:: এস ডি সুব্রত ::
বর্তমান সভ্য পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি অভাব যে চেতনার সেটা হলো- ‘মানবতা’। বর্তমান বিশ্বের অন্যতম সমস্যা দেশে দেশে বিরাজমান ধর্মীয় কূপমণ্ডুকতা, সংকীর্ণতা। নিজ ধর্ম রক্ষার নামে অন্য ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানো এক বড় প্রবণতা হয়ে দেখা দিয়েছে দেশে দেশে। এ থেকে উত্তরণের যে উপায় সেটা হচ্ছে- ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা’। বাংলা সাহিত্যে যিনি সর্ব প্রথম সর্বমানবিক ও অসাম্প্রদায়িক মানসের প্রয়াস ও প্রকাশ ঘটিয়েছেন তিনি হলেন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের আসানসোলের চুরুলিয়া গ্রামে বেড়ে উঠা দুখু মিয়া অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। যার শিক্ষা জীবন শুরু হয়েছিল মাদ্রাসায় এবং জীবিকার তাগিদে মুয়াজ্জিনের কাজ করেছিলেন অল্প বয়সে। সেই নজরুল আমাদের কাছে অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতীক হয়ে দেখা দিয়েছিল কাজে কর্মে ও সাহিত্য সাধনায়। রুদ্ধ পরিবেশে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগে প্রগতিশীল চিন্তাধারার কবি নজরুল মানস গড়ে উঠেছিল নানা মুখী সৃজনশীলতায় বহুমুখী কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে। যেখানে ছিল মানবপ্রেম, দেশপ্রেম আর অসাম্প্রদায়িক চেতনা। তার দ্রোহের অগ্নিশিখায় জ্বলে উঠে ছিল বঞ্চিত মানুষ বজ্রশপথে। নিজেকে সর্বদা রেখেছেন জাতি ধর্ম বর্ণ ও সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে।
কাজী নজরুল ইসলামের আগে ও পরে কোন সাহিত্যিক সুস্পষ্টভাবে অসাম্প্রদায়িক চেতনার কথা উচ্চারণ করেন নি। তার কণ্ঠে ধ্বনিত হয়-
“এক রক্ত বুকের তলে
এক সে নাড়ীর টান
এক সে দেশের খাই গো হাওয়া
এক সে দেশের জল
এক সে মায়ের বক্ষে ফলাই
একই ফুল ও ফল।” ( সুর সাকী)
প্রবলভাবে মানবতা বাদ আর অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী নজরুলকে প্রতিভাষণ এ উচ্চারণ করতে শুনি-
“সুন্দরের ধ্যান, তার স্তব গানই আমার উপাসনা, আমার ধর্ম। যে ধর্মে যে দেশেই জন্মগ্রহণ করি সে আমার দৈব। আর আমি তাকে ছাড়িয়ে উঠতে পেরেছি বলেই আমি কবি।”
কবির বেড়ে উঠার সময়টাতে বেশ উত্থান-পতন চলছিল। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন, ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির আত্মপ্রকাশ, সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব কবিকে কখনো করেছে বিদ্রোহী, কখন সঙ্গীতপ্রেমিক, কখনো মানবপ্রেমিক। কবি বড় হওয়ার সময়টাতে দেখেছেন সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প কিভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল, রূপ নিয়েছিল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায়।
কবি কণ্ঠে ধ্বনিত হয়-
“মিথ্যা শুনিনি ভাই
এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোন
মন্দির কাবা নাই।” (মানুষ)
নজরুল বিদ্রোহ করেছেন ধর্মব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে, ধর্মের বিরুদ্ধে কখনো নয়। তিনি বার বার মানবধর্মের উপর জোর দিয়েছেন। হিন্দু মুসলমান কবিতায় তাকে বলতে শুনি-
“মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান
মুসলিম তার নয়নমণি হিন্দু তাহার প্রাণ।”
নজরুলের সত্তা জুড়ে ছিল অসাম্প্রদায়িক চেতনা, তার সংগ্রাম ছিল সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে। তিনি বিশ্বাস করতেন সকল ধর্মমতকে বিশ্বাস করা ধর্মহীনতা নয়। তার কণ্ঠে তাই আমরা শুনতে পাই-
“মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই
নহে কিছু মহীয়ান।”
দুই ভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে নজরুলের বেড়ে উঠা। ছোটবেলায় মোয়াজ্জিনের কাজ করে, মক্তবে পড়াশুনা করে যেমন ইসলাম ধর্ম স¤পর্কে জেনেছেন তেমনি লেটো গানের দলে যোগ দিয়ে জেনেছেন রামায়ণ মহাভারত ভাগবত পুরাণ সম্পর্কে। প্রমিলা দেবীকে বিয়ে করার পর তিনি হিন্দু (সনাতন) ধর্মের খুঁটিনাটি জেনেছেন। এজন্যই তিনি একহাতে লিখেছেন গজল আর ইসলামী সংগীত, অন্য হাতে লিখেছেন ভজন আর শ্যামা সঙ্গীত।
ইসলামী গান বা গজল–
“তোরা দেখে যা মা আমিনার কোলে
মধু পূর্ণিমার চাঁদ সেথা দুলে
যেন ঊষার কোলে রাঙা রবি দোলে।”
ঈদের সময় যে গানটি না শুনলে এক অপূর্ণতা যেন থেকে যায়।
“ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশির ঈদ….”
“ফিরে এল আজ মুহররম মাহিনা
ত্যাগ চাই , মার্সিয়া ক্রন্দন চাই না।”
ভজন বা শ্যামা সঙ্গীত লিখেছেন অত্যন্ত সুনিপুণ হাতে–
“কালো মায়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন
রূপ দেখে দেয় বুক পেতে শিব যার হাতে মরণ বাঁচন।”
নজরুল দেশ মাতৃকাকে যেমন ভালোবেসেছেন তেমনি ভালোবেসেছেন আপামর জনসাধারণকে। নজরুল ছিলেন ধর্ম বর্ণ গোত্র তথা সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে উঠা এক মানব প্রেমিক মানুষ। সনাতন (হিন্দু) ধর্মাবলম্বী প্রমিলা দেবী কে তিনি বিয়ে করেছিলেন কিন্তু ধর্মান্তরিত করেননি। মুসলিম সমাজ থেকে যখন প্রমিলা দেবী কে ধর্মান্তরিত করার দাবি উঠেছিল তখন নজরুল সে মতকে সমর্থন করেননি। এমন কি পরবর্তীতে তার সন্তানদের নাম রেখেছিলেন দুই ধর্মের মিলিত ঐতিহ্যকে ধারণ করে। তার প্রথম সন্তানের নাম রেখেছিলেন- কৃষ্ণ মুহাম্মদ। পর্যায়ক্রমে নাম রেখেছিলেন অরিন্দম খালেদ, কাজী সব্যসাচী, কাজী অনিরুদ্ধ। সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে উঠে নজরুল মানবতাকে স্থান দিয়েছেন সবার উপরে। তার আগে কেউ তার মতো দ্ব্যার্থহীন ভাষায় মানবতার জয়গান করতে পারেনি। তার অসাম্প্রদায়িক চেতনা এবং মানবপ্রীতি তাকে হিন্দু নয়, মুসলমান নয়, পরিণত করেছিল খাঁটি বাঙালিতে। নজরুল বিশ্বাস করতেন আনুষ্ঠানিক ধর্মে প্রবল বিশ্বাসী হয়ে সকল মানুষকে সমান চোখে দেখা যায় না, সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে উঠা যায় না। এ কারণেই তিনি জাতিভেদের মানবতাবিরোধী ভয়ংকর ভণ্ডামির স্বরূপ আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে পেরেছিলেন–
“বলতে পারিস বিশ্বপিতা ভগবান কোন সে জাত
কোন ছেলের তার লাগলে ছোঁয়া অশুচি হন জগন্নাথ?”
লালন ফকির দেখতে পেয়েছিলেন জাতিভেদের মানবতাবিরোধী চেহারা। জাতের নামে বজ্জাতির কথা নজরুলের মতো দ্ব্যার্থহীন ভাষায় আর কেউ বলতে পারেনি। হিন্দু আর মুসলিম ধর্মের ঐতিহ্যকে কাব্যে আর গানে একমাত্র নজরুলই তুলে ধরেছেন স্পষ্টভাবে। অসাম্প্রদায়িক চেতনার দীপ্ত শিখায় গোটা বাঙালি জাতিকে জাগাতে চেয়েছিলেন নজরুল। তাই তো তিনি আহ্বান জানিয়েছিলেন–
“একবার গণ্ডি কাটিয়া বাহিরে আসিয়া বলো যে
তুমি ব্রাহ্মণ নও, শুদ্র নও, হিন্দু নও, মুসলমান নও
তুমি মানুষ …… তুমি সত্য।।”
রক্ষণশীল সামাজিক চেতনাহীন কতিপয় মুসলমান যেমন তাকে কাফের বলে আখ্যায়িত করেছিল তেমনি কট্টরপন্থী হিন্দুরাও নানাভাবে নজরুলকে আক্রমণ করেছিল।
বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে নজরুল বলেছেন- এ সাহিত্য হিন্দু মুসলমান সকলের। তিনি বলেছেন হিন্দু দেবদেবীর নাম দেখে মুসলমানের রাগ করা যেমন অন্যায় তেমনি দৈনন্দিন জীবন যাপনের প্রচলিত মুসলমানী শব্দ দেখে ভ্রু কোচকানো হিন্দুদের অন্যায়। তিনি বলেছেন আমি হিন্দু মুসলমান এর গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করে ঐক্য গড়ার চেষ্টা করেছিলেন।
কাণ্ডারী কবিতায় লিখেছেন–
“হিন্দু না ওরা মুসলিম?
ঐ জিজ্ঞাসে কোনজন?
কাণ্ডারী বল ডুবিছে মানুষ
সন্তান মোর মা’র।”
মানুষ কবিতায় কবি ধর্মান্ধদের উদ্দেশ্য করে বলেছেন-
“মিথ্যা শুনিনি ভাই
হৃদয়ের চেয়ে বড় কোন
মন্দির কাবা নাই”
স্রষ্টাকে পাওয়ার ক্ষেত্রে কবির কণ্ঠস্বর এরকম–
“শাস্ত্র না ঘেঁটে সখা
ডুব দাও সত্য সিন্ধু জলে।”
হিন্দু মুসলিম দাঙ্গার মধ্যেও তিনি পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচন আর অসাম্প্রদায়িক ছবি এঁকেছেন আর দেশপ্রেমের কথা তুলে ধরেছেন।
“যে লাঠিতে আজ টুটে গম্বুজ
পড়ে মন্দির চুড়া
সে লাঠি কাল প্রভাতে
করিবে শত্রু দুর্গ গুঁড়া।”
মুসলিম মধ্যবিত্ত সমাজের সম্ভাবনা কবি মানসে দারুণভাবে প্রভাব ফেলেছিল তথাপি কবি চিন্তা করেছিলেন শোষণমুক্ত সুষম অসাম্প্রদায়িক সমাজের। রাজনৈতিক ইন্ধনে হিন্দু মুসলমান সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বে কবি সম্প্রীতির স্বপ্ন দেখেছিলেন, চেয়েছিলেন মানুষের মুক্তি।
অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উজ্জীবিত কবি প্রলয় শিখায় মনোভাব ব্যক্ত করেছেন এভাবে-
“ভাঙ্গি মন্দির ভাঙ্গি মসজিদ
ভাঙ্গিয়া গির্জা গাহি সঙ্গীত
এক মানবের একই রক্ত মেশা
কে শুনিবে আর ভজনালয়ের হ্রেষা।”
ধর্মগ্রন্থ আর উপাসনালয়ের চেয়ে তার কাছে বড় হয়ে উঠেছিল মানুষ। তাইতো কবি মানুষ কবিতায় বলেছেন–
“…আদম দাউদ ঈসা মুসা ইব্রাহীম মুহাম্মদ
কৃষ্ণ বুদ্ধ নানক কবির.. বিশ্বের স¤পদ
….. কাহারে করিছ ঘৃণা তুমি কাহারে মারিছ লাথি?
হয়তো উহারই বুকে ভগবান জাগিছে দিবারতি!”
নজরুল স্বপ্ন দেখেছিলেন বৈষম্যহীন অসাম্প্রদায়িক সমাজের। তার কণ্ঠে তাই তো ধ্বনিত হয়েছিল–
“গাহি সাম্যের গান
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সমস্ত বাধা ব্যবধান
যেখানে মিশেছে হিন্দু বৌদ্ধ মুসলিম খ্রীশ্চান।”
জন্ম-মৃত্যু নিয়ে কবি নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন এভাবে–
“একই দেশের মাটিতে যাই
কেউ গোরে কেউ শ্মশানে ঠাঁই
মোরা এক ভাষাতে মাকে ডাকি
এক সুরে গাই গান।”
হিন্দু মুসলিম আর দেশের ঐক্যের তরে কবিকে বলতে শুনি—
“হিন্দু মুসলিম দুটি ভাই
ভারতের দুটি তারা
একই বাগানে দুটি তরু দেবদারু আর কদমচারা।”
ছদ্মবেশী মোড়ল মোল্লা আর ভণ্ড সাধুদের প্রতি ক্ষুব্ধ নজরুল বলেছেন–
“শিহরি উঠো না, শাস্ত্রবিদেরে, করো নাক বীর ভয়
তাহারা খোদার খোদ প্রাইভেট সেক্রেটারি তো নয়
সকলের মাঝে প্রকাশ তাহার সকলের মাঝে তিনি
আমারে দেখিয়া আমার অদেখা জন্মদাতারে চিনি।”
উঁচু নিচু জাত বলে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা যে ধুয়া তুলেছেন তার বিরুদ্ধে তিনি বিষোদগার করেছেন–
“জাতের নামে বজ্জাতি সব জাল জালিয়াতি খেলছ জুয়া
ছুলেই তোর জাত যাবে? জাত ছেলের হাতের নয়তো মোয়া
ভগবানের ফৌজদারি কোর্ট নাই, সেখানে জাত বিচার
পৈতে টিকি টুপি টোপর সব সেথা ভাই একাকার।”
বর্তমান বিশ্বের চলমান সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বৃদ্ধির যে প্রবণতা তা থেকে মুক্তি পেতে নজরুলের অমর বাণী সমৃদ্ধ কবিতা পাঠের আর গান শ্রবণের বিকল্প নেই।
আজো আমরা নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনা, মানবতাবোধ বিদ্রোহী চেতনায় নিত্য আলোড়িত হই। সাম্য মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে নজরুলকে অনুভব করি। নজরুল আমাদের প্রেরণা, নজরুল আমাদের সত্তায়, মননে।
[লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক, সুনামগঞ্জ]