1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
  3. [email protected] : wp-needuser : wp-needuser
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:৫৩ পূর্বাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

আবু সুফিয়ান : সেই দুষ্টু সাহসী ছেলেটা জননেতায় পরিণত হয়েছিল

  • আপডেট সময় সোমবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১

:: নজির হোসেন ::
আশির দশকে শহর ও হাওর অঞ্চলে গড়ে ওঠা বীরত্বপূর্ণ আন্দোলন ও সংগ্রাম (স্বৈরাচার বিরোধী ও ভাসান পানি আন্দোলন) গুলো নিয়ে লিখবো ভাবছিলাম। কিন্তু হঠাৎ সুফিয়ানের না ফেরার দেশে চলে যাওয়া এই তাগিদটাকে সামনে নিয়ে এল। আমার সাথে অভিমান ছিল, রাগ ছিল। রাগ অভিমান না ভেঙেই না ফেরার দেশে চলে গেল। সেই ১৯৯৫ সালের পর থেকে আমার সামনেও আসেনি, ফোন দেয়নি। আমি ফোন দিলে ‘নো আনসার’ আসতো। মাঝখানে একবার ফেসবুকে যোগযোগ হয়েছিল। আমি ১৯৯১ সালে প্রথম সংসদ সদস্য হওয়ার পর আমার কাছে কি আবদার ছিল আমি পূরণ করতে সময় নিয়েছিলাম। সে অভিমানে তপ্ত হয়ে গিয়েছিল। ফেসবুক যোগাযোগ অভিমান-রাগের কারণটা জানতে পারলাম। আমি ১৯৯৪ সালে বিএনপিতে যোগ দিই। তখন আমার সব কাজ-কর্ম নির্বাচনী এলাকাভিত্তিক হয়ে পড়ে। আমরা দু’জন একপার্টিতে নেই কেন, সে উত্তরটা দাবি করলো ফেসবুক আলোচনায়।
সুনামগঞ্জ শহরে আমার একটা বিশাল আন্দোলন ভিত্তিক অতীত ছিল। ৬৯ গণঅভ্যুত্থান, গোপন কমিউনিস্ট পার্টির কাজ, সত্তরের নির্বাচন, ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ,স্বাধীনতার পর সোনার বাংলা গড়ে তোলায় আত্মনিয়োগ, ’৭২ সালে প্রকাশ্য কমিউনিস্ট পার্টির সুনামগঞ্জ জেলা কমিটির স¤পাদক হওয়া, ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৭৮ পর্যন্ত আত্মগোপন, আশির দশকে এরশাদবিরোধী আন্দোলন সব মিলিয়ে সুনামগঞ্জ শহরভিত্তিক বিশাল জনভিত্তি, কর্মী-সমর্থক গড়ে ওঠেছিল। কিন্তু এমপি হয়েই এই কর্মী-সমর্থক গোষ্ঠীরা একটা দূরত্ব অনুভব করতে থাকেন। এর মধ্যে আবু সুফিয়ান ছিল একজন। সংসদ কাজে অংশগ্রহণ, তদবির, উন্নয়নকর্ম, এলাকায় জন যোগাযোগ এইগুলোর ফলে সুনামগঞ্জের কর্মীদের সাথে গ্যাপ হয়ে যায়।
’৮০ দশকে ছাত্র ইউনিয়নের নেতা হিসেবে আমার সাথে একান্ত আন্তরিক হয়ে যায় আবু সুফিয়ান। ছাত্র ইউনিয়নের অগ্রসর নেতা-কর্মীকে কমিউনিস্ট পার্টি টার্গেট করতো এবং ট্রেনিং প্রশিক্ষণ এবং মটিভেশনের মাধ্যমে নেতৃত্ব ও আন্দোলন গুণাবলী গড়ে তোলার চেষ্টা করতো। আবু সুফিয়ান ছিল টার্গেট গ্রুপের একজন। আমার সাথে একটা পারিবারিক সম্পর্কের মতো করে চলতো। মিছিল-মিটিংয়ে আমার পাশেপাশে থাকতো। ভাল একজন সংগঠক ছিলো। মিছিলে, জনসভায়, প্রভাত ফেরীতে লোক জমায়েতের দক্ষতা ছিল। নিজে বক্তব্য না দিয়ে অন্যদের এগিয়ে দিত। আমার প্রতি ছিল একান্ত আনুগত্য।
আশির দশকে এরশাদ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে আবু সুফিয়ান ছাত্রনেতাদের মধ্যে একজন দুর্ধর্ষ কর্মীতে পরিণত হয়। এদের কয়েকজনকে ছাত্ররা ‘চার কুতুব’ ডাকতো। বাপ্টু, আবু সুফিয়ান, জালাল, মিসবাহ, জগলু, নাদের গং আরও কয়েকজন ছিল আন্দোলনের অগ্রসর অংশ। ১৯৮৪ সালে উপজেলা নির্বাচন বর্জনের ডাক দেওয়ায় ১৫দল, ৭দল, ৫দলীয় জোটের নেতা-কর্মী-সমর্থকরা এরশাদ স্বৈরাচারের সাথে তীব্র আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে। উপজেলা নির্বাচন নিয়ে সাহেব বাড়ির প্রার্থীর সাথে একটা সংঘর্ষ বেধে যায়। এতে উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী সাবেরীন (সম্ভবতঃ) সামান্য আহত হন। মামলা হয়। ‘বরুণ বাবুর কল্লা চাই, নজিরের কল্লা চাই’ স্লোগান নিয়ে শহরে একটা বীভৎস্য মিছিল হয়েছিল। আসলে সুফিয়ান গংরাই ছিল উপজেলা নির্বাচনের প্রতিহত করায় মিলিটেন্ট অংশ। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে শহরে ছাত্র-জনতার মিছিল সরগরম করে রেখেছিল। ওই সময়ে কমিউনিস্ট পার্টির সিদ্ধান্তে সারা হাওর অঞ্চলে ভাসান পানিতে মাছ ধরার দাবিতে তীব্র আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। অনেক হাওরে সংগ্রাম সশস্ত্র রূপ নেয়। আমি কমিউনিস্ট জেলা স¤পাদক সার্বক্ষণিক হউলটাইমার। আমার উপর ২টা আন্দোলনের সমন্বয়ের দায়িত্ব পড়ে। ভাসান পানিতে মাছ ধরার আন্দোলনে আমরা ১৫দলের সমর্থন ও সক্রিয় অংশগ্রহণ আদায়ে সমর্থ হই। ১৯৮৫ সালেই আমরা জেলায় আন্দোলনকারী শক্তি শহরের রাজপথ, গ্রামের মেঠোপথ এবং হাওরের জলরাশিতে আমাদের দাপট প্রতিষ্ঠিত করি। আমাদের সংঘবদ্ধ প্রতিরোধে টিকতে না পেরে পুলিশের সাহায্য নেয় ইজারাদাররা। সংঘবদ্ধ সুসংগঠিত জেলেরা হাওরে পুলিশের নৌকা ঘেরাও করে ওদের অস্ত্র সারেন্ডার করে। আমি দ্রুত এই সমস্ত জায়গায় গিয়ে মীমাংসা করে আসতাম।
১৯৮৫ সালের মে জুন হবে হয়তো তাহিরপুর উপজেলার শনির হাওর পাড়ে বিন্ননগর গ্রামে এই রকম একটি ঘটনা সামাল দিয়ে সুনামগঞ্জ আসার পরই একজন ডিএসবি খবর দিল আমার শালকরা নাকি ষোলঘর কোথায় পুলিশকে মারধর করেছে। শহর থমথমে। আমি মনে মনে ভাবলাম ওরা আমাকে আজ গ্রেফতার করতে পারে। গ্রেফতার এড়িয়ে চলতে আমার প্রতি নির্দেশ ছিল। আমি পারতপক্ষে রিকসায় দিনে চলাফেরা করতাম না। রাতে মোটর সাইকেলে চলতাম। বাসায় ঘুমাতাম না। ষোলঘর থেকে বাসার পর বাসা পেরিয়ে একেবারে আরপিননগর, তেঘরিয়া, বড়পাড়া পর্যন্ত হেঁটে আসতাম। ১৯৮৫ সালের আগে সাতবার আমি পুলিশ ঘেরাও থেকে বেরিয়ে আসি। আমি রাতে বাসায় খেতে আসলে আমার বড়কুটুমরা রাস্তায় পাহারা দিত। ষোলঘর রাস্তা পর্যন্ত ২/৩ জন মিলে পুলিশের গাড়ি আসছে কিনা “শব্দ বিনিময় পদ্ধতিতে” আমার কাছে খবর আসতো। তখন তো এখনকার মতো মোবাইল ছিল না। আমি তখন খাওয়া ফেলে পেছনের মাঠ (এখন বাসা-বাড়ি) দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যেতাম। দিনে ছাত্রনেতাদের নিয়ে জনাব আব্দুজ জহুর সাহেবের বাসায় আড্ডা দিতাম। দুপুরের খাওয়া হতো। পরবর্তী করণীয় ঠিক করতাম। জনাব জহুর সাহেবের বাসা থেকে পালাবার অনেক পথ ছিল। ২বার জহুর সাহেবের বাসায় পুলিশ হানা দিয়ে কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। আমাদের মিলিত হওয়ার নিরাপদ জায়গা ছিল জনাব দেওয়ান ওবায়দুর রেজা সাহেবের বাসা। ওখানে পুলিশ হানা দিত না। একটা সময়ে পুলিশ মিছিল নিয়ে রাস্তায়ই উঠতে দিত না। ছাত্ররা তখন ছোট ছোট বল্ডার জোগাড় করে। একদিন বাসস্ট্যান্ডে পুলিশের সাথে একটা ‘খণ্ড যুদ্ধ’ করে ফেলে। বল্ডারের শত শত খণ্ড পুলিশের উপর পড়তে থাকতো। পুলিশ ঐ দিন পিছিয়ে যায়। আমাদেরর পক্ষের কার যেন পা ভেঙে যায়। সম্ভতঃ নাম বাবুল। তারপর থেকেই ছাত্রদের মিছিলে হামলা পুলিশ এড়িয়ে যেত। ক্রমান্বয়ে আমাদের মিছিল বড় হতে থাকলো। রাজপথ মিছিলের দখলে চলে আসলো। একএকটা মিছিল ষোলঘর পয়েন্ট থেকে বাজার পয়েন্ট পর্যন্ত বিস্তৃত হতো।
১৯৮৫ সালের মে-জুনের ওই দিনেও আমরা জনাব আব্দুজ জহুরের বাসায় মিলিত হলাম। আবু সুফিয়ান বললো এইবার আপনি গ্রফতার হবেন। আমিও শহরের থমথমে ভাব লক্ষ করলাম। কিন্তু গ্রেফতার এড়াবার কোন তাড়া মন থেকে পেলাম না। ১৯৬৪ সাল থেকে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুর মানুষ আমি কিন্তু জেল জীবন দেখিনি। রাত সাড়ে ১১টায় ষোলঘরের একটি ছেলে অকারণে আমার বাসায় আসলো। ওকে আমি পুলিশের স্পাই হিসেবে জানতাম। তারপরও বাসায় ঘুমিয়ে পড়লাম। রাত ৩টার দিকে একজন লোক নজির ভাই নজির ভাই বলে ডাকতে শুনলাম। আমার ঘুম ভেঙে গেল। আমি জিজ্ঞেস করলাম কে? বললো বাপ্টু। তখন ছাত্র আন্দোলনের মিলিটেন্ট কর্মী। পুলিশের খাতায় শীর্ষ আন্দোলনকারীদের তালিকায় নাম। আমি ওদের বিশ্বাস করতাম। আমি প্রতারিত হলাম। দরজা খুলে দিলাম। থানার ওসি খপ করে লুঙ্গির মুঠিটা আঁকড়ে ধরলো। চার দিকে শতশত পুলিশ। আমি বললাম একটু শার্টটা গায়ে দিই। ঐ সময় আমার সহধর্মীণি সালমা আক্তার জেগে উঠেছেন। উনি শার্টটা এগিয়ে দিলেন। শার্টটি হাতে নিয়েই পুলিশের গাড়িতে উঠলাম। কেউ নাই আমি একা। মনটাতে কিছু শান্তি এলো। কাউকে আর গ্রেফতার করেনি। আসলে ওরা আগে আমাকেই পিক করে। উকিলপাড়া এসে বাপ্টুকে নিয়ে আসলো। পরে ওদের গাড়ি বাসস্ট্যান্ডে আরপিননগরের রাস্তার সামনে দাঁড় করিয়ে রাখলো। ১৫/২০ মিনিট পর আবু সুফিয়ানকে নিয়ে আসলো। আমার একটু তন্দ্রা এসে গিয়েছিল। সুফিয়ানের অট্টহাসিতে তন্দ্রা ভাঙলো। বললাম হাসছো যে…। বললো আসলগুলো ধরা পড়েছে। বললো আপনার সাথে জেলে যাচ্ছি ভারী মজা হবে। সত্যি তার কাণ্ড-কারখানা জেল জীবনটা উপভোগ্য করে তুলেছিল।
[লেখক বীর মুক্তিযোদ্ধা নজির হোসেন : সাবেক সংসদ সদস্য, সুনামগঞ্জ -১]

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com