:: শহীদনূর আহমেদ ::
মানিক দা’র সাথে পরিচয় যখন কলেজে পড়াশোনা করি। তখন সাপ্তাহিক সুনামকণ্ঠে কাজ করতাম। আমরা কিছু সহপাঠী পৌরবিপণিতে সুনামকণ্ঠ পাঠক ফোরামে অফিসে বসতাম। অফিসে টুকটাক গান গাই। সুনামকণ্ঠ সম্পাদক বিজনদা বললেন- তোমাদের একটি গানের স্কুলে ভর্তি করে দিবো। তিনি আমাদের পাঠিয়ে দিয়েন মানিক দা’র কাছে।
মানিক মোহন চন্দ হলিচাইল্ড কিন্ডারগার্টেনের অধ্যক্ষ। বাঁধনপাড়ায় কিন্ডারগার্টেনের একটি কক্ষে সপ্তাহে দুই-তিন দিন আমরা গান শিখতাম। আমি, জয়, ফাহিমা, আফরিনসহ আরও কয়েকজন।
মানিক দা’র কাছ থেকে শিখি আরোহ-অবরোহ, সারেগামাপা ইত্যাদি। এভাবে কিছুদিন গানের রেওয়াজ করেছিলাম। দাদাই ছিলেন আমার প্রথম ওস্তাদ। মানিক দা’র কাছ থেকে শিখলাম হাসন রাজার গান। ‘বাউলা কে বানাইলো রে…’ -এর সুর, তাল, লয়।
মানিক দা’র কাছে গান শিখা হয়তো আমার অনেক দীর্ঘ হতো। আজ হয়তো গানের জগতে অবস্থান আরও শক্ত হতো যদি না আমার সহপাঠীরা আমাকে নিরুৎসাহী করতো। বন্ধুদের কুমন্ত্রণায় গানের বিষয়ে আর যাওয়া হয়নি দাদার কাছে। তবে সাংবাদিকতায় আসার পর মানিক দা সম্পর্কে আরও জানতে পারি বিজন দা’র মাধ্যমে। খুব সহজ, সরল, মিশুক এককথায় ভালো মানুষ ছিলেন তিনি। সদালাপী, হাস্যজ্জ্বল, প্রাণবন্ত প্রকৃতির এই মানুষটি সহজেই অন্যকে কাছে টানতেন। বয়সে অনেক ব্যবধান থাকলেও মানিক দা আমাকে তুমি করে কখনও ডাকেননি, সব সময় আপনি বলেই সম্বোধন করতেন।
মানিক মোহন চন্দ শুধু হলিচাইল্ড কিন্ডার গার্টেন এন্ড হাইস্কুলের একজন অধ্যক্ষই ছিলেন না। তার হাত ধরে জেলায় আরও অনেক কিন্ডারগার্টেন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মানিক দা একবার বেশ বিপাকে পড়েছিলেন। তাঁর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলি চাইল্ড কিন্ডারগার্টেন তখন ওয়েজখালিতে ছিল। সেখানে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ চলতো। একবার স্কুলের এক শিক্ষকের ষড়যন্ত্রে প্রতিষ্ঠানের সকল শিক্ষক একযোগে পদত্যাগ করলেন। এতে দুশ্চিন্তায় পড়েন মানিক দা। একদিকে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা, অন্যদিকে অভিভাবকদের চাপ। কি করবেন ভেবে উঠতে পারছিলেন না তিনি। পরামর্শের জন্য বিজন দার কাছে আসলেন তিনি। দাদা পরামর্শ দিলেন পত্রিকার মাধ্যমে সপ্তাহ দিনের মধ্যে শিক্ষক নিয়োগ দিতে। আর এই কিছুদিন পার্টটাইম শিক্ষক দিয়ে ক্লাস নিতে। তাহলে পার্টটাইম শিক্ষক কোথায় পাওয়া যাবে। মনোনীত করা হলো আমাকে। আমিসহ আরও পরিচিত কয়েকজন নিয়ে সপ্তাহদিন সময় দিলাম মানিক দাকে। নিয়মিত সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত ক্লাস নিতাম। কিছুদিন কোমলমতি শিশুদের সাথে সময় দিয়ে নিজেকে ‘শিক্ষক শিক্ষক’ মনে হতো। মানিক দা আমাকে খুব স্মার্টলি ‘স্যার’ ডাকতেন। একপর্যায়ে মানিক দা’র প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগ হয়ে গেল। আবারও স্বাভাবিক হয়ে গেল উনার প্রতিষ্ঠান। সেই থেকে মানিক দা আমাকে ‘স্যার’ ডাকতেন।
খেলাঘর, হাওর বাঁচাও আন্দোলনে একসাথে কাজ করেছি আমরা। খুব নিবেদিত মানুষ ছিলেন তিনি। সুনামকণ্ঠ অফিসে আসলে নানা বিষয় নিয়ে তার সাথে আলাপ হতো। বিচক্ষণ এই মানুষের সাথে এক হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠেছিল অবচেতনভাবেই।
একবার মানিক দা’র বাসায় এক সন্ত্রাসী প্রকৃতির লোক হামলা করলো। মানিক দা ও উনার পরিবারের একজনকে আহত করলো। বরাবরের মতো সুনামকণ্ঠের স¤পাদক বিজন সেন রায় দাদার কাছে আসলেন। বিজন দা আমাকে ডেকে নিয়ে এ বিষয়ে নিউজ করার জন্য বললেন। ছেলেটার ছবিসহ পত্রিকায় একটি নিউজ আসার পর পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। ওইদিন বিকেলে এসে মানিক দা খুব বিনয়ের সঙ্গে আমাকে ধন্যবাদ জানালেন। ইতস্ততভাবে দাদা বললেন- কিছু মনে না করলে স্যার আপনাকে কিছু আপ্যায়ন করাতাম। আমি বললাম, না দাদা আপনি আমার আপনা মানুষ।
দাদার স্কুলে সময় দেয়ার সুবাদে দাদার কিছু ব্যক্তিগত বিষয় স¤পর্কে জানা ছিল আমার। মানিক দা’র তিন কন্যা সন্তান। তাদের খুবই ভালোবাসতেন দাদা। মেয়েরা আমার খুবই ‘ভক্ত’ ছিল। ক্লাসে তাদের কিছু গল্প শিখিয়েছিলাম। গানের ক্লাস, স্কুল, ছাড়াও বাসার কাছে একটা ফার্মেসি ছিল দাদা’র। করোনাকালে সব সর্বনাশ হয়েছে মানিক দা’র। দেড় বছরের বেশি সময় ধরে স্কুল বন্ধ। প্রতি মাসেই স্কুলের ভবনের ভাড়া গুনতে হতো। করোনায় বাধ্যবাদকতার কারণে গানের ক্লাসও হতো না। আর পুঁজি না থাকায় ফার্মেসিতে ওষুধের পরিমাণ ছিল কম। বুঝাই যেত দিন খারাপ যাচ্ছে মানিক দা’র। তবে চাপা স্বভাবের মানুষটি সব সময় হাসিখুশিতে থাকতেন। ব্যক্তিত্ব স¤পন্ন মানুষটি কখনোই নিজের দুরবস্থার কথা প্রকাশ করতেন না। করোনাকালের টানাপোড়েন আর সীমাবদ্ধতার চাপা কষ্টই হয়তো কাল হলো মানিক দা’র। ৭ জুন মঙ্গলবার হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পরপারে চলে গেলেন প্রিয় মানিক দা। দাদা, এভাবে তো আপনার চলে যাওয়ার কথা ছিল না। ভাবতে কষ্ট হয়- যখন তাঁর তিন সন্তান পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হবে। ভাবতে পারিনা আপনার কণ্ঠে আর গান শুনবো না। আমরার সঙ্গে গলা মিলিয়ে গান ধরবো না- “আমরা করবো জয়, নিশ্চয়…”।