:: সৈয়দ মহিবুল ইসলাম ::
কিশোর বেলার দুরন্ত সময়ে লক্ষ্য করতাম শশ্রƒমণ্ডিত সৌম্য দর্শন হালকা-পাতলা এক ভদ্রলোক মাঝে মাঝে আমাদের বাসায় আসতেন। আমার সাথে দেখা হলে বলতেন- বাবা তোমার মাকে দেখতে এসেছি। মা জানালেন ইনি তোমাদের এক চাচা সৈয়দ রুকন উদ্দিন আহমদ। তিনি সুনামগঞ্জ এস.ডি.ও অফিসের হেডক্লার্ক ছিলেন। ভাল ইংরেজি জানতেন। ড্রাফটিংয়ে বিশেষ দক্ষতার অধিকারী ছিলেন। আবাসিক অবস্থান ষোলঘর পানির পাম্পের বিপরীতে নিজস্ব ভূমিতে। তাদের উৎসমূল আমাদের গ্রাম সৈয়দপুরে। আমাদের এক দাদি যখন বেঁচে ছিলেন তখন আমি ও চাচাতভাই সৈয়দ শামসুল ইসলাম মাঝে মাঝে বেড়াতে যেতাম।
সময় গড়িয়ে চলে স্রোতের মত। দাদি লোকান্তরিত হবার পর যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে আসে। মাঝে মাঝে ঈদের দিনে বেড়াতে যেতাম। তবে সৈয়দ রুকন উদ্দিন আহমদের জ্যেষ্ঠ সন্তান সৈয়দ ছালিক আহমদকে দেখতাম নিরীহ শান্ত শিষ্ট এক তরুণ হিসেবে।
একাত্তরের উত্তাল সময়ে বাংলাদেশের মানুষ এক কঠিন মহাসমরের মুখোমুখি হয়। এর ঢেউ আছড়ে পড়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রান্তিক মহকুমা শহর সুনামগঞ্জে। এখানকার অনেক তরুণ ছাত্র-যুবক প্রতিরোধযুদ্ধের অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে ওঠেন। কলেজ পড়ুয়া তরুণ-যুবক সৈয়দ ছালিক আহমদও এই সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েন। তিনি স্থানীয় ছাত্রলীগের রাজনীতিতে নেতৃস্থানীয় ছিলেন। সুনামগঞ্জে ৫০ জনের এক মুক্তিবাহিনী গঠন করা হয় যার অধিকাংশই ছিলেন আনসার সদস্য।
বিশিষ্ট লেখক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক বজলুল মজিদ খসরু তাঁর “রক্তাক্ত ৭১ সুনামগঞ্জ” বইতে লিখেছেন- “পূর্ব সিদ্ধান্ত মতো ২৪ মার্চ ছাত্র-জনতা মহকুমা প্রশাসকের কাছে অস্ত্রাগারের চাবি চেয়ে বসে কিন্তু এস.ডি.ও চাবি দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। রুদ্রমূর্তিতে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য কিছু আনসার মোজাহিদের সাথে যোগাযোগ করে তাদের সংগঠিত করে তোলা হয়। ২৪ মার্চ সারারাত শহরে পাহারা বসে। এস.ডি.ও অফিস ঘেরাও থাকে রাতভর। ২৫ মার্চ আনসার অ্যাডজুটেন্টের কাছ থেকে জোরপূর্বক চাবি নিয়ে অস্ত্রাগার ভেঙ্গে ৫০টি রাইফেল ও গুলি নিয়ে আনসারদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। সেখানে দেওয়ান ওবায়দুর রেজা, আলফাত উদ্দিন আহমদ, হোসেন বখত প্রমুখ নেতাদের পরামর্শে নজির হোসেন, আশ্রব আলী, নওয়াব আলী, মনোয়ার বখত নেক প্রমুখের মাধ্যমে লিস্ট করে অস্ত্র ও গুলি বিতরণ করা হয়। যুদ্ধের সাজসাজ রব চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।”(পৃ: ৩৫)
“সুনামগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধ যেভাবে দেখেছি” বইয়ে নজির হোসেন সুনামগঞ্জ ৫০ জনের মুক্তিবাহিনী গঠন সম্পর্কে লিখেছেন- “নবাব আলী ও নওরোজ মিয়া মিলে ৫০ জনের তালিকা করেন। আমার নামটি অত্র তালিকায় রেখে দেওয়ার অনুরোধ করি। অধিনায়ক নবাব আলী ও সহ-অধিনায়ক নওরোজ মিয়া ২৫ তারিখে সশস্ত্র যুদ্ধ করতে প্রস্তুত লোকদের হাতে ৫০টি থ্রি নট থ্রি রাইফেল তুলে দেন। এই ৫০ জনের মধ্যে অধিকাংশ ছিল আনসারবাহিনীতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত।” (পৃ: ৪৩)
তিনি ৫০ জনেরএকটি অসম্পূর্ণ তালিকা ও প্রকাশ করেন যার মধ্যে ছালিক আহমদ নামটি রয়েছে ৩৫ নম্বরে। এই সংগ্রামী যুবকেরা ২৮ মার্চের প্রতিরোধযুদ্ধে সাহসিকতার সাথে অংশগ্রহণ করেন।
অবশেষে অন্য অনেকের মতো ছালিক ভাইও ভারতে পাড়ি জমান। প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে বালাট সাবসেক্টরে নিয়মিত যোদ্ধা হিসেবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধে কমান্ডারের দায়িত্বও পালন করেন। এই সাব সেক্টরের অধীনে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ সংঘটিতহয়। বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান, সৈয়দ ছালিক আহমদ প্রসঙ্গে বলেন- এক নিষ্ঠাবান দেশপ্রেমিক যোদ্ধা ছিলেন তিনি এবং তাঁর আচার-আচরণ ছিল অত্যন্ত অমায়িক।
অবশেষে ন’মাসের এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর বাংলাদেশের মানুষ দেখে নতুন সূর্যোদয়। বাংলাদেশের আকাশে ওড়ে লালসবুজের পতাকা। রণক্লান্ত বিদ্রোহী যোদ্ধারা ফিরে আসেন স্বদেশ ভূমিতে আপন আলয়ে।
আমাদের বাসায় গ্রাম থেকে চাচারা আসেন। বসে গল্পের আসর। সেখানে ছালিক ভাইয়ের বীরত্বগাঁথা নিয়ে অনেক গল্প আলোচিত হয়। অবশেষে একদিন গল্পের নায়ককে দেখি আমাদের বাসায়। সেই মুখচোরা লাজুক হাসি হাসেন, কথা বলেন কম।
ছালিক ভাই দ্রুতই ফিরে যান স্বাভাবিক জীবনে। ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। বিয়ে-শাদী করে সংসারী হন। সুরমা নদীর পাড়ে নিজস্ব বাসভবনে বাস করতে থাকেন। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিজেকে কখনো জাহির করতেন না। বলতেন দেশের প্রয়োজনে যুদ্ধ করেছি, এখন পারিবারিক প্রয়োজনে নিজের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করা উচিত। নিপাট ভদ্রলোকের এক জীবন ছিল তাঁর কর্মে ও ধ্যানে। সামাজিক দায়িত্ব ও পালন করেছেন অনেক। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অত্যন্ত সুনাম ও দক্ষতার সাথে রাইফেলস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান ‘মুক্তি সংগ্রাম স্মৃতিট্রাস্ট’-এর সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন নিষ্ঠার সাথে। ষোলঘর জামে মসজিদের মোতাওয়াল্লি হিসেবে সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেন।
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রতিটি দায়িত্ব পালন করেছেন সুনাম ও দক্ষতার সাথে। ১৬ এপ্রিল শুক্রবার ২০২১ পবিত্র রমজান মাসের ৩য় দিবসে করোনাক্রান্ত হয়ে সিলেটের একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলায়হি রাজিউন)। পেছনে রেখে যান স্ত্রী, পাঁচ কন্যাসহ আত্মীয়-স্বজন ও অসংখ্য গুণগ্রাহী। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সুনামগঞ্জের ষোলঘরস্থ কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়। পরম করুণাময় যেন তাঁকে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করেন। আমিন।
[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, কলাম লেখক ও শিক্ষাবিদ]