গত শুক্রবার (১৯ মার্চ ২০২১) দৈনিক সুনামকণ্ঠের এক উদ্ধৃত সংবাদপ্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, ‘জলমহাল ইজারাদারি প্রথা ভীষণ অন্যায়Ñ পরিকল্পনামন্ত্রী।’ প্রতিবেদনটিতে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান চূড়ান্ত বিবেচনায় দেশের আর্থনীতিক বিভিন্ন জরুরি প্রসঙ্গ নিয়ে তাঁর প্রাতিস্বিক চিন্তার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। তিনি নিজে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ শরিক এই সত্যটি তিনি অস্বীকার করতে পারেন না, সরকারে থেকে সেটি তাঁর পক্ষে সম্ভবও নয়, কিন্তু সরকারের গৃহীত কোনও কোনও নীতির বা আগে থেকেই প্রচলিত প্রথার তিনি একবারে অন্ধ সমর্থক নন, তা জানিয়ে দিতেও কসুর কারেন না এবং প্রকারান্তরে নীতিগত দিক থেকে বিবেচনায় সরকারের ইতিবাচক সমালোচনা করতে দ্বিধা করেন না।
সেই একাত্তরের পরবর্তী দুয়েক দশকে সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলে বিল ইজারাদারির বিরুদ্ধে ভাসানপানির আলোড়ন সৃষ্টিকারী আন্দোলন করেছিলেন এখানকার বাম রাজনীতির প্রতিনিধিরা। তাঁরা জলমহাল ইজারা দেওয়ার সরকারী নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তখন বিল ইজারা দেওয়ার প্রথাটির বিলুপ্তির আওয়াজ তুলেছিলেন। অতীতের বাম রাজনীতির দাবি তখন উপেক্ষিত হয়েছিল এবং দীর্ঘ দশকদুয়েক কাল অতিক্রান্তের পর এখন সে উপেক্ষার অবসানের ইঙ্গিত পরিলক্ষিত হচ্ছে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে।
তারই (উপেক্ষার অবসানের) মৃদুমন্দ উঙ্গিত পাওয়া যায় একজন মন্ত্রীর প্রাতিস্বিক অভিমতানুসারে যখন বলা হয়, ‘ইজারাদারি প্রথাটা ভীষণ অন্যায় একটা প্রথা। কিন্তু জলমহাল ইজারা সরকারের নীতি এবং সরকারের অধীনে আমাকেও তা মানতে হয়। কিন্তু এখানে দেখা যায় বর্ষাকালে বিলের সীমানা থাকে না, কিন্তু পুরো বিলকে ইজারাদার নিজের বিল ঘোষণা করে দেয় এবং কোনো গরিব মানুষকে এখানে মাছ ধরতে দেয় না। লিজ নেওয়া এলাকার তুলনায় কয়েকগুণ বিস্তৃত এলাকায় গায়ের জোরে কব্জা করে। এ প্রথার বিরুদ্ধে আমি সক্রিয়ভাবেই আপনাদের সঙ্গে আছি।’ তখন সাধারণ মানুষ কীছুটা হলেও আশ্বস্ত হন বইকি। তিনি জানান দিয়েছেন, তিনি ইজারাদারের পক্ষে নন, সাধারণ মানুষের পক্ষে আছেন, তাঁর এই জনবান্ধব মানসতাকে অভিনন্দন জানাই, তাঁকে জানাই সাধুবাদ।
কিন্তু এই মওকায় একটা কথা এখানে বলে নিতে চাই। তিনি বলেছেন সরকারের অধীনে আছেন বলে ইজারা প্রথাকে তিনি মেনে চলেন। বিপরীতে সরকারের অধীনে যাঁরা ইজারা নিচ্ছেন তাঁরা তো এই ইজারা প্রথার কোনও নীতিকেই মানছেন না। সকলেই জানেন ইজারা প্রথার একটি নীতি আছে, ইজারা নেওয়া বিল শুকিয়ে মাছ ধরা যাবে না। কিন্তু ইজারাদাররা তা মানছেন না। তাঁরা বিল শুকিয়ে মাছ ধরছেন। প্রশাসন এই ইজারানীতি লঙ্ঘনের কোনও প্রতিরোধ-প্রতিকার করছে না এবং ক্ষেত্রবিশেষে সাধারণ মানুষ এই নীতিবিগর্হিত কাজের প্রতিরোধ করতে গিয়ে বিপাকে পড়ছেন। সম্প্রতি জানা গেলো, ইতিপূর্বে (অর্থাৎ কীছু দিন আগে) দিরাই-শল্লার নোয়াগাঁয়ের মানুষেরা জনৈক ইজারাদার স্বাধীন মিয়ার বিল শুকিয়ে মাছ ধরার বিরোধিতা করেন, এর জের ধরে (অর্থাৎ প্রতিশোধ নেওয়ার অভিপ্রায়ে) পরবর্তীতে স্বাধীন মিয়ার প্ররোচনায় ও সক্রিয় উদ্যোগে (কিংবা বলা ভালো নেতেৃত্বে) গত বুধবার (১৭ মার্চ ২০২১) নোয়গাঁওয়ের বাড়িঘরে শত শত সন্ত্রাসীর হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে এবং সেখানে মুসলমানদের স্পর্শকাতর ধর্মীয় ভাবানুভূতিকে আক্রমণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে সুকৌশলে।
বিল ইজারা প্রথা বাতিলের দাবি অনেক পুরনো একটি দাবি। সকলেই জানেন, এ দাবি নিয়ে ভাসানপানির আন্দোলন হয়ে গেছে ভাটি অঞ্চলে। আমরা ইজারা প্রথা বাতিলের পক্ষপাতী। বাতিল সম্ভব না হলেও এই আইনটিকে আরও আধুনিক ও যুগোপযোগী অথবা যুগপৎ প্রকৃতি ও মানববান্ধব করে তোলা এখন পরিবর্তিত কালের প্রেক্ষিতে অনিবার্য হয়ে উঠেছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু বাতিল না হওয়ার আগে পর্যন্ত ইজারা নেওয়ার সুযোগে ইজারাদাররা সাধারণ মানুষের উপর যে-সব অন্যায়-অত্যাচার করে থাকেন, সেগুলো আপাতত বন্ধ করার জন্যে সরকার-প্রশাসনের পক্ষ থেকে কঠোর আইনি পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি বলে বিদগ্ধ মহল মনে করেন। ইজারাদার স্বাধীন মিয়াদের স্বাধীনতাকে মেনে নেওয়া কোনও সরকারের পক্ষেই মঙ্গলজনক হতে পারে না। এতে সরকারের জনপ্রিয়তা সংকুচিত হয়। স্বাধীন মিয়ার বিল শুকিয়ে মাছ ধরার তদন্ত হোক এবং এর বিচার আমরা চাই জনগণের পক্ষ থেকে। ভুলে গেলে চলবে না, রাষ্ট্র স্বাধীন মিয়াদের পৈতৃক সম্পত্তি নয়।