:: নাসরীন আক্তার খানম ::
করোনা ভাইরাস সারাবিশ্বকে নাকাল করে ছাড়ছে। এর প্রভাব পড়েছে বিশ্বের সার্বিক বিষয়ে। রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষানীতি সবকিছুই এর প্রভাবে প্রভাবিত। বিশেষ করে আমাদের বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় এর বিপুল প্রভাব লক্ষণীয়। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের আশঙ্কা যখন দেখা দিয়েছিল, তখন থেকে সেই ২০২০ সালের ১৭ মার্চ দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল, এখনও বন্ধই রয়েছে, কবে খুলবে তা অনিশ্চিত। সারাবিশ্বে এ পর্যন্ত এই ভাইরাসে আক্রান্ত মোট ১৭.২ কোটি, মৃত্যু হয়েছে ৩৬.৯ লাখ।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ও দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ ছিল, কিন্তু এত দীর্ঘসময় ব্যাপী নয়। যার নেতিবাচক কী হতে পারে তা একমাত্র ভবিতব্যই জানে। শিক্ষার চেয়ে অবশ্যই জীবন গুরুত্বপূর্ণ, তাই সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যাতে সুরক্ষিত থাকে তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রয়েছে।
করোনাভাইরাস স¤পর্কে জানতে একটু অতীতে ফিরে তাকাই। করোনাভাইরাস ১৯৩০-এর দশকের প্রথমদিকে মুরগীর মধ্যে সংক্রামক ব্রঙ্কাইটিস ভাইরাস হিসেবে এটি প্রথম দেখা যায়। পরে সাধারণ সর্দি-হাঁচি-কাশিতে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যেও এরকম দুই ধরনের ভাইরাস পাওয়া যায়। মানুষের মধ্যে পাওয়া ভাইরাস দুটি ‘মনুষ্য করোনাভাইরাস ২২৯ই’ এবং ‘মনুষ্য করোনাভাইরাস ওসি৪৩’ নামে নামকরণ করা হয়। এরপর থেকে বিভিন্ন সময় ভাইরাসটির আরো বেশ কিছু প্রজাতি পাওয়া যায় যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ২০০৩ সালে ‘এসএআরএস-সিওভি’, ২০০৪ সালে ‘এইচসিওভি এনএল৬৩’, ২০০৫ সালে ‘এইচকেইউ১’, ২০১২ সালে ‘এমইআরএস-সিওভি’। সর্বশেষ ২০১৯ সালে মধ্য চীনের উহান শহরে ৩১ ডিসেম্বর এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নজরে আসে, ১১ জানুয়ারি এই ভাইরাসে আক্রান্ত একজন মারা যায়। এটি ‘এসএআরএস-সিওভি-২’ পাওয়া যায়, যা বর্তমানে সাধারণত নোভেল করোনাভাইরাস নামেই পরিচিত। এগুলোর মধ্যে অধিকাংশ ভাইরাসের ফলে শ্বাসযন্ত্রের (ফুসফুস) গুরুতর সংক্রমণ দেখা দেয়।
শিক্ষায় প্রভাব :
সারাদেশে মাধ্যমিক ও প্রাথমিক মিলিয়ে প্রায় তিন কোটির উপর শিক্ষার্থী রয়েছে। কেমন আছে তারা? তাদের শিক্ষা কার্যক্রম কীরকম চলছে? সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টায় অনলাইন কার্যক্রম শুরু হয়, সংসদ টিভি ও বেতারের মাধ্যমে পাঠদান চলে। একটি বেসরকারি গবেষণায় জানা গেছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ৬৯.৫ শতাংশ শিক্ষার্থী দূরশিক্ষন ক্লাস কার্যক্রমে অংশ নিতেই পারেনি। বড় বড় শহরে নামিদামি স্কুলগুলো অনলাইন ক্লাস, জুমের মাধ্যমে তাদের পাঠদান কার্যক্রম অব্যাহত রাখার প্রয়াস পেয়েছে। ছোট শহরগুলো এবং গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা দারিদ্র্যের কারণে সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এভাবে শিক্ষাক্ষেত্রে একটি বৈষম্যের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সংসদ টিভির ক্লাস ৫৬শতাংশ শিক্ষার্থী দেখেছে, এক বিরাট অংশ তার থেকে বঞ্চিত। এর কারণ দারিদ্র্য, বিদ্যুৎ ও নেট হীনতা। বেতারের কোন নেটওয়ার্কই পাওয়া যায় না বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে। আবার একমুখী পাঠদান চলে বলে, এ পদ্ধতি শিক্ষার্থীরা পছন্দ করে না, আগ্রহ বোধ করে না।
অনলাইন ক্লাস করার জন্য যে সকল শিক্ষার্থী মোবাইল ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছে, তারা ক্লাস করার পরিবর্তে মোবাইল গেম ও ইন্টারনেটে আসক্ত হয়ে পড়েছে। যার কুপ্রভাব কী হতে পারে তা ভাবতেও ভয় লাগে। তাছাড়া দীর্ঘসময় ইলেকট্রনিকস ডিভাইসে দৃষ্টি রাখার ফলে তাদের চোখের উপর প্রভাব পড়ছে, ইলেকট্রনিকস ডিভাইস শিশু কিশোরদের মানসিক ও দৈহিক ক্ষতি করে বলে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ; সাময়িক, বার্ষিক ও পাবলিক পরীক্ষাগুলো হয়নি, শিক্ষার্থীদের অটো প্রমোশন দেওয়া হয়েছে। মেধাবী শিক্ষার্থীরা এতে হতাশ।
শিশু-কিশোররা স্কুলে যাচ্ছে না, এতে তারা মানসিক অবসাদে ভুগছে। যা তাদের দৈহিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের জন্য ক্ষতিকর। বিদ্যালয়ে শিশু-কিশোররা কেবল পড়াশোনাই করে না, তারা সামাজিকতা ও অন্যান্য বিষয় শিখে। খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে অংশ নেয়। সবকিছু থেকেই দীর্ঘদিন যাবৎ তারা বঞ্চিত।
অনেক দরিদ্র পরিবার তাদের ছেলে সন্তানকে কাজে লাগিয়ে দিয়েছে, কিশোরী মেয়েটিকে গোপনে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। এতে করে স্কুল খোলার পর ঝরে পড়ার সংখ্যা ঠিক কী পরিমাণ হতে পারে তা ভেবে সচেতন মহল উদ্বিগ্ন।
সরকার বিভিন্ন সময় স্বাস্থ্যবিধি মেনে ক্লাস খোলার সিদ্ধান্ত নিলেও, তা থেকে পিছিয়ে আসতে হয় সরকারকে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায়। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশে ২৭ জানুয়ারি থেকে টিকা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। বিভিন্ন স্তরের শিক্ষার্থীদের টিকা দিয়ে পর্যায়ক্রমে শিক্ষাঙ্গনে ফিরিয়ে আনার আন্তরিক প্রচেষ্টা সরকারের রয়েছে।
বর্তমানে শিক্ষাকার্যক্রম অব্যাহত রাখতে শুরু হয়েছে মিটগুগল এপস এর মাধ্যমে পাঠদান, ওয়ার্কসিট বিতরণ যা এই লকডাউনে শিক্ষকবৃন্দ বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছেন। গুগল মিট কতটুকু ফলপ্রসূ হবে তা নিয়ে অনেকেই সন্দিহান, কারণ এটি ব্যবহার করতে প্রযুক্তি জ্ঞান থাকা লাগবে, সেই সাথে নিরবচ্ছিন্ন নেটওয়ার্কও থাকা লাগবে। ওয়ার্কসিট বিতরণ প্রচুর খরচের একটি কাজ, যার ব্যয় সংকুলান স্লিপ ফান্ড থেকে করতে বলা হয়েছে। এতে স্কুলের অন্যান্য যে কাজগুলো করতে হয় তার উপর প্রভাব পড়বে অবশ্যই।
সদাশয় সরকারের আন্তরিকতা আছে, সেই আন্তরিকতা যদি সবাই ধারণ করি, ও শিখন ঘাটতি পুষিয়ে নিতে যার যার অবস্থান থেকে সচেতন ভূমিকা পালন করি, তবে নিশ্চয়ই চলমান পরিস্থিতি আমরা মোকাবেলা করতে পারব। কিন্তু আমাদের দেশের সাধারণ পর্যায়ের যে অভিভাবকবৃন্দ, তাঁরা অধিকাংশই আগে সন্তানকে স্কুলে পাঠিয়ে নিশ্চিত থাকতেন, এতটা সচেতনতা এখনও অধিকাংশের নেই যে চলমান কার্যক্রমে নিজেদের সচেতনভাবে সম্পৃক্ত করতে সক্ষম হবেন। তবু আশাবাদী, আশা নিয়েই আছি, করোনা একদিন নিয়ন্ত্রণ হবে। যদি নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তবে একে সাথে করেই বাঁচতে হবে। সেই অবস্থায় শিক্ষা পদ্ধতি নিয়ে হয়ত নতুন করেই ভাবতে হবে। শিক্ষার যেহেতু কোন বিকল্প নেই, কাজেই এটিই হতে হবে সর্বোচ্চ চিন্তাভাবনা ও গবেষণার ক্ষেত্র, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে, এবং দেশের স্বার্থে।