:: অ্যাড. মলয় চক্রবর্তী রাজু ::
একটি বিদেশী গল্পে আছে, “এক লোক তার প্রতিবেশীকে ঈর্ষান্বিত হয়ে খুন করে। কারণ, ঐ লোকটি খুবই মহৎপ্রাণ ছিলেন। তাঁকে শহরের সবাই ভালবাসতো, শ্রদ্ধা করতো। লোকটি ভেবেছিল তাঁকে মেরে ফেললেই সবাই তাঁকে ভুলে যাবে। কিন্তু লোকটিকে হত্যা করার পর শহরের মধ্যস্থানে তাঁর মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হল। শহরের শিশু থেকে বৃদ্ধ তাঁর মূর্তিতে প্রতিদিন ফুল দেয়া শুরু করলো। একদিন লোকটি দেখতে পেল তার স্ত্রী সেই ভিড়ে মহৎপ্রাণ লোকটির মূর্তিতে ফুল দিচ্ছে। বাসায় ফেরার পর লোকটি তার স্ত্রীকে রেগেমেগে বললো, কোথায় গিয়েছিলে? স্ত্রী বললো দেবতার পায়ে ফুল দিতে। লোকটি আরও উত্তেজিত হয়ে বললো, ও’তো দেবতা নয়, মানুষ। স্ত্রী খুব শান্তভাবে বললো, ‘আগে মানুষ ছিলেন, এখন তিনি দেবতা’।
এ গল্পটি পৃথিবীর যে ক’জন মহান মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়, তাঁদের একজন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। সেই খোকা থেকে জাতির পিতা, তার জীবনটাই যেন বাঙালির অধিকার আদায়ের চূড়ান্ত ক্ষণ। টুঙ্গীপাড়া থেকে ৩২ নম্বর, মুজিব ছিলেন আপাদমস্তক উন্নত এক বাঙালি।
কোনকিছুই তাকে তার সেই পরিচয় থেকে সরিয়ে দিতে পারেনি। বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী সর্বশেষ ২৫ মার্চ তার নিজ ঘর ৩২ নম্বরে বা এরপরে পাকিস্তানি কারাগারে চোখের সামনে কবর খুঁড়েও তাঁকে তাঁর বিশ্বাস থেকে টলাতে পারেনি। মানুষের ভালবাসা তিনি পায়ে মাড়াননি, সারাজীবন মাথায় রেখেছেন। তাইতো ১৫ আগস্ট যখন তাঁকে হত্যা করা হয়, শোকে সারাদেশ স্তব্ধ থাকলেও শোকপ্রাচীর বাঙালির বুকের ভিতরে রচিত হচ্ছিল। যে প্রাচীর হাজার বছরের বাঙালি জাতিকে হতাশা আর ভেঙে পড়া থেকে বাঁচিয়ে রেখেছে। সেই বাঙালি সংস্কৃতির প্রাচীর সবধরনের বিরুদ্ধবাদিতাকে ঠেলে দিয়ে ঠিকই আলোময় আকাশের নিচে দাঁড় করিয়েছে এ জাতিকে। শুরু হয়েছে নতুনভাবে, নতুন আশায় পথচলা।
আব্রাহাম লিংকন বা মহাত্মা গান্ধী অথবা নাসের প্রমুখ, তাঁদেরকেও একইভাবে হত্যা করা হলেও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। লিংকনকে হত্যার পর আমেরিকাতে দাসপ্রথা ফিরে আসেনি বা মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করে মৌলবাদিরা সমাজ, রাষ্ট্রকে কব্জা করতে পারেনি। গণতন্ত্র আরও শক্ত ভিত্তি করে নিয়েছিল, সে দেশের নাগরিকরা তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়ে আর মহান নেতাদের আদর্শে আরও বেশি করে উজ্জীবিত হয়। কিন্তু বাংলাদেশের ঘটনাপ্রবাহ ঠিক সেভাবে প্রবাহিত হয়নি, হতে দেয়নি। গণতন্ত্র তো বটেই, বাঙালির লালিত স্বপ্ন ‘একটি সেক্যুলার দেশের কনসেপ্টে’ই আঘাত করা হয়। আবার আমদানি শুরু হয় পাকিস্তানি জঞ্জাল। আসে জিন্দাবাদ, গোলাম আযম, আর্মির শাসন ইত্যাদি।
দশচক্রে ভগবান ভূতের মত চার বছর আগের কিছু মুক্তিযোদ্ধা আবার ভোল পাল্টে পাকিস্তানি ভাবধারায় চলার চিন্তা করতে শুরু করেন। কেউ কেউ আগ বাড়িয়ে ১৯৭১’র সেক্টর কমান্ডার জিয়াউর রহমানের সাথে লাইন দিয়ে হাত মেলান। শুধু বাংলার জনগণ, যারা সারাজীবনই মুক্তিযুদ্ধে ব্যাপৃত আছেন কোন বিশেষ সময়ের (যেমন ১৯৭১) জন্য নয়, তাঁরা হিমালয়ের মতো অটল রইলেন। সহ্য করলেন প্রো-পাকিস্তানিদের অমানবিক শারীরিক-মানসিক নির্যাতন। ৭৫ এর ১৫ আগস্ট থেকে ৯৬’র জুন পর্যন্ত বাঙালি এ নির্যাতন নীরবে (মাঝে মাঝে প্রতিবাদী হয়ে উঠলেও) সহ্য করে। তারপর বাংলাদেশের রাজনৈতিক আকাশে সূর্যের আলো প্রস্ফুটিত হতে লাগলো।
বঙ্গবন্ধুর দেহকে হত্যা করলেও তিনি আরও শক্তিশালী হয়ে জেগে থাকলেন বাঙালির মনে। তিনি অমরত্ব পেলেন। বার বার গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতার দিকে বাঙালিকে ধাবিত করলেন। প্রবল প্রতিপক্ষ আর কালবেলা এ দেশের মানুষকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন, যা এই জাতির হৃদয়ের আকাক্সক্ষা, তা থেকে বিরত রাখতে পারেনি।
আমেরিকা, ভারত বা মিশরের কিছু মানুষ তাঁদের মহান নেতাকে হত্যা করায় আনন্দিত হলেও রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য পায়নি। কোন দেশেই তাদের রাষ্ট্রীয় নেতাদের এভাবে মৃত্যুর পর অবমাননা করা হয় না। কিন্তু বাংলাদেশে প্রশাসন যন্ত্র হত্যাকারীদের করায়ত্বে চলে গেলে পাকিস্তানি-তালেবানি বিভিন্ন ধরনের পশ্চাৎমুখী ভাবধারা চালু করার চেষ্টা চলে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নামই যেন প্রচণ্ড বাধা হয়ে দাঁড়ায় এসবের বিরুদ্ধে। যদি সেদিনের কথা আমরা মনে করি, সেই ৭৫ এর ১৫ আগস্ট। যেদিন ১০ বছরের শিশু রাসেলসহ পরিবারের সবাইকে হত্যা করা হল। এরপর বঙ্গবন্ধুর ভাবধারায় অনুপ্রাণিত চার নেতাসহ অগণিত নেতা-কর্মীরাও হলেন পাষণ্ডদের রক্ত নিয়ে হোলি খেলার শিকার। বঙ্গবন্ধুর নামোচ্চারণ তখন ছিল অপরাধ। নির্লজ্জ কিছু বুদ্ধিজীবী বাংলাদেশের ইতিহাসকে পাল্টে দেবার চেষ্টায় রত হলেন। নিজের হাতে গড়া দলও বঙ্গবন্ধুর স্নেহের নেতৃবৃন্দের হাতে পড়ে দিকহীন রাজনীতির পথে পা’ বাড়াতে শুরু করে। হতবিহ্বল জাতিকে সঠিক পথের নির্দেশনা না দিয়ে তারা ভাগবাটোয়ারার রাজনীতিতে নামলেন। তারপরও মুছে যাননি মুজিব, জাতির পিতা। তিনি স্বমহিমায় বিরাজিত বাঙালির মনে। তাঁর স্বপ্ন, আদর্শকে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে এ দেশ। কিন্তু বাঙালির বিকাশের পথে পরাজিত শক্তিরা এখনও বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ধর্মব্যবসায়ী পাকিস্তানি আদর্শের ধারায় এখনও তারা সহনশীল বাঙালির সংস্কৃতি বিনষ্ট করতে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির প্রসার ও প্রচারে তাদের আত্মঘাতী কাজের ফলভোগ করছে সমস্ত বাঙালি জাতি। বিশ্বের মানচিত্রে একটি উন্নত জাতি হিসেবে নিজেদের উপস্থাপিত করতে এ জাতি তাই বারে বারেই পিছিয়ে পড়ছে। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস, বঙ্গবন্ধু, ১৯৭১ অর্থাৎ এ জাতির অস্তিত্বের মূলে কুঠারাঘাত করে যাচ্ছে এরা। আঘাত করছে বাঙালির আবেগকে। বাঙালির স্বাধীনতা দিবসকে জাতীয় দিবস হিসেবে পালন, জাতীয় শোক দিবসে পতাকা অর্ধনমিত না রাখা, এ দিনে নেত্রীর জন্মদিন পালন করা, নববর্ষে বোমা মারা ইত্যাদি পাকিস্তানি কায়দায় হৃদয়হীন হিংস্র কর্মকাণ্ডে এ জাতিকে করেছে লজ্জিত। এ ধরনের কাজ করার অন্তর্নিহিত অর্থই বাঙালি, বাংলাদেশ আর মুজিবকে ধ্বংস করার নিষ্ফল প্রক্রিয়া। জাতি হিসেবে আমরা বাঙালি, বাংলাদেশ আমাদের দেশ আর এই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এগুলি ধ্রুব সত্য। বঙ্গবন্ধু এই জাতির অস্তিত্বের সাথে মিশে রয়েছেন। তাই তারা বঙ্গবন্ধু- তাঁর আদর্শকে বাঙালির মন থেকে সরিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। কারণ তারা জানে বঙ্গবন্ধু না থাকলে বাংলাদেশ হতো না, বাঙালি জাতি তাঁর আত্মপরিচয় খুঁজে হয়রান হয়ে যেতো; তাই বঙ্গবন্ধুর অবিনশ্বরতাকে ধ্বংস করতে তারা মূর্খের মত চালাচ্ছে অপপ্রচার। কিন্তু আত্মরক্ষার চেষ্টায় বাঙালি কখনো পিছপা হয়নি, হবেও না। ১৫ কোটির এ দেশে বঙ্গবন্ধু এখনো মহান নেতা, পথপ্রদর্শক, সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হয়ে চিরজীবী আছেন, থাকবেন।
‘পৃথিবীর থেকে আকাশ বড়, আকাশের থেকে বড় সূর্য-তারা, সূর্যের থেকেও অনেক বড় শাশ্বত বাঙালির স্রোতের ধারা। এই স্রোতের ধারা একদিন উন্নত পৃথিবীর মহাসাগরে সগৌরবে মিলিত হয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা করবে, তা নিশ্চিত।
[লেখক : অ্যাডভোকেট মলয় চক্রবর্তী রাজু, সাধারণ সম্পাদক, সুনামগঞ্জ পৌর আওয়ামী লীগ]