1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
  3. [email protected] : wp-needuser : wp-needuser
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:১৯ অপরাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

বিশ্ব জনসংখ্যা দিবসের প্রতিপাদ্য এবং লিঙ্গ সমতা

  • আপডেট সময় বুধবার, ১৪ জুলাই, ২০২১

:: স্বাতী চৌধুরী ::
গত ১১ জুলাই ছিল বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস। মহামারী করোনা সংক্রমণের তীব্রতার কারণে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস ২০২১ সারাদেশব্যাপী ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত হয়ে গেল।এই পেনডামিক সময় আমাদের হাত-পা বেঁধে দিয়েছে কিন্তু আমাদের মস্তিষ্ক থেমে নেই। চলমান মস্তিষ্কের সাহায্যে এই হাত-পা বাঁধা সময়কে অতিক্রম করে মানুষ তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছার চেষ্টা করে যাচ্ছে। মহামারী আমাদের কাজের গতি থামিয়ে দিয়েছে। আমাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। আসলে এমন কিছু কাজ আছে যা মানুষের কাছাকাছি না গিয়ে করা যায় না। কিন্তু করোনা মহামারী প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধির অন্যতম শর্ত মানুষের সাথে শারীরিক বিচ্ছিন্নতা বজায় রাখা। যদিও সাধারণ মানুষ থোড়াই পরোয়া করছে এই শর্তের। ফলে বিপদ বেড়ে যাচ্ছে। আমাদের অবরুদ্ধকাল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। যেজন্য নতুন নতুন সমস্যা সংকট তৈরি হচ্ছে আমাদের জীবনে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি। যেমন মানুষের স্বাস্থ্য সেবা এবং বিশেষ করে পরিবার পরিকল্পনা ও যৌন প্রজনন স্বাস্থ্য সেবা প্রদানে যারা নিয়োজিত তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেবা দিচ্ছেন। এই করোনা কালে শিক্ষা বিভাগের কার্যক্রম বলতে গেলে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে আছে। অন্যান্য অনেক বিভাগসমূহেও কার্যক্রমে শিথিলতা আছে। কিন্তু স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের কর্মীরা মাঠেই আছে। যারা প্রাতিষ্ঠানিক সেবা দেন তাদেরকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিষ্ঠানে সেবা দিতে হচ্ছে। কিন্তু করোনাপূর্ব সময়ে কার্যক্রম যে গতিতে চলছিল তাতে বিঘ্ন ঘটছেই। এই সেবা কার্যক্রম তো দ্বিপাক্ষিক বিষয়। সেবা দাতা এবং সেবা গ্রহীতা। সেবা দানের ক্ষেত্রে বিধান করা হয়েছে- নো মাস্ক নো সার্ভিস কিন্তু সেবাগ্রহীতাদের মধ্যে মাস্ক পরার অভ্যাস গড়ে ওঠেনি। মাস্ক পরার কথা বললে তারা তর্ক করে। কখনো মারমুখী হয়ে যায়।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই কর্মহীন। বেড়েছে অভাব অনটন। বেড়ে গেছে বাল্যবিবাহ। বেড়ে যাচ্ছে গর্ভবতীর সংখ্যা ও জন্মহার। এদিকে জাতিসংঘ এবারের বিশ্ব জনসংখ্যা দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করেছে- “অধিকার ও পছন্দই মূল কথা : প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকার প্রাধান্য পেলে কাক্সিক্ষত জন্মহারে সমাধান মেলে।”
প্রতিপাদ্য বিষয়ের বক্তব্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বিশেষ করে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে তো বটেই। কেননা আমাদের ছোট্ট আয়তনের দেশ এই বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই জনসংখ্যার ভারে জর্জরিত। জনসংখ্যার ভার নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যই জন্মনিয়ন্ত্রণ বা পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি চালু হয়েছিল দেশে। কিন্তু কালক্রমে বিশ্বে পরিবর্তিত পরিস্থিতি ও যুগের চাহিদা বিবেচনা করে এখন শুধুই জন্মনিয়ন্ত্রণ বা পরিবার পরিকল্পনার মাঝেই কার্যক্রম সীমিত নয়। এর সাথে যুক্ত হয়েছে মাতৃ শিশুস্বাস্থ্য সেবা, যৌন প্রজনন স্বাস্থ্য এবং নিরাপদ প্রসবসেবা। তা যত যাই বলা হোক এবারের প্রতিপাদ্য বিষয়ে অধিকার, পছন্দ ও প্রজনন স্বাস্থ্যের কথা বলা হলেও সেই ঘুরে ফিরে জন্মহার রোধ করার কথাটাই মূল কথা। কেননা অতিরিক্ত জনসংখ্যার ভার আমাদের ব্যক্তিগত ও জাতীয় সমস্ত উন্নয়ন অর্জনকে বাধাগ্রস্ত করে। তাই বাধা দূর করেতে জন্মহার রোধের বিকল্প নেই আর সেজন্য দ¤পতির অধিকার ও পছন্দের ওপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু কথা হচ্ছে সেই অধিকার ও পছন্দের কথা যে বলা হয়েছে, এখন কথা হলো সেই পছন্দটা কার? দম্পতির নারী না পুরুষের? গর্ভ কে ধারণ করে? এসব প্রশ্নের উত্তর আমরা সবাই জানি। আমরা জানি দম্পতির মধ্যে যিনি নারী তাকেই গর্ভধারণ করতে হয় এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাকেই জন্ম নিয়ন্ত্রণের যেকোনো পদ্ধতি গ্রহণ করতে হয়। কেননা বিজ্ঞানও জন্মনিয়ন্ত্রণের অধিক্ষেত্র হিসেবে নারী দেহকেই বেছে নিয়েছে তাই জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর অধিকাংশ উপকরণ উৎপাদন করা হয়েছে নারী দেহে প্রয়োগ করার জন্য। তাই প্রশ্নটা খুবই প্রাসঙ্গিক যে পছন্দ ও অধিকার কার এবং কিসের। এখন পছন্দ ও অধিকার দুটোই যদি হয় নারীর বলে আমরা মনে করি, আসলে মনে করারও কিছু নেই গর্ভ ধারণের এবং পদ্ধতি গ্রহণের অধিকার ও পছন্দতো নারীরই হওয়া উচিত। সেই নির্ণয় করবে কখন সে গর্ভধারণ করবে, কতবার ধারণ করবে কিংবা গর্ভনিরোধ করার জন্য কোন ধরনের পদ্ধতি সে গ্রহণ করবে। এখন এই প্রশ্ন করার আগে বড় প্রশ্ন এরকম পছন্দ করার অধিকার তার আছে কিনা? যদি পছন্দ করার অধিকার থাকে তবে আমাদের পরিবার সমাজ এমন কি রাষ্ট্র তাকে সেই অধিকার ভোগ করতে দেয় কিনা ।
প্রথমেই রাষ্ট্রের কথা যদি বলি তবে বলা যায় সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র নারীকে সে ক্ষমতা দিয়েছে। সংবিধানে বলা হয়েছে, “ধর্ম বর্ণ লিঙ্গ নির্বিশেষে প্রজাতন্ত্রের সকল নাগরিক সমান সুযোগ লাভের অধিকারী”। “শুধুমাত্র ধর্মীয় ও লিঙ্গগত কারণে কারো প্রতি বৈষম্য করা যাবেনা।” কিন্তু আমরা দেখি পরিবার সেক্ষেত্রে নারীকে সমান সুযোগ দেয় না।এখনো অধিকাংশ পরিবারে একজন কিশোরী প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই বা সে সিদ্ধান্ত নেয়ার উপযুক্ত হওয়ার আগেই তাকে পরিবারের ইচ্ছে অনুযায়ী বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়। রাষ্ট্র এখানেও বাধা দিয়েছে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন দিয়ে। কিন্তু পরিবারগুলো সে আইনকে তোয়াক্কা করে না। সমাজ পরিবারকে বাল্যবিবাহ দিতে উৎসাহ প্রদান করে। আমাদের সমাজের মানুষ এখনো এতটাই অসচেতন যে অন্য লোকের মেয়ের কেন বিয়ে হচ্ছে না, বিয়ে হলে সন্তান কেন হচ্ছে না তা নিয়ে কটাক্ষ করে। সেই কিশোরী বছর না ঘুরতেই যখন মা হয়ে যায়, তখন তার প্রজনন স্বাস্থ্য, তার পছন্দ, তার অধিকারের কথা বলা নিতান্তই হাস্যকর সেইসব পরিবারের কাছে। তারপর এ সমাজে পরিবারে ছেলেসন্তান এতই প্রত্যাশিত যে যতক্ষণ না কোনো মা ছেলে সন্তানের জন্ম দিচ্ছে ততক্ষণ তাকে যন্ত্রের মতো গর্ভধারণ করতেই হবে। এবং অনেক পরিবার আছে ছেলে সন্তান হয়ে গেলেই শেষ নয় কারণ তখন বলে একটা ছেলের কী বিশ্বাস? তাই আরো একটা ছেলের চাহিদার জন্য ঐ মাকে আবারো গর্ভধারণ করতে হয়। তাহলে দেখা যাচ্ছে আমাদের পরিবার ও সমাজ এখনো নারীকে তার অধিকার ভোগ করতে দেবে কী নারীর অধিকার স¤পর্কে তেমন ধারণাই রাখে না বা যারা কিছুটা হলেও রাখে তারা মানে না।
এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারী-পুরুষের অসম অবস্থানে যেখানে নারীর জীবনে সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ নেই তার শরীরের ওপর যখন অন্যের নিয়ন্ত্রণ থাকে সেখানে আধুনিক পরিবার পরিকল্পনা ও যৌন প্রজনন স্বাস্থ্য সেবায় অধিকার ও পছন্দ প্রাধান্য পাওয়াটা আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে একটু কঠিনই বটে। পরিবার পরিকল্পনা বিভাগে চাকুরির দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় দেখেছি আগে যখন অফিসে ডেস্ক ওয়ার্ক করতাম মাঠকর্মীদের বক্তব্য থেকে জানতাম বিশেষ করে যারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে মোটিভেশন ওয়ার্ক করে তারা বলতো মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা কী যে কঠিন কাজ। দ¤পতির নারীরা জন্ম নিয়ন্ত্রণে বা পরিবার পরিকল্পনা সেবা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ হলেও তার হাজব্যান্ড ও শাশুড়ি যদি না সম্মতি দেয় তবে সবকিছু পণ্ড হয়ে গেলো। বিগত চারবছর যাবৎ মাঠকর্মীদের কাজ মনিটর করতে গিয়ে দম্পতিদের সাথে কথা বলেছি। অনেক পরিবারে আছে মায়েরা চায়না আর সন্তান নিতে কিন্তু তাদের হাজব্যান্ড ও শাশুড়ি বাধা দেয়। কখনো শাশুড়ি সম্মত থাকলেও হাজব্যান্ড সম্মত হয় না। অনেকে লুকিয়ে কোনো পদ্ধতি নেয়ার কারণে পারিবারিক সহিংসতার শিকার হতে শুনেছি। আবার অধিকাংশ দম্পতির বিশেষ করে দম্পতি নারীর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া আছে তা জেনেও অধিক পছন্দ অস্থায়ী পদ্ধতি ইনজেকশন বা ওরাল পিল। অনেকে ইমপ্ল্যান্টও নিতে আগ্রহী। কিন্তু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন দীর্ঘমেয়াদী পদ্ধতি আইইউডির প্রতি আগ্রহ খুবই কম। স্থায়ী পদ্ধতি একেবারেই কম। পুরুষদের জন্য যে স্থায়ী পদ্ধতি আছে সে বিষয়ে পুরুষদের উদ্বুদ্ধ করা তো আরো কঠিন। কিন্তু যেহেতু অস্থায়ী পদ্ধতি জন্মহার রোধে অধিক কার্যকর নয়, ড্রপআউট হওয়ার আশঙ্কা আছে তাই ডিপার্টমেন্ট চায় দম্পতিরা স্থায়ী ও দীর্ঘমেয়াদী পদ্ধতি গ্রহণ করুক। তাই মাঠকর্মীদের ওপর চাপ থাকে। কর্মীরা আবার দম্পতিদের ওপর চাপ দেয়। কিন্তু বিষয়টা এত জটিল ও কঠিন হতো না যদি বাল্যবিবাহ বন্ধ করা যেতো, যদি নারী স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারতো, যদি পরিবার ও সমাজে পুত্র সন্তানের জন্য এত চাহিদা না থাকতো। এরকম পরিস্থিতির জন্য প্রয়োজন লিঙ্গিয় সমতা। প্রয়োজন নারী-পুরুষের সমতাপূর্ণ সমাজ ও পরিবার ব্যবস্থা। সমতাপূর্ণ সমাজে নারীর শরীরের নিয়ন্ত্রণ থাকতো নারীর হাতে। তাহলে একজন পরিণত বয়স্ক স্বাধীন নারী পরিকল্পিত পরিবার গঠনের জন্য নিজেই সঠিক সিদ্ধান্তটি নিতে পারতো। সেজন্য সবকিছুর আগে যে লিঙ্গসমতা প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য তা গত ৩০শে জুন থেকে ২রা জুলাই তিনদিন ব্যাপী ইউএন উইমেনের আয়োজনে অনুষ্ঠিত জেনারেশন ইক্যুয়েলিটি ফোরামের সম্মেলনে জোরেসোরে দাবি করা হয়েছে। জাতিসংঘ সদস্য রাষ্ট্র সমূহের সরকারের প্রতিনিধিদের সাথে বেসরকারি প্রতিনিধি এবং তরুণ সমাজ আওয়াজ তোলেছেন নারীর বডিলি অটোনমি এন্ড সেক্সুয়াল এন্ড রিপ্রোডাকটিভ হেলখ এন্ড রাইটস বা শারীরিক স্বায়ত্বশাসন এবং যৌন প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকারের পক্ষে। তাই এই করোনা মহামারীকালে মানুষ যখন কার্যত গৃহবন্দী সেই সময় নিরাপদ প্রসব সেবাসহ জন্মহার রোধ করতে এবং যৌন প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার নিশ্চিত করতে নারীর ক্ষমতায়নসহ সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকারের জন্য লিঙ্গ সমতা প্রতিষ্ঠা সময়ের দাবি। তার জন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের সাথে সাথে মানুষের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তোলার বিকল্প নেই।
শেষ করবো বিশ্ব জনসখ্যা দিবস ২০২১ উপলক্ষে ইউএনএফপির নির্বাহী পরিচালক নাতালিয়া কানেম বিশ্বকে যে বার্তাটি দিয়েছেন তার কথা দিয়ে। তিনি বলেছেন “যৌন প্রজনন স্বাস্থ্য সেবা একটি অত্যাবশ্যক অধিকার। এটা কোনো ঐচ্ছিক বিষয় নয়।” তাই নিরাপদ প্রসব সেবাসহ জন্মহার রোধ করতে এবং যৌন প্রজনন স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের পাশাপাশি সকল সেক্টর থেকে, নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে জনপ্রতিনিধি প্রিন্ট ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং সোশ্যাল মিডিয়াকে ও পেশাজীবী সকলকে নিজস্ব অবস্থান থেকে আন্তরিকভাবে কাজ করতে হবে ।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com