1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
  3. [email protected] : wp-needuser : wp-needuser
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:৩৬ পূর্বাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

পর্ব ২ : জুবিলীর স্মৃতি ও আমাদের সময়

  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ১০ আগস্ট, ২০২১

:: অধ্যাপক (অব.) ডা. সৈয়দ শহীদুল ইসলাম ::
জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয় নিয়ে গত পর্বের লেখাটি পড়ে অনেকের ভালো লেগেছে। তারা ওই সময়ের কথা আরও জানতে চান। তাই যেগুলো আগে বাদ দিয়েছিলাম ওইগুলো আজ তুলে ধরবো।
আমাদের বাসাটা সোনাখালী পুলে ওঠার আগে হাতের বামদিকের বাসাটা। বাসাটা যথেষ্ট বড়। বাসার ভেতর একটা পুকুর আছে। পুকুরটা বেশ বড়, ঘাটও আছে। ঘাটটা ভেঙে গেছে। পুকুরটা আমরা ভরাট করিনি, পুরাতন ঐতিহ্য হিসেবে রেখে দিয়েছি। আমরা যখন বাসায় উঠি তখন আমাদের এলাকায় কারেন্ট আসেনি। আমাদের লেখাপড়া হারিকেনের আলোতে করতে হত। আমি সাধারণ হারিকেনের পরিবর্তে টেবিলল্যাম্প ব্যবহার করতাম। টেবিল ল্যাম্পের আলোটা আমার কাছে স্নিগ্ধ মনে হতো। গরমের সময় উঠানে চাটাই বিছিয়ে পড়তে বসতাম, অনেক রাত পর্যন্ত পড়তে হতো। তখন অনেকের অবস্থা আমার মতো ছিল। এখনকার প্রজন্মতো এয়ারকন্ডিশনে বসে পড়ে। হারিকেন তারা দেখে নাই, আমার মনে হয় কয়েকটা সংরক্ষণ করে রাখলে দেখাতে পারতাম। এই প্রতিকূল পরিবেশে থেকেও অনেকে পরবর্তী জীবনে জুবিলীর নাম উজ্জ্বল করেছেন। কবি মোহাম্মদ সাদিক (অব. সচিব), রুমী (বিচারপতি), মরহুম ডা. আ. নুর (অবসরপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন), ডা. ইশতেয়াকুল হক জালালী (বিশিষ্ট চিকিৎসক), মরহুম আতহারুল ইসলাম প্রমুখ।
আমাদের স্কুলটাইম ছিল ১০টায়। সকাল ৯টার দিকে ভাত খেয়ে স্কুলে রওয়ানা করতাম। তখন এতো বাহারি নাস্তার ব্যবস্থা ছিল না, বড়জোর চিড়া বা মুড়ি। স্কুলের পোশাক ছিল সাদা পাজামা, সাদা হাফ শার্ট। মেয়েদের ছিল সাদা সালোয়ার, সাদা কামিজ, ওড়না। সকালবেলা সবাই যখন বের হতো মনে হতো সাদা বকের মিছিল। সবাই হেঁটে যেত। দূরের যারা তারা লঞ্চে আসতো। পাক ওয়াটার ছাত্রদের জন্য ফ্রি ছিল, বাসে হাফ ভাড়া। মেয়েদের চলাচলে অসুবিধা ছিল না। ইভটিজিংয়ের ব্যাপারটি ছিল না, তবে দুই একটা দুষ্টুলোক যে ছিল না তা বলা যাবে না। মেয়েরাও অযথা বাইরে ঘোরাঘুরি করতেন না, গেলেও সংযতভাবে চলাফেরা করতেন।
সময় এগিয়ে চলছিল। ক্লাস সিক্স বা সেভেন পড়ছি এমন সময়ে শোনা গেল ডি.সি সাহেব সুনামগঞ্জ ভিজিট করতে আসবেন। আগে কিন্তু সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ মিলিয়ে একজন ডি.সি থাকতেন। বিশাল এরিয়ার প্রশাসক। এরা সি.এস.পি অফিসার, চৌকস আর দাপটে। সরকারের কাছে এদের অনেক দাম ছিল। ডি.সি সাহেব স্টিমারে আসবেন। ডি.সিদের নিজস্ব স্টিমার থাকতো। যেদিন আসার কথা ঐদিন দুপুরের দিকে লঞ্চঘাটে উনার স্টিমার ভিড়ল। উনাকে সংবর্ধনা দেয়ার জন্য কিছু লোক জোগাড় করা হল। স্কুলের কিছু ছাত্রদেরও নেয়া হলো। এসব কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন মরহুম আব্দুল ওয়াদুদ। লক্ষণশ্রী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন। ডিসি সাহেব জিন্দাবাদ স্লোগান দিতে দিতে উনাকে পাবলিক লাইব্রেরিতে নেয়া হলো। সরকারি কর্মকর্তা গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। মানপত্র পাঠ করা হল। ওয়াদুদ সাহেবই মানপত্র পাঠ করলেন। সুনামগঞ্জের বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরা হলো। একটি সমস্যার কথা মনে আছে। সুরমা নদী খননের দাবি করা হয়েছিল, যে কাজটি সম্ভবত এখনো হয়নি। কারণ তখন সুনামগঞ্জে খুব ঘনঘন বন্যা হত, এক বছর পরপর। নদী খনন করলে বন্যার প্রভাব কমতে পারে। এখন তো কোনো সমস্যা নাই। তখন অবশ্য সুনামগঞ্জে এতো বৃষ্টি হতো, এখন কল্পনাও করা যাবে না। একবারের বৃষ্টি কথা আমার মনে আছে, ১৬দিন আমরা সূর্যের মুখ দেখিনি।
আর একবার স্কুল থেকে আমরা গেলাম শিক্ষাসফরে। কোন জায়গায় গিয়েছিলাম জায়গাটা মনে করতে পারছিলাম না। বন্ধুবর কামরুজ্জামানদারকে ফোন করলাম বলল মনে হয় ফেঞ্চুগঞ্জ। সভার স্মৃতি ঝাপসা হয়ে আসছে। আঃ বারী স্যার আমাদের সঙ্গে যাবেন। ফেঞ্চুগঞ্জ সরাসরি যাওয়া যাবে না। সিলেট গিয়ে একরাত থেকে তারপর যেতে হবে। সুনামগঞ্জ থেকে সিলেট যেতে তখন ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা লাগত। সিলেট পৌঁছতে পৌঁছতে আমাদের সন্ধ্যা হয়ে গেল। একটা হোটেলে থাকার ব্যবস্থা হল। সন্ধ্যার পর খাওয়া-দাওয়া করে স্যার নিজের রুমে চলে গেলেন আমাদেরকে রুমে থাকতে বলে। রাতে দেখা গেল কেউ রুমে নেই। সবগুলো চুরি করে সিনেমায় চলে গেছে। শুধু আমরা দুজন হোটেলে রয়ে গেলাম, আমি আর আঃ হাকিম ভাই।
হাকিম ভাই আমার ক্লাসমেট ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আমি ওকে হাকিম ভাই ডাকতাম, ও আমাকে মোল্লা ডাকতো। আমাদের বেশ খারাপই লাগলো, হিংসাও হল। ওদেরকে জব্দ করতে ইচ্ছা হলো। স্যারকে ঘটনা বললাম। স্যার বললেন- সকালে ব্যাপারটা দেখবেন। সকালবেলা স্যার ডাকলেন, রাতের ঘটনার জন্য খুব বকাঝকা করলেন। সবাইকে কানে ধরে উঠবস করালেন। আজকাল শিক্ষকরা কি এটা পারবেন! আমরা একটু তৃপ্তি পেলাম। এরপর কিভাবে ফেঞ্চুগঞ্জ গেলাম, কিভাবে সুনামগঞ্জ ফেরত আসলাম তেমন কিছুই মনে নাই।
আমাদের এক সহপাঠী ছিল নিরঞ্জন। থানায় থাকত। ওর মামা ছিলেন থানার সেকেন্ড অফিসার। মামার বাসায় থেকে পড়াশোনা করতো। পরীক্ষার খাতা দিলে আমাকে খবর দিতেন। আমার খাতা দেখে খুব খুশি হতেন, মিষ্টি খাওয়াতেন, আমার জন্য দোয়া করতেন। আরো ভালো করার জন্য ওকে বকাঝকা করতেন। আগে থানা এখনকার মতো এত ব্যস্ত থাকত না, এত ঝুটঝামেলা ছিল না। থানার লোকজনের এতো দাপট ছিল না, অনেকটা সাধারণভাবে থাকতেন। প্রশাসনে এস.ডি.ও সাহেব ছিলেন প্রধান। উনার নেতৃত্বে প্রশাসন চলত। আমি যখন ভর্তি হই তখন এস.ডি.ও ছিলেন আঃ মুত্তালিব সাহেব। ওনার ছেলে মানিক ছিল আমার সহপাঠী। উনার পরে আসেন মোকাম্মেল সাহেব তারপর আসেন এ.জেড.এম শামসুল আলম। উনি সি.এস.পি অফিসার ছিলেন। সি.এস.পি পাস করে সুনামগঞ্জেই প্রথম পোস্টিং। সি.এস.পিরা মেধাবী, স্মার্ট, কর্মঠ হতেন। উনি আসার পর প্রশাসনে কর্মচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। উনি একজন ব্যতিক্রমধর্মী মানুষ ছিলেন। সম্ভবত উনি এখনো জীবিত আছেন। উনি রীতিমত সালাত আদায় করতেন, প্রায়ই কোর্ট মসজিদে নামাজ পড়তেন। তিনি ইসলামী জ্ঞানের চর্চা করতেন। ইসলাম পরিবার পরিকল্পনা নামে একটি পুস্তিকা রচনা করেছিলেন।
আগেই বলেছিলাম সুনামগঞ্জে প্রায় প্রতি বাসার সামনে একটা ডোবা থাকতো, তাতে কচুরিপানা জমতো। এস.ডি.ও সাহেবের সরকারি বাংলার পাশে একটা বড় ডোবা ছিল। একদিন সকালবেলা দেখি এস.ডি.ও সাহেব লুঙ্গি মালকোঁচা দিয়ে পড়েছেন, গায়ে একটা সাদা গেঞ্জি। ডোবা পরিষ্কার করতে নেমেছেন। এস.ডি.ও সাহেব নেমেছেন সাথে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গণ্যমান্য ব্যক্তিরা ডোবা পরিষ্কার করতে নামলেন। শহরের সব ডোবা পরিষ্কার করার নির্দেশ দিলেন। উনি মামলা মোকাদ্দমা পছন্দ করতেন না, সালিশ করার পরামর্শ দিতেন। মাঝে মাঝে ঘোড়ায় চড়ে থানায় চলে যেতেন, মামলা নিষ্পত্তি করে দিয়ে আসতেন। এতে অবশ্য আইনজীবীরা উনার উপর বেশি খুশি ছিলেন না।
একবার সুনামগঞ্জের দুজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে খুঁজে বের করলেন উনাদের সম্মাননা দিবেন। একজন হচ্ছেন ফজলুল হক শেলবর্ষী। উনি রাজনীতিবিদ। পাকিস্তান আন্দোলনের কর্মী। শপথ করেছিলেন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত বিয়ে করবেন না। পাকিস্তান ঠিকই প্রতিষ্ঠা করলেন কিন্তু ততদিনে ওনার বিয়ের বয়স চলে যায়, জীবনে আর সংসার করা হয়নি। আর একজন দোহালীর সাহিত্যিক ছিলেন। ওনার নাম ভুলে গেছি। সম্ভবত আবদুল ওয়াহিদ। নতুন ধরনের কাজ করা উনার শখ ছিল। আর একবার আমাদের স্কুলের মেট্রিক পরীক্ষার্থীদের সংবর্ধনা দেন। এই কাজটি আর কেউ করেনি। এটাই প্রথম, এটাই শেষ। উনার দীর্ঘায়ু এবং সুস্থতা কামনা করি।
রাজনৈতিক অবস্থা কেমন ছিল? :
দেশে সামরিক শাসন থাকলেও বোঝার উপায় ছিল না। মিছিল-মিটিং, সভা-সমিতি নিয়মিত চলত। পুরাতন কলেজ প্রাঙ্গণে ছিল রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র। বিভিন্ন দল এখানে জনসভার আয়োজন করত। একদল আরেক দলের সমালোচনা করত আবার মিটিং শেষে একত্রে বসে চা খেতে। সবার মাঝেএকটা সৌহার্দ্য ছিল। তখন পার্টি ছিল আওয়ামী লীগ, মোজাফফর ন্যাপ, ভাসানী ন্যাপ, জামাতে ইসলামী। এত ধড়পাকড় ছিল না। কেউ গ্রেফতার হলে রাজবন্দী হত। রাজবন্দীদের একটা বিশেষ সম্মান ছিল আমরা স্বাধীন দেশে দিতে পারলাম না। তখনকার একটা সুন্দর স্লোগান ছিল- রাজবন্দীদের মুক্তি চাই। এখন শোনা যায় না। রাজনীতি ছিল তখন ত্যাগের। রাজনীতি করে কেউ বিরাট বাড়ি-গাড়ির মালিক হয়েছেন খুব একটা শোনা যেত না বরং রাজনীতি করে দরিদ্র হয়েছেন। এই প্রসঙ্গে একজন লোকের কথা উল্লেখ না করলেই নয়। তিনি হচ্ছেন সুনামগঞ্জের কৃতীসন্তান জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব জনাব বরুণ রায়। জমিদারের সন্তান ছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টি করতেন। নিজের সব স¤পত্তি বিলিয়ে দিয়েছিলেন। দরিদ্র জীবন যাপন করতেন। উনার উপর হুলিয়া থাকতো। হুলিয়া অবশ্য আমরা তখনতো বুঝতাম না।
পুরাতন কলেজ বিল্ডিংয়ের নিচতলায় কয়েকটা দোকান ছিল। এর মাঝে ছিল ইউনুস ভাইয়ের ইসলামিয়া লাইব্রেরি। ওখানে আমরা বিকালবেলা প্রায়ই আড্ডা দিতাম। পত্রিকা পড়ার লোভে যেতাম। তখন এতো পত্রিকা পাওয়া যেত না। সকলের পক্ষে পত্রিকা রাখা সম্ভব ছিল না। আমরা বিভিন্ন বিষয়ে তর্কবিতর্ক করতাম। আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু থাকতো সমাজতন্ত্র, পুঁজিবাদ, ইসলাম অর্থাৎ জ্ঞানভিত্তিক আলোচনা হতো। তর্ক-বিতর্ক করে চা খেয়ে ঘরে ফিরতাম। এখন এটা অকল্পনীয়।
এখানেই শেষ করছি। আমার স্মৃতিচারণের মাধ্যমে ঐ সময়ের চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। যারা অতীতকে জানতে চান তারা হয়তো কিছুটা উপকৃত হবেন।

 

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com