কর্ণ বাবু দাস ::
২০১৯ সালের মে মাসের ৮ তারিখে লন্ডন থেকে দেশে আসেন জগন্নাথপুর উপজেলার আব্দুর গফুর নামে এক প্রবাসী। দেশে এসে সিলেটের হোটেল রাজরাণীতে ২১২ নাম্বার রুম উঠেন। হোটেলে এক রাত অবস্থান করেন। দেশে এসে প্রবাসীর বন্ধু জগন্নাথপুর উপজেলার নূরুল হককে কল দিয়ে বলেন- বন্ধু আমি তো দেশে এসেছি এখন সিলেট দরগাহগেইট হোটেল রাজরাণীতে আছি। আমার সাথে দেখা করো। তখন বন্ধু নূরুল হক বলেন- আমার মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান চলছে। তুমি আমার বাড়িতে চলে এসো।
কথাবার্তা শেষ হলে ফোন রেখে দেন তারা। এরপর থেকেই নিখোঁজ প্রবাসী আব্দুর গফুর। বন্ধু কিংবা পরিবার কারো সাথেই কোন যোগাযোগ নেই। কেউই জানেন না তিনি কোথায় আছেন। প্রবাসীর দু’জন স্ত্রী ছিল। একজন থাকতেন বাংলাদেশে, আরেকজন ছিলেন লন্ডনে। তাই তারা আব্দুর গফুরের অবস্থান নিয়ে সন্দিহান ছিলেন। একজন ভেবেছিলেন তিনি বাংলাদেশে আছেন, আরেকজন ভেবেছিলেন তিনি লন্ডনে আছেন। এই অবস্থায় কেটে যায় বহুদিন। দীর্ঘদিন পর প্রবাসীর বন্ধু নূরুল হক সিলেট কতোয়ালি থানায় নিখোঁজ ডায়েরি করেন। নিখোঁজ জিডি করেও তাকে না পাওয়ায় নূরুল হক জগন্নাথপুর থানায় আবার জিডি করেন। এবার জিডি তদন্তের দায়িত্ব পান চৌকস পুলিশ কর্মকর্তা এসআই হাবিবুর রহমান। তিনি ধীরে ধীরে তদন্ত শুরু করেন। জিডি’র সূত্র ধরে তদন্তে যান হোটেল রাজরাণীতে। সেখানে গিয়ে আব্দুর গফুরের খোঁজখবর নেন। হোটেলের রেজিস্ট্রার বই দেখতে চান। তবে ঘটনা দীর্ঘদিন আগের হওয়ায় হোটেল কর্তৃপক্ষ রেজিস্ট্রার বই বের করতে পারেনি এবং কোনো তথ্য দিতে পারেনি। হোটেল থেকে ফিরে আসার সময় এসআই হাবিবুর রহমান হোটেলের এক কর্মচারীর সাথে গোপনে কথা বলেন। তাকে রেজিস্ট্রার বই খোঁজে দিতে পারলে উপহার দিবেন বলে জানান। এরপর থেকে হোটেলের কর্মচারীর সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন। এক সপ্তাহ পর কর্মচারী জানান- রেজিস্ট্রার বই স্টোর রুমে পাওয়া গেছে। পরে এসআই হাবিবুর রহমান আবার হোটেলে যান এবং রেজিস্ট্রার বই চেক করেন। রেজিস্ট্রার বইয়ে একটি মোবাইল নাম্বারের সূত্র পান তিনি। এবার এই মোবাইল নাম্বারের সূত্র ধরে তদন্ত শুরু হয়। এই নাম্বারের কল লিস্ট চেক করে, আরেকজনের কাছ থেকে এই নাম্বার ব্যবহারকারী সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারেন। এই মোবাইল নাম্বারের ব্যবহারকারী জৈন্তার এক কবিরাজ। তার নাম আবুল কালাম। তখন তিনি কবিরাজের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। কবিরাজকে করে কল দিয়ে পরিচয় গোপন রেখে নিজের স্ত্রীর জন্য চিকিৎসা সহযোগিতা চান। কয়েকদিন কথা বলার পর কবিরাজ আবুল কালাম এসআই হাবিবুর রহমানকে তার স্ত্রীকে নিয়ে আস্তানায় যেতে বলেন। এসআই হাবিবুর রহমান কথামতো কবিরাজের আস্তানায় যান। গিয়ে তাকে নানা কৌশলে জৈন্তা থানায় নিয়ে আসেন। থানায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন। নিখোঁজ প্রবাসী আব্দুর গফুরকে চিনেন কিনা; তার সাথে কখনো দেখা হয়েছে কিনা; তার নাম্বার প্রবাসীর কাছে কিভাবে এলো, ইত্যাদি। প্রথমে কিছু স্বীকার না করলেও প্রবাসীর ছবি দেখালে মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যায় কবিরাজের। এক পর্যায়ে তিনি বলেন- প্রবাসী বেঁচে নেই; অনেকদিন আগে মারা গেছেন। একথা বলার পর পুলিশ প্রমাণ চায়। প্রমাণ করার জন্য কবিরাজ বলেন, তার মেয়ের বাড়িতে প্রবাসীর ভিসা, পাসপোর্ট, আইডি কার্ড, লাগেজ রয়েছে। এবার পুলিশ যায় কবিরাজের মেয়ের বাড়িতে। সেখানে গিয়ে এসব আলামত জব্দ করে। তখন কবিরাজকে বলা হয় আলামত দেখলেই প্রমাণ হবে না প্রবাসী আব্দুর গফুর মারা গেছেন। লাশ কোথায় দাফন করা হয়েছে ওইস্থানে গিয়ে লাশ দেখাতে হবে। যদি সত্যিই প্রবাসী আব্দুর গফুর মারা যাওয়ার প্রমাণ মিলে তাহলে কবিরাজকে ছেড়ে দেওয়া হবে। তখন কবিরাজ পুলিশকে সাথে নিয়ে কবরস্থানে যান এবং কবর দেখান। তারপর কবিরাজ আবুল কালামকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে আসে পুলিশ। আবার শুরু হয় জিজ্ঞাসাবাদ। জিজ্ঞাসাবাদে সে পুলিশকে চাঞ্চল্যকর তথ্য দেয়। এক পর্যায়ে কবিরাজ স্বীকার করে, প্রবাসীর সাথে কবিরাজের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। আব্দুর গফুর দেশে এসে কবিরাজের কাছ থেকে এর আগেও অনেকবার ঔষধ নিয়েছেন। সেদিনও দেশে এসে কবিরাজের সাথে যোগাযোগ করেন। ঔষধ নিতে কবিরাজের বাড়িতে আসেন। প্রবাসীর কাছে ছিল প্রায় ১০ লক্ষ টাকা এবং স্বর্ণসহ আরও মূল্যবান জিনিস। টাকা দেখে লোভে পড়ে যান কবিরাজ। ঔষধ দেওয়ার নাম করে খুন করেন প্রবাসীকে। প্রবাসীর কাছে টাকা-পয়সা, স্বর্ণসহ সবকিছু কেড়ে নেন এবং রাতের আঁধারে কবরস্থানে লাশ দাফন করেন। তারপর কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে নিজের পেশায় মনোযোগ দেন। ঘটনা সম্পর্কে কেউ কিছুই জানতো না। দীর্ঘদিন আরাম-আয়েশে জীবন কাটে কবিরাজ আবুল কালামের। কখনো ভাবতেই পারেনি ধরা পড়বে পুলিশের কাছে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে পুলিশ কবিরাজকে আদালতে তোলে। সে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়।