:: এস ডি সুব্রত ::
বাংলা সাহিত্যের এক কালজয়ী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য জীবন ব্যাপৃত ছিল ১৯১৯ থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত ২৩ বছর। এরপর বাকি ৩৪ বছর বেঁচে ছিলেন, কিন্তু সেটা বাকরুদ্ধ ও অবচেতন অবস্থায়।
কালের আবর্তে সময় হারিয়ে যায়। কিন্তু মানুষের কীর্তিসমূহ থেকে যায়। নজরুল একাধারে বিদ্রোহের কবি, প্রেমের কবি, সাম্যের কবি, অসাম্প্রদায়িক চেতনার কবি, মানবতার কবি। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিদ্রোহী কবি হিসেবে সমধিক পরিচিত।
নজরুলের বিদ্রোহী সত্ত্বা নিয়ে সুভাষ বসু লিখেছিলেন- “আমরা যখন যুদ্ধে যাব তখন নজরুলের গান গাওয়া হবে, আমরা যখন কারাগারে যাব তখন নজরুলের গান গাইব।”
নজরুলের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা মাধ্যমিকের বেশি যায়নি। কিন্তু প্রতিদিন পাঠ নিয়েছেন প্রকৃতি আর বাস্তবতা থেকে। টানাটানির সংসারে নজরুল কখনো ছিলেন মসজিদের মোয়াজ্জিন, মাজারের খাদেম, কখনো রুটির দোকানের কর্মচারী, আবার বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক। নজরুল ভালবাসতেন দেশকে, দেশের মাটিকে, ভালবাসতেন বাঙালিকে। নজরুলের অসংখ্য গানে ও কবিতায় তার বিদ্রোহী মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়।
নজরুল তিন হাজারের বেশি গান লিখেছিলেন। নজরুলের বিদ্রোহের সাথে সাথে ছিল অনন্য প্রেম। নজরুলকে বিদ্রোহী প্রেমিক বললেও ভুল হবে না। বিদ্রোহের সত্তায় জ্বলে উঠলেও প্রেমকে তিনি অস্বীকার করেননি। প্রেম আর বিদ্রোহকে সমান্তরাল এগিয়ে নিয়ে গেছেন নজরুল। রাজবন্দী হয়ে ছেলের প্রকোষ্টে গানের মাধ্যমে বিদ্রোহী সত্তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন তিনি। জেলের অন্ধকার প্রকোষ্টে বসে লিখেছেন…..
“কারার ঐ লৌহ কপাট / ভেঙ্গে ফেল কররে লোপাট / লাথি মেরে ভাংরে তালা / যতসব বন্দীশালায় আগুন জ্বালা, আগুন জ্বালা।”
নজরুলের এই গানের সাথে আমাদের রক্ত টগবগিয়ে উঠে। বিদ্রোহ জেগে উঠে সত্তায় মননে। বঞ্চিতজনদের নজরুল ভালবাসা আর সাহস যুগিয়েছেন গানের মাধ্যমে ।
“দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার হে / লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশিতে যাত্রীরা হুঁশিয়ার / ইহাদের পথে নিতে হবে দিতে হবে অধিকার।”
প্রেম নজরুলকে বিদ্রোহ থেকে দূরে সরাতে পারেনি। বিপ্লবী কবির কণ্ঠে তাইতো ধ্বনিত হয় যুদ্ধের দামামা যখন বেজে উঠে তখনÑ
“চল চল চল
ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল
নিম্নে উতলা ধরনী তল
অরুণ প্রাতের তরুণ দল
চল চল চল।”
বিদ্রোহের অনলে কবি কণ্ঠে জেগে উঠে-
“শিকল পরা ছল মোদের এ শিকল পরা ছল
এ শিকল পরেই শিকল তোদের করবরে বিকল।”
কবির এ গানের মাধ্যমে আমাদের চেতনা শাণিত হয় ।
১৯২১ সালের ১৭ নভেম্বর ব্রিটিশ ভাবী সম্রাটের আগমনে সারা ভারতের মতো কুমিল্লায়ও বিক্ষোভ হয়। নজরুল কুমিল্লায় প্রতিবাদ মিছিলে অংশ নিয়ে লিখেন ১৫৩ চরণের দীর্ঘ গান। এই গান গেয়ে শহর ঘুরে বেড়ালেন নজরুল।…….
“ভিক্ষা দাও! ভিক্ষা দাও!
ফিরে চাও ওগো পুরবাসী
সন্তান দ্বারে উপবাসী
দাও মানবতা ভিক্ষা দাও।
……….
মুক্ত করিতে বন্দিনী মা’য়
কোটি বীর সূত ঐ হের ধায়
মৃত্যু তোরণ দ্বার পানে কার টানে
দ্বার খোলো, দ্বার খোলো!”
১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে কুমিল্লা থেকে কলকাতায় ফিরে এসে লিখলেন বিদ্রোহী কবিতা। এই কবিতায় কবি জীবনের বিদ্রোহের চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। ঐ কবিতার কয়েকটি চরণ-
“আমি বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবেনা –
অত্যাচারীর খড়গকৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবেনা–
বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত।”
এর মাস দুয়েক পর ফের কুমিল্লা গেলেন কবি। সেখানে লিখলেন যুগান্তকারী কবিতা “প্রলয়োল্লাস”।
পরবর্তীতে কবিতাটি যে সুরারোপ করলে গান হিসেবে স্থায়ী আসন লাভ করে। কবিতার কিছু পংক্তি-
“তোরা সব জয়ধ্বনি কর !
তোরা সব জয়ধ্বনি কর!!
ঐ নতুনের কেতন ওড়ে কালবোশেখীর ঝড়।
তোরা জয়ধ্বনি কর!
তোরা জয়ধ্বনি কর!!
কাল ভয়ঙ্করের বেশে এবার ঐ আসে সুন্দর।
তোরা জয়ধ্বনি কর!
তোরা জয়ধ্বনি কর!!”
নজরুল ধূমকেতু-তে একটি কবিতা লিখেছিলেন ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ যার জন্য ১৯২৩ সালে জেলে যান। কবিতার কিছু পংক্তি এরকম-
“আর কতকাল থাকবে বেটি মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল?
স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী ব্যক্তি চাড়াল।
দেব শিশুদের মারছে চাবুক বীর যুবকদের দিচ্ছে ফাঁসি,
ভূ-ভারত আজ কসাইখানা ,আসবি কখন সর্বনাশী?
মাদিগুলোর আদি দোষ ঐ অহিংসা বোল নাকিনাকি
খাড়ায় কেটে কর মা বিনাশ নপুংসকের প্রেমের ফাঁকি।
…………………….
অনেক পাঠা মোষ খেয়ছিস রাক্ষুসী তোর যায়নি ক্ষুদা
আয় পাষাণী এবার নিবি আপন ছেলের রক্ত সুধা ।
……….
ময় ভূখাহুমায়ি বলে আয় এবার আনন্দময়ী
কৈলাস হতে গিরি রাণীর মা দুলালী কন্যা আয়!
আয় উমা আনন্দময়ী।’
ঊনআশি পংক্তির দীর্ঘ কবিতা। ভীরুদের প্রতি প্রচণ্ড ধিক্কার ও ব্রিটিশদের প্রতি দুর্বার ঘৃণা আর দেশপ্রেমীদের বিদ্রোহের ডাক।
জেলে বসে লিখেন বিখ্যাত কবিতা ‘সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’।
‘আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে
মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে মোর টগবগিয়ে খুন হাসে
আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে
আজ আমি আমার রুদ্ধ প্রাণের পল্ললে
বান ডেকে ঐ জাগল জোয়ার দুয়ার ভাঙ্গা কল্লোলে।”
১৯৩০ সালে প্রলয় শিখা কাব্যগ্রন্থের জন্য আবার জেল হয় কবির। প্রলয় শিখা কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতা নবভারতের হলদিঘাট কবিতায় বাঘা যতীনের বীরত্বগাঁথা নিয়ে লিখেছেন।
“বালাশোর বুড়ি বালামের তীর
নবভারতের হলদিঘাট
উদয় গোধূলি রঙ্গে রাঙ্গা হয়ে
উঠেছিল যার অস্তাপাট
…….
ভাবি ভারতের না চাহিতে আসা
নবীন প্রতাপ নেপোলিয়ন
ওই যতীন্দ্র রণোন্মত্ত
শনির সহিত অশনি রণ।”
যতীন দাস কবিতায় নজরুল লিখেছিলেন-
“মহিষ- অসুর- মর্দিনী মাগো
জাগো এইবার খড়গ ধরো
দিয়াছি যতীন অঞ্জলি নব-
ভারতের আঁখি ইন্দিবর।
…….”।
[এস ডি সুব্রত : কবি ও লেখক]