:: এস ডি সুব্রত ::
লোকনাথ ব্রহ্মচারী ছিলেন একজন ধর্মগুরু। একজন মহাপুরুষ । তিনি ছিলেন একজন ধার্মিক ব্রাহ্মণ। কারো কারো মতে লোকনাথ বাবা ছিলেন জাতিশ্বর। জন্মাষ্টমী তিথিতেই জন্ম হয়েছিল লোকনাথ বাবার। তিনি পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার নিকটে উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার বারাসাত মহকুমার চৌরাশি চাকলা গ্রামে মতান্তরে কচুয়া গ্রামে ১৭৩০ সালের ৩১ শে আগস্ট বাংলা ১১৩৭ সালের ১৮ ভাদ্র জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম রামনারায়ণ ঘোষাল এবং মাতার নাম কমলা দেবী।
মহাজ্ঞানী গুরু ভগবান গাঙ্গুলী লোকনাথ ও বেণীমাধব উভয়ের আচার্য গুরু ছিলেন। ভগবান গাঙ্গুলী তাদের উপনয়ন কার্য সম্পন্ন করে তাদের নিয়ে গৃহত্যাগ করেন এবং কালীঘাটে গুরু তাদের শিক্ষাদান আরম্ভ করেন। সেখান থেকে পদব্রজে হিমালয়ের দিকে রওয়ানা হন। হিমালয়ের বরফাবৃত নির্জন স্থানে চলে লোকনাথ বাবার যোগসাধনা। ভগবান গাঙ্গুলী দেহত্যাগ করার পূর্বে বারানসীতে ত্রৈলঙ্গস্বামীর হাতে লোকনাথ ব্রহ্মচারীর ভার তুলে দেন। তখন লোকনাথ ব্রহ্মচারী ত্রৈলঙ্গস্বামীর কাছে যোগশিক্ষা গ্রহণ করেন। দীর্ঘ সাধনার পর ভ্রমণে বের হন। পশ্চিম দিকে আফগানিস্তান, মক্কা, মদিনা অতিক্রম করে আটলান্টিক মহাসাগর উপকূল পর্যন্ত গমন করেছিলেন। মক্কায় মুসলিমগণ তাকে শ্রদ্ধা করতেন। সেখানে আব্দুল গফুর নামে এক মহাপুরুষের দর্শন লাভ করেন এবং তার সংসর্গে কিছুদিন কাটান লোকনাথ বাবা। আফগানিস্তান, আরব দেশ, পারস্য , তুরস্ক , ইরান, ফ্রান্স ও সুইজারল্যান্ড ভ্রমণ শেষে ভারতে ফিরে আসেন। এরপর সুমেরু অঞ্চলে গমনের উদ্দেশ্যে বেণীমাধবকে সাথে নিয়ে প্রস্তুতি হিসেবে শৈত্যপ্রধান স্থান বদরিকা আশ্রমে অবস্থান করেন। পরে উত্তরে ভ্রমণ শেষ করে চীন দেশে যান। এরপর ফিরে এসে চন্দ্রনাথে যান। সেখানে কিছুদিন থেকে বেণীমাধব যান কামাখ্যায় এবং লোকনাথ ব্রহ্মচারী যান নারায়ণগঞ্জের বারদী গ্রামে। বারদীতে লোকনাথ ব্রহ্মচারী বারদীর ব্রহ্মচারী হিসেবে পরিচিতি পান। চন্দ্রনাথ পাহাড়ে শ্রীমৎ গোস্বামী হঠাৎ দাবানলের মধ্যে আটকে গেলে লোকনাথ বাবা তাকে উদ্ধার করেন। এক সময় লোকনাথ বাবা ত্রিপুরা জেলার দাউদকান্দি গ্রামে এক বৃক্ষের নিচে অবস্থান করেন। তখন তাকে কেউ কেউ পাগল ভাবত। একবার এক অপরাধী ডেঙ্গু কর্মকার যার মৃত্যুদণ্ড হওয়ার কথা ছিল সে বাবার কাছে গেলে বাবা বললেন তুই মুক্তি পাবি। পরদিন সত্যি সত্যিই ডেঙ্গু কর্মকার খালাস পান। তখন ডেঙ্গু কর্মকারের অনুরোধে বাবা বারদী গ্রামে যান। বারদীতে বাবাকে অনেকেই পাগল ও নিচু বলে ভাবত। সেখানে একবার কয়েকজন ব্রাহ্মণ গ্রন্থি দিতে গিয়ে পৈতাতে জট লাগিয়ে ফেললে খুলতে পারছিলেন না। সেদিন লোকনাথ ব্রহ্মচারী গায়ত্রী জপ করে জট খুলে দেন। ব্রাহ্মণগণ তখন বুঝতে পারেন যে তিনি কোন মহাপুরুষ হবেন নিশ্চিতভাবেই। লোকমুখে বাবার মাহাত্ম্য প্রচার হতে থাকে।
বারদীর জমিদার নাগ মহাশয় লোকনাথ বাবার পছন্দ অনুযায়ী জমি দান করে আশ্রম করে দিলেন। ক্রমে বারদীর আশ্রম তীর্থস্থানের মর্যাদা পেল। আশ্রমে দিন দিন ভক্তদের সমাগম বাড়তে থাকে। সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে জ্ঞানী গুণী ও রাজন্যবর্গ বাবার দর্শন ও আশীর্বাদ পেতে আসতে থাকেন, ঘরে ঘরে বাবার পূজা শুরু হয়। ঘরে ঘরে যে ছবিতে বাবার পূজা হয় সে ছবি তুলেছিলেন ভাওয়াল রাজা বাবার অনুমতি নিয়ে। ১৮৯০ ইং সালের ১ জুন বাংলা ১২২৭ সালের ১৯ জ্যৈষ্ঠ ১৬০ বছর বয়সে বাবা লোকনাথ দেহত্যাগ করেন। বাবা চলে গেলেন রেখে গেলেন তার অমর বাণী- “রণে বনে জলে জঙ্গলে / যখনই বিপদে পড়িবে / আমাকে স্মরণ করিও / আমিই রক্ষা করিব।” বাবা আরও বলেছেন- “যে কাজে মোহ আসে, তা যদি জানা থাকে, আসতে না দিলেই হয়।”
[লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক, সুনামগঞ্জ]