:: জয়শ্রী পাল জয়া ::
বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত কিছু পরিবারের মা-বাবা সন্তানকে বলেন- বড় হও, ধনী হও, টাকা কামাও, স্ট্যাটাস বানাও, ক্যারিয়ার বানাও কথাগুলো জপ করতে করতে এই বাবা-মায়েরা আমাদের বলতে ভুলে যান- বাবারা এবার একটু থামো, ভালোবাসো, কেউ বলে না, কেউ না। ছোটবেলা থেকেই এ ছেলেমেয়েদের দৌড়ের ঘোড়া বানানোর প্রক্রিয়া থাকে। আদর যত্ন ভালোবাসার সাথে সাথে বারবার মনে করিয়ে দেওয়া হয়, তোমাকে কিন্তু বড় হতে হবে, না হতে পারলে আমাদের মুখ উজ্জ্বল হবে না। তারপর সমাজে মুখ উজ্জ্বল করার খেলা চলতে চলতে একদিন শেষ হয়। স্ট্যাটাসের খেলা, ক্যারিয়ার গড়ার খেলা এমনকি আত্মীয়দের মধ্যে জিতে যাওয়ার খেলাও একদিন শেষ হয়। মা-বাবার বয়স হয়। বাবা-মা চায় এবার তাঁদের বাজির ঘোড়া ঘরে ফিরে আসুক কিন্তু ততদিনে ঘোড়া আরও জোরে দৌড়তে শিখে গেছে, সে থামতে শেখেনি।
হেলাল হাফিজ বলেছিলেন, কেউ বলেনি ক্লান্ত পথিক/দুপুর রোদে গাছের নিচে একটু বসে জিরিয়ে নিও…।
এ প্রসঙ্গে একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। কিছুদিন আগে সত্তরোর্ধ্ব এক ভদ্র লোকের সাথে ডাক্তারের চেম্বারে দেখা হলো। দাঁতের ব্যথায় এমনভাবে মুখ ফুলে গেছে যে, কথা বলতে পারছিলেন না। ডাক্তার বললেন- এখনই হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে। কিন্তু বয়স্ক লোকটি বললেন- আপনি যা পারেন করে দেন যেন ব্যথা উপশম হয়। লোকটির পিড়াপিড়িতে ডাক্তার কিছু অ্যান্টিবায়োটিক লিখে বাসায় পাঠিয়ে দিলেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, তাঁর দুই মেয়ে বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলে প্রকৌশলী দেশে চাকরি করতো। বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী বাঙালি মেয়েকে বিয়ে করে সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। মাসে মাসে কিছু টাকা বাবা-মায়ের জন্য পাঠিয়ে দেয় আর টেলিফোনে খোঁজখবর নেয় এই পর্যন্ত। লোকটির কষ্টে মনটা কেদেঁ উঠলো।
আবার দেশেও অনেকে বুড়ো মা-বাবাকে বোঝা মনে করে। আবার অনেকে বৃদ্ধাশ্রমেও পাঠিয়ে দেয়। আমরা অনেকেই পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের বিরক্ত বোধ করি। অথচ এই বয়োজ্যেষ্ঠরা আমাদের জীবনে কত যে আশীর্বাদ তা বুঝার ক্ষমতা আমাদের অনেকের মধ্যে নেই। একটু ভাবলে দেখা যাবে এই বয়োজ্যেষ্ঠদের হাত ধরে আমরা হাঁটতে, কথা বলতে শিখেছি। অথচ আজ বয়সের ভারে হয়ে গেছে আমাদের ‘বোঝা’। আমাদের কাছ থেকে একটু ভালো ব্যবহার পাওয়ার জন্য উনারা ব্যাকুল হয়ে সংসারের জন্য কিছু না কিছু করার চেষ্টা করেন। তাঁদের হৃদয়ের ব্যাকুলতা আমরা বুঝতা পারি না।
চোখ থাকলেও তাদের আকুলতা আমাদের হৃদয়ে ঢেউ তুলতে পারে না। অথচ দেখুন বয়োজ্যেষ্ঠদের বাড়িতে রেখে আমাদের সন্তানদের তাদের কাছে রেখে নিশ্চিন্ত মনে কর্মক্ষেত্রে চলে যাই। একদিন হয়তো এই বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষগুলো আমাদের মাঝে থাকবে না, ঘাড় থেকে আমাদের বোঝা নামবে কিন্তু তখন আমরা হয়তো নিশ্চিন্ত মনে কর্মক্ষেত্রে যেতে পারবো না। তাদের মূল্যবান উপদেশ আমাকে সঠিক পথে চলতে সাহায্য করে যা আমরা উপলব্ধি করতে পারি না। তাই আমাদের উচিত দাঁত থাকতে দাঁতের পরিচর্যা করা। আরেকটি বিষয় আমরা যেন আমাদের সন্তানদের সামনে বয়োজ্যেষ্ঠদের সাথে সম্মানের সহিত কথা বলি। অনেকেই দেখা যায় তার সন্তানদের সামনে মা-বাবাকে অসম্মান করে কথা বলে থাকেন কিন্তু একবারও কি ভাবেছেন এই সন্তানটি আপনার কাছ থেকে কী শিক্ষা পাচ্ছে? সেও কি ভবিষ্যতে তারা বাবা মায়ের সাথে এরকম আচরণ করবে না? সন্তানটি যত বড়ি নামি-দামী স্কুল বা কলেজে পড়ুক না কেন, সে আসল শিক্ষা পাচ্ছে তার পরিবার থেকে। তাই আমাদের উচিত বড়দের সাথে ভালো ব্যবহার করা। একদিন আমরাও বয়স্ক হবো তখন আমাদের সন্তান আমাদের সাথে এর চেয়েও ভয়ঙ্কর আচরণ করবে না তার কি নিশ্চয়তা আছে? আসুন বয়োজ্যেষ্ঠদের অবহেলা না করে একটু ভালবাসা দিয়ে জীবনটাকে সুন্দর ও আনন্দময় করে তুলি। ভালোবাসলে ভালোবাসা পাওয়া যায়।