনি। আমার দেখা সৎ নিষ্ঠাবান ব্যক্তির মধ্যে মালেক হুসেন পীর অন্যতম। তিনি শুধু মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেই তার সংগ্রামে ইতি টানেননি। স্বাধীনতা পরবর্তী বিগত ৫০ বছর ধরে অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। পাহাড় সমান মনোবল নিয়ে বিভিন্ন অপশক্তির বিরুদ্ধে একাই লড়াই করে গেছেন। সত্যের পক্ষে কথা বলেছেন।
ক্ষমতাধর অপশক্তির বিরুদ্ধে একজন মালেক হুসেন পীরের লড়াই ছিল সবসময়। অনেকে বলতেন- “বাঘে ধরলে ছাড়ে কিন্তু মালেক পীরে ধরলে ছাড়ে না।”
অন্যায়ের প্রতিবাদকারী আমৃত্যু যোদ্ধা মালেক হুসেন পীর-এর সান্নিধ্য পেয়েছি বলে নিজেকে ধন্য মনে করি। হাওর ডুবির পর গেল চার বছর সাংগঠনিক কার্যক্রমে জড়িত থাকায় মালেক চাচা’র সাথে আমার সখ্যতা গড়ে ওঠে। আমি তাঁকে দেখে, তাঁর কথা শুনে শিখতে থাকি। অসাধারণ প্রতিবাদী ব্যক্তিত্ব ছিলেন মালেক চাচা।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে গড়ে উঠা হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলনের সাংগঠনিক কার্যক্রম, কর্মসূচি বাস্তবায়ন, বিভিন্ন আন্দোলনে তার সক্রিয় অবস্থান ছিল। হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণকাজ তদারকিতে মুক্তিযোদ্ধা মালেক চাচা চষে বেড়িয়েছেন সুনামগঞ্জের দুর্গম এলাকায়। গেল দুই বছর ধরে তিনি লিভার সিরোসিস রোগে আক্রান্ত ছিলেন। মরণব্যাধি এই রোগ নিয়ে এই অদ্যম মানুষটি সকল অনিয়ম দুর্নীতিতে সোচ্চার ছিলেন।
চলতি বছরের এপ্রিলের দিকে দক্ষিণ সুনামগঞ্জের পূর্ব পাগলা ইউনিয়নের একটি বাঁধের কাজের অনিয়মের নিউজ করেছিলাম। বাঁধ পরিদর্শনে গিয়ে কাজটি ফেসবুক লাইভে তুলে ধরেছিলাম। মাস চারেক আগে মালেক চাচা সুনামকণ্ঠ অফিসে আসলেন। কাছে এসে সুন্দরভাবে বললেন, বাবাজি ভিডিওটা আমারে দিবায়নি। মামলার করবো। সব কাগজপত্র রেডি। ভিডিও দিলে সিডি করে আনতাম।
বললাম চাচা, প্রোফাইলে ঢুকে ডাউনলোড দিতে হবে। ভিডিও নামিয়ে আপনারে ফোন দিব।
নাছোড়বান্দা চাচা ভিডিওটি আমার কাছ থেকে উদ্ধারের জন্য বেশ কয়েকবার ফোন করেন। ব্যস্ততার জন্য কয়েকটি তারিখ পেরিয়ে ভিডিওটি চাচার হাতে পৌঁছে দিয়েছিলাম।
নিজের খেয়ে বনের মহিষ তাড়ানো প্রবাদ শুনেছি। মুক্তিযোদ্ধা মালেক হুসেন পীর ছিলেন এর অনন্য উদাহরণ। প্রতি মাসে যে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পেতেন তার বেশিরভাগ ব্যয় করতেন অনিয়ম-দুর্নীতির বিভিন্ন অভিযোগ দায়েরের পেছনে, মামলার পেছনে। নিজের টাকা খরচ করে সিলেট, ঢাকার বিভিন্ন অফিস, আদালতে ছুটে বেড়াতেন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের জন্য। এসব ব্যয় নির্বাহ করতে অনেক জায়গায় জমি বিক্রি করতে হয়েছে। এতো কিছুর পরও অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়তে পছন্দ করতেন তিনি। পরিবার, গোষ্ঠী, বন্ধুমহলে নিরুৎসাহ পেলেও হাল ছাড়েননি। একাই লড়েছেন।
জীবন সংগ্রামে লড়াকু এই বীরের প্রস্থান হল খুবই অসময়ে। এমন একজন সংগ্রামী বীরের মহাপ্রস্থানে অপূরণীয় ক্ষতি হলো শুধু সুনামগঞ্জের নয়, পুরো বাংলাদেশের। যে ক্ষতি পুষিয়ে উঠা সম্ভব নয়। আদর্শিক পুরুষ মালেক হুসেন পীর অদম্য সাহস এবং প্রেরণার বাতিঘর হয়ে আমাদের সকলের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন। স্যালুট বীর মুক্তিযোদ্ধা মালেক হুসেন পীর।
[লেখক : সাংবাদিক ও সংগঠক]