:: বিজন সেন রায় ::
আলফাত উদ্দিন আহমদ (মোক্তার সাহেব) অত্যন্ত দরদি মনের মানুষ ছিলেন। গরিব মেহনতি মানুষের জন্য ভালো কিছু করার তাঁর চেষ্টা ও আকাক্সক্ষা সর্বজন বিদিত। তাদের কল্যাণের জন্য তিনি অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন ও ঝুঁকি নিয়েছেন।
১৯৬৬-৬৭ সালের দিকে তৎকালীন ছোট্ট মহকুমা শহরে রাস্তাঘাট খুব একটা উন্নত ছিল না। গরিব রিক্সাচালকরা অত্যন্ত কষ্ট করে যাত্রী পরিবহন করতেন। একবার জনৈক প্রভাবশালী রিক্সামালিক একজন চালককে অন্যায়ভাবে শারীরিক নির্যাতন করায় আলফাত মোক্তার সাহেবের নিকট রিক্সাচালকগণ বিচারপ্রার্থী হন। মোক্তার সাহেব এর প্রতিবাদ করেন এবং এক পর্যায়ে শহরে রিক্সা ধর্মঘটের ডাক দেন। একনাগাড়ে কয়েকদিন রিক্সা ধর্মঘট হওয়ায় রিক্সাচালক পরিবারের খাবার ব্যবস্থা করা হয় এবং পরবর্তীতে উক্ত প্রভাবশালীর সাথে রিকসাচালকদের বিরোধ সম্মানজনক নিষ্পত্তি হয় এবং আহত রিক্সাচালকের চিকিৎসা খরচ ও ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য করা হয় প্রভাবশালী রিক্সামালিককে। সেই ১৯৬৬-৬৭ সাল থেকে রিক্সাশ্রমিকদের নিয়ে তাঁর প্রতিষ্ঠিত রিক্সা শ্রমিক ইউনিয়ন আজও টিকে আছে স্বমহিমায়।
আলফাত মোক্তার সাহেবের নিকট গরিব-নিরীহ মানুষদের কদর ছিল ভিন্ন মাত্রার। কোনো গরিব মানুষ তাঁর নিকট কোন অভাব-অভিযোগ করলে তিনি আর স্থির থাকতে পারতেন না। সাথে সাথে প্রতিকারের ব্যবস্থা নিতেন। সাধারণ লোকজনদের অত্যন্ত বিশ্বাস করতেন। যে কেউ কোনো অভিযোগ নিয়ে প্রথমে তাঁর কাছে বিচারপ্রার্থী হলে অন্য আর কোনো কিছু চিন্তা না করে প্রার্থিত লোকের বক্তব্য মতো প্রতিকারে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। প্রথম আগত ব্যক্তির বক্তব্য পুরোপুরি সত্য না হলেও মোক্তার সাহেবকে ক্ষান্ত করা কঠিন হয়ে পড়ত। খুবই সহজ-সরল ছিল তাঁর চিন্তার জগৎ, খুব সাদাসিধেভাবে জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন তিনি।
ছাত্রজীবনে আমি ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলাম। এই সুবাদে তাঁর সাথে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠ হওয়ায় তাঁকে চাচা বলে ডাকতাম। প্রতিটি রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যেমন জেলার অখণ্ডতা রক্ষার আন্দোলন, যাত্রীকল্যাণ সমিতি করে বাস ভাড়া বৃদ্ধি রোধ, ভাসানপানি আন্দোলন, ঝাউয়ার হাওরে কৃষক মালিকানা প্রতিষ্ঠা, ঘুষ-দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলনসহ প্রতিটি আন্দোলনে আমি চাচর সাথে থেকেছি এবং খুব কাছ থেকে তাঁকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। রাজনৈতিক কর্মসূচিতে ‘হরতাল’ হলে তিনি ভোর থেকে পুরাতন কলেজ প্রাঙ্গণের (বর্তমান আলফাত স্কয়ার) রাস্তার উপর অবস্থান নিতেন। মোক্তার সাহেবের এই সরব উপস্থিতি দেখে অন্য নেতা-কর্মীরা উৎসাহিত হতেন। হরতালে উক্ত স্থানে প্রায়ই তিনি রাস্তার উপর চেয়ার বা ব্যাঞ্চ নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতেন।
মোক্তার সাহেবের মৃত্যুর পর চারদিনব্যাপী শোক পালন কর্মসূচির শেষদিনে সর্বজন শ্রদ্ধেয় নেতা কমরেড বরুণ রায়ের সভাপতিত্বে পুরাতন কলেজ প্রাঙ্গণে (ট্রাফিক পয়েন্ট) শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। এই শোকসভা থেকে ট্রাফিক পয়েন্টকে ‘আলফাত স্কয়ার’ হিসেবে নামকরণের ঘোষণা দেয়া হয়। উক্ত নাগরিক শোকসভায় মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় জননেতা আব্দুস সামাদ আজাদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তসহ শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। পরবর্তীতে এ ব্যাপারে উদ্যোগ না নেয়ায় সেখানে ‘আলফাত স্কয়ার’ নামীয় আনুষ্ঠানিক নামফলক স্থাপিত হয়নি। তবে সুনামগঞ্জ থেকে প্রকাশিত সবগুলো পত্রিকা উক্ত স্থানকে আলফাত স্কয়ার হিসেবে সম্বোধন করে সংবাদ পরিবেশন করতে থাকে। পরবর্তীতে ২০১৫ সালে সুনামগঞ্জ পৌরসভার দায়িত্বপ্রাপ্ত মেয়র আয়ূব বখত জগলুল ট্রাফিক পয়েন্টকে ‘আলফাত স্কয়ার’ হিসেবে নামকরণের চূড়ান্ত কাজটি সম্পাদন করেন এবং সেখানে নামফলক স্থাপন করেন। যা সবার কাছে প্রশংসিত হয়।
আলফাত মোক্তার সাহেব যে গরিব রিক্সা শ্রমিকদের নিয়ে ভাবিত ছিলেন তার আরেকটি উদাহরণ পাওয়া যায় তাঁর মৃত্যুর পর। জীবদ্দশায় পূবালী ব্যাংক, সুনামগঞ্জ শাখায় আলফাত সাহেব গোপনে কিছু অর্থ জমা করে রাখেন। মৃত্যুর পর উক্ত টাকা ব্যাংকে রাখার সন্ধান পাওয়া যায়। খোঁজ নিয়ে জানাযায়, আলফাত সাহেব ১৯৮২ সনে পূবালী ব্যাংকে একটি এফডিআর-এর মাধ্যমে ১৬ হাজার টাকা জমা রাখেন। ব্যাংকের কাগজপত্রে শুধু এইটুকু লিখা ছিল- ‘আলফাত উদ্দিন আহমদ, রিক্সা শ্রমিক ইউনিয়ন, সুনামগঞ্জ’। উক্ত এফডিআর থেকে মোক্তার সাহেবের মৃত্যুর পরবর্তীতে লক্ষাধিক টাকা পাওয়া যায়।
তাঁর সহকর্মী ও মুক্তিযোদ্ধাদের থেকে জানাযায়, ১৯৭১ সনে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সুরমা নদী থেকে পাক হানাদার বাহিনী রসদ ও বিভিন্ন মালামাল ভর্তি বেশ কয়েকটি কার্গো মুক্তিবাহিনী আটক ও দখল করতে সক্ষম হয়। এইসব কার্গোর সমুদয় মালামাল বীর মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের হেফাজতে নিয়ে যান। পরবর্তীতে এসব মালামাল বিক্রি করে বেশ অর্থ পাওয়া যায়। বিক্রয়লব্ধ অর্থ থেকে শ্রমিক দরদি নেতা আলফাত সাহেব এফডিআরটি করে রাখেন।
মোক্তার সাহেবের মৃত্যুর পর তৎকালীন জেলা প্রশাসক হাবিবুল্লাহ মজুমদার ও শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এবং মরহুমের পরিবারের সদস্যরা আলোচনা করে আলফাত সাহেবের পক্ষ থেকে প্রদত্ত আরও কিছু অর্থ সমন্বয়ে মোট ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা দিয়ে ২০০১ সনে ‘আলফাত উদ্দিন আহমদ রিক্সা শ্রমিক ইউনিয়ন স্মৃতি ট্রাস্ট’ নামে গরিব ও রিক্সা শ্রমিকদের কল্যাণের লক্ষ্যে একটি ট্রাস্ট গঠন করা হয়। এই ট্রাস্টের চেয়ারম্যান হিসেবে জেলা প্রশাসক, সুনামগঞ্জ এবং সদস্য হিসেবে বিশিষ্ট নাগরিকবৃন্দ যুক্ত রয়েছেন। ২০০১ সালে ট্রাস্ট গঠনের পর থেকে এখন পর্যন্ত যে ক’জন জেলা প্রশাসক ট্রাস্ট পরিচালনার দায়িত্বে এসেছেন প্রত্যেকেই তাদের সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেছেন এবং আলফাত সাহেবের প্রবাসী দুই মেয়ে এবং অন্যান্য সদস্যগণের আর্থিক অনুদানে বর্তমানে ট্রাস্ট ফান্ডে স্থায়ী আমানত (এফডিআর)-এর পরিমাণ বেড়েছে। উক্ত স্থায়ী আমানতের লভ্যাংশ থেকে প্রতি বছর রিক্সাশ্রমিক ইউনিয়নের সদস্যদের উপহার ও আর্থিক সাহায্য দেয়া হয়।
শ্রমিক-মেহনতি মানুষের জন্য একজন আলফাত মোক্তারের অনবদ্য অবদান আমাদের জন্য যুগ যুগ ধরে আলোর দিশারী হয়ে থাকবে। এই মহান নেতার মৃত্যুবার্ষিকীতে জানই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।
[লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক সুনামকণ্ঠ]