1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
  3. [email protected] : wp-needuser : wp-needuser
বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০১:৪০ পূর্বাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

কারখানায় আগুন লাগে কেন?

  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ৩ আগস্ট, ২০২১

:: পাভেল পার্থ ::
নিমতলীর রাসায়নিক বোঝাই গুদামঘর থেকে সেজান জুস কারখানা। একের পর এক প্রশ্নহীন আগুন। নিমেষেই অঙ্গার টাটকা জীবন। চুরমার সংসার, বিশৃঙ্খল পরিবার। এভাবে দেশীয় কারখানাগুলোয় একের পর এক আগুন লাগে কেন? আর আগুন লাগলে এসব কারখানায় এত শ্রমিক মরে কেন? কারখানাগুলোর নির্মাণশৈলী, অগ্নিনির্বাপণসহ সামগ্রিক নিরাপত্তা এত দায়সারা কেন? তার পরও এসব কারখানায় ‘আসল’ জুস তৈরি হয় কিংবা ওয়ালমার্টের দোকানে বিক্রির জন্য বাহারি টি-শার্ট। করপোরেট কো¤পানির মুনাফার লাগাম থামে না। থামে না অঙ্গার হওয়ার জীবনের সারি।
দেশীয় কারখানাগুলোয় – হোক তা গার্মেন্ট কি জুস কারখানা বা প্লাস্টিক কি রাসায়নিক গুদাম বারবার আগুন লাগছে। তদন্ত হচ্ছে, বিশেষজ্ঞ কমিটি সুপারিশ করে, মামলা হয়, কিছু ধরপাকড় হয় কিন্তু দৃষ্টান্তমূলক কিছুই হয় না। দৃষ্টান্তমূলক মানে কেবল ক্ষতিপূরণ আদায়, বিচার কিংবা শাস্তি নয়। দৃষ্টান্তমূলক মানে একটি কারখানায় নারী বা পুরুষ কেউ চাইলে নিরাপদে কাজ করতে পারবেন। সময়মতো তার মজুরি পাবেন। কারখানায় স্বাস্থ্যকর আনন্দপূর্ণ পরিবেশ থাকবে। আগুন বা এমন কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে শ্রমিকের জীবন বাঁচানোর জন্য কারখানা অগ্রণী হবে। কারখানায় দুর্ঘটনা থেকে বাঁচার সুরক্ষা সরঞ্জাম থাকবে, শ্রমিকও প্রাথমিক প্রশিক্ষণ পাবেন। কোনো শিশু কোনো কারখানায় কাজ করতে যাবে না। কারখানা যে পণ্য উৎপাদন করবে, সেই পণ্য ভেজাল ও ক্ষতিকর হবে না। এমনতর সবকিছু মিলেই একটি কারখানা ‘দৃষ্টান্তমূলক’ হতে পারে। সামগ্রিক জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে স্বীয় কারখানাগুলোকে দৃষ্টান্তমূলক করে গড়ে তুলতে রাষ্ট্রকে দৃঢ় হতে হবে। এসব কারখানার পণ্যের ক্রেতা-ভোক্তা-বিক্রেতা শ্রেণীকেও দায়িত্বশীল হতে হবে। গণমাধ্যম কোনোভাবেই শ্রমিকের অঙ্গারজীবন বিস্মৃত হতে পারে না, একটার পর একটা অপরাধ করার পরও গণমাধ্যমে সেসব কো¤পানির বিজ্ঞাপন প্রচার থামে না। সম্প্রতি সেজান জুস কারখানা ট্র্যাজেডির পর একটা ছলনাময় জুসের বিজ্ঞাপন কি ‘আসল জুস’ হিসেবে গণমাধ্যমে প্রচারিত হতে পারে? এর পরও কি কোনো ভোক্তার গলা দিয়ে এমন তরল নামবে, যাতে মিশে আছে অনেক শিশুর বাঁচার তীব্র আকুতি। কারখানার নির্দয় আচরণ পাল্টাতে দরকার সব শ্রেণী-পেশা ও বর্গের মানুষের দায়বদ্ধ ও দায়িত্বশীল জন-আন্দোলন। চলতি আলাপখানি গত দশ বছরের কিছু কারখানার অগ্নিকাণ্ডগুলো আবার স্মরণ করিয়ে দিতে চায়। এটি কেবল একটি তাজরীন বা সেজান জুসের ‘নিছক দুর্ঘটনা’ নয়। আমাদের বিলাসিতাকে যারা বারবার নিজের জীবন দিয়ে আমাদের সামনে এনে দেন, তাদের অঙ্গার জীবনের কাছে আমাদের দায়বদ্ধতার প্রশ্ন।
নিমতলী ট্র্যাজেডি ২০১০ :
পুরান ঢাকার নবাব কাটরার নিমতলীতে অগ্নিবিস্ফোরণ ঘটে ২০১০ সালের ৩ জুন। আগুনে নিহত হয় ১২৪ জন। এলাকার দালান ও দোকান বোঝাই ছিল বিপজ্জনক দাহ্য রাসায়নিকে। ৫ জুন রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষিত হয় এবং বাংলাদেশ ক্রিকেট দল সে সময় ইংল্যান্ড সফরে ছিল, তারা নিহতদের স্মরণে কালো আর্মব্যান্ড পরে খেলায় অংশ নেন। হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানিয়েছিলেন, রাসায়নিকের ধোঁয়ার কারণেই বেশির ভাগ মৃত্যু ঘটেছে। নিমতলী অগ্নিকাণ্ডের পর বিশেষজ্ঞ কমিটি ১৭টি সুপারিশ পেশ করেছিল, যার অন্যতম ছিল আবাসিক এলাকা থেকে রাসায়নিক ও দাহ্য পদার্থের গুদাম সরিয়ে নেয়া। কিন্তু সেই সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি। ঢাকার আবাসিক এলাকায় প্রায় অনেক দালানের নিচেই নানা রাসায়সিক, দাহ্য পদার্থ, যন্ত্রপাতি মজুদ করে গুদামঘর বানিয়েছেন বাড়ির মালিক। হরহামেশা গণমাধ্যমে এসব খবর প্রকাশিত হয়।
তাজরীন ফ্যাশনস, ২০১২ :
২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর ঢাকার আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেড কারখানায় আগুন লেগে ১১৭ জন গার্মেন্ট শ্রমিকের মৃত্যু হয়। দুইশর বেশি আহত হয়। ২৭ নভেম্বর বাংলাদেশ শোকদিবস পালন করে। পোশাক কারখানায় এত বড় অগ্নিকাণ্ডের পর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়, এসব কারখানার মূল ক্রেতা করপোরেট কো¤পানিগুলো কারখানার নিরাপত্তার জন্য অগ্নিনির্বাপণে অর্থ লগ্নি করতে চায় না। বিশেষ করে বিশ্বের বৃহৎ করপোরেট ওয়ালমার্ট দেশীয় পোশাক কারখানায় অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়টিকে আমল দেয়নি।
টা¤পাকো ফয়েলস, ২০১৬ :
২০১৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর গাজীপুরের টঙ্গীর টা¤পাকো ফয়েলস কারখানায় বিস্ফোরণ ও ভবন ধসে ৩৫ জন নিহত হয়। ১২ সেপ্টেম্বর টঙ্গী থানায় হত্যা ও হত্যা চেষ্টার অভিযোগে দুটি মামলা করা হয়।
প্রাইম প্লাস্টিক, ২০১৯ :
ঢাকার কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়ায় ‘প্রাইম পেট অ্যান্ড প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড’ কারখানায় ২০১৯ সালের ১১ ডিসেম্বর অগ্নিকাণ্ডে ২১ জন নিহত হয়। এর আগেও ২০১৯ সালের ২৫ এপ্রিল এবং ২০১৬ সালের ২৮ নভেম্বর এ কারখানায় আগুন লাগে।
চুড়িহাট্টা, ২০১৯ :
পুরান ঢাার চকবাজারের চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানসনে রাসায়নিক বোঝাই এক ভবন বিস্ফোরিত হয় ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে। দাহ্য রাসায়নিকের কারণে আগুন ভয়াবহ রূপ নেয়। ঘটনাস্থলেই মারা যায় ৬৭ জন, দগ্ধ আরো চারজন হাসপাতালে মারা যায়। ২০১৯ সালেই বনানীর এফআর টাওয়ারে আগুন লেগে ২৬ জন মারা যায়।
সেজান জুস, ২০২১ :
২০২১-এর ৭ জুলাই রাতে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কর্ণগোপে অবস্থিত ‘হাসেম ফুড বেভারেজ কোম্পানি’র ছয়তলা কারখানাটিতে আগুন লাগে। কর্তৃপক্ষ দরজা তালা দিয়ে দেয়। পুড়ে মারা যায় ৫২ জন শ্রমিক। কারখানাটি কো¤পানির জনপ্রিয় পণ্য ‘সেজান জুস’ কারখানা নামে পরিচিত।
আসুন দায়বদ্ধ হই :
কারখানা না হয়েও ছাদের দরজা লাগানো ছিল বলে আবাসিক ভবনেও আগুন লেগে মৃত্যু ঘটে। ঢাকার জাপান গার্ডেন সিটির ৬ নং ভবনের ১১ তলায় আগুন লাগে ২০১০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে। ফায়ার সার্ভিস আগুন নেভাতে সক্ষম হয়। ছাদের দরজা বন্ধ ছিল, সিঁড়িতে দমবন্ধ হয়ে এক পরিবারের সাতজন মারা যায়। ২০২০ সালে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় বায়তুস সালাত জামে মসজিদে বিস্ফোরণ ঘটে ৩৪ জন মারা যায় এবং ২০২১ সালের আরমানিটোলার হাজি মুসা ম্যানসনে রাসায়নিক গুদামে আগুন লেগে চারজনের মৃত্যু ঘটে। দেশে এত যে রাসায়নিক দাহ্য পদার্থের গুদামে আগুন লাগে, তার একটা দীর্ঘমেয়াদি সমাধান তো দরকার। কারণ আমাদের রাসায়নিক লাগবে, এটি মজুদ করতে হবে, ব্যবহার হবে, তার মানে একটা সুরক্ষাবলয় এবং নীতিগত ব্যবস্থাপনাও জোরদার করা দরকার।
বুয়েটের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ভাষ্য, দেশে প্রতি বছর প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার রাসায়নিক পণ্য আমদানি করা হয়। আমদানির ক্ষেত্রে লাইসেন্স, গুদাম-মজুদকরণের স্থানের নকশা, অগ্নিনির্বাপণ সনদ – এমন ১৫টি শর্ত পূরণ করতে হয়। তো নিমতলী থেকে চুড়িহাট্টা একের পর এক কত আর জানে কুলায়?
এবার আসা যাক সাম্প্রতিক সেজান জুস কারখানার অগ্নিকাণ্ড বিষয়ে। ৭ জুলাই রাতে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কর্ণগোপে অবস্থিত এ জুসের হাসেম ফুড বেভারেজ কো¤পানি নামের কারখানাটিতে আগুন লাগে। একটি আমের জুস কারখানা, অথচ বোঝাই ছিল রাসায়নিক ও প্লাস্টিক পদার্থে। কী নিদারুণ। এ অগ্নিকাণ্ড না ঘটলে হয়তো আমরা ভুলেই যেতাম এ কো¤পানি কেবল অগ্নিকাণ্ডে শ্রমিকদের তালাবদ্ধ করে রাখা নয়, ভেজাল জুসের জন্যও জরিমানা দিয়েছে। ২০১৬ সালের ২১ জুলাই গোদাগাড়ীর সারেংপুরে বিপুল পরিমাণ পচা আমের চালান আটক করে পুলিশ। পরবর্তী সময়ে সেজান জুসের কথিত এ পাল্প তৈরির কারখানায় অভিযান চালিয়েও বিপুল পরিমাণ পচা আম উদ্ধার করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। একই তারিখে পচা আম দিয়ে জুস তৈরির অভিযোগে সেজান জুসের এ পাল্প তৈরির কারখানাকে ২ লাখ টাকা জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) দেশে তৈরি চারটি জুস কো¤পানির উৎপাদিত জুস তাদের গবেষণাগারে পরীক্ষা করে। ২০১৭ সালের ১২ অক্টোবর প্রকাশিত বুয়েটের সেই গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, উল্লিখিত চারটি জুসেই মাত্র ৪ থেকে ৬ ভাগ পাল্প আছে, যা বিএসটিআইয়ের মানমাত্রা থেকে অনেক কম। সেজান জুসে পাল্প পাওয়া গেছে মাত্র ৫ দশমিক ৪ ভাগ। গড়ে ৫ শতাংশ পাল্প থাকার কারণে উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার কথা তখন জানিয়েছিল সরকারের নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ।
আমাদের দায়বদ্ধ হতে হবে। পচা আম দিয়ে ভেজাল জুস, সরকারি মানমাত্রা না থেকেও দেদার ‘আসল জুস’ হিসেবে প্রচার। কারখানায় শিশু শ্রমিক নিয়োগ, অগ্নিকাণ্ডের সময় দরজায় তালা – এভাবে একটি কারখানা মূলত কী উৎপাদন করতে চায়? শেষমেশ কিন্তু সবকিছুই অঙ্গার হয়ে যায়। আসুন আবারো দগ্ধ অঙ্গার ছুঁয়ে সম্মিলিত দাঁড়াই। কারখানাগুলোকে দায়বদ্ধ করতে সোচ্চার হই।
[পাভেল পার্থ : গবেষক ও লেখক]

 

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com