‘সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট’ দৈনিক সুনামকণ্ঠে (১৮ মার্চ ২০২১) এমন শিরোনাম দিয়ে সংবাদ ছাপা হয়েছে। ঘটনা ঘটেছে গত বুধবার (১৭ মার্চ) সকালে। পত্রিকায় লেখা হয়েছে, ‘বুধবার সকালে দিরাই উপজেলার নাচনি, চণ্ডিপুর, সন্তোষপুর, সরমঙ্গল, শাল্লার কাশিপুরসহ কয়েকটি গ্রামের লোকজন শাল্লার হিন্দু অধ্যুষিত গ্রাম নোয়াগাঁয়ে এই তাণ্ডব চালায়।’ ঘটনাটি ঘটেছে নয় বরং বলা উচিত ঘটানো হয়েছে একজন ‘বড় হুজুরের সম্মান নষ্ট করা’র অজুহাতে। এই ‘বড় হুজুর’ একজন হেফাজতপন্থী নেতা। অর্থাৎ এখানে ধর্মকে টেনে আনা হয়েছে। এইভাবে ধর্মকে ব্যবহার করে একাত্তরেও এই অঞ্চলে লুটপাট চালানো হয়েছিল হিন্দুদের বাড়িঘরে এবং প্রকারান্তরে দখল করে নেওয়া হয়েছিল হিন্দুদের সমস্ত সম্পত্তি এবং স্থাবর সম্পত্তির মতো লুট করা হয়েছিল হিন্দু নারীদেরকে এবং ধর্ষণ করে মেরে ফেলা হয়েছিল। উক্ত ঘটনা বারণনিরসনের বিষয়ে প্রশাসনিক ভূমিকার সমালোচনা করে পত্রিকান্তরে প্রশাসনের ব্যর্থতার অভিযোগ উঠেছে।
পৃথিবী অনেক এগিয়েছে। আফ্রিকাকে একদা অন্ধকার মহাদেশ বলা হতো। সেখানে বর্ণবাদী প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে অক্লান্ত সংগ্রামী নেলসন ম্যান্ডেলার মতো মানবতাবাদীর জন্ম হয়েছে। তাঁর হাত ধরে অন্ধকার জগতের মানুষেরা আলোর জগতে পদার্পণ করেছে। বাংলাদেশে মানবতাবাদী নেতা বঙ্গবন্ধুর জন্ম হয়েছে, জাতি তাঁকে বঙ্গবন্ধু থেকে জাতির জনকের স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু আফ্রিকা যেমন নেলসন ম্যান্ডেলার আদর্শকে গ্রহণ-ধারণ করতে পেরেছে বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে তেমন করে গ্রহণ-ধারণ করতে পারে নি। আসলে বাংলাদেশ মেধামনন-মানসতায় পিছিয়েই আছে। তা না হলে এই দেশের সর্বত্র, বিশেষ করে দিরাই-শাল্লার, যত্রতত্র এতসব অমানবিক ঘটনা ঘটতো না। ভুলে গেলে চলবে না, এই দিরাই শাল্লা একদা মহান মানবতাবাদী বরুণ রায়ের রাজনীতিক কর্মক্ষেত্র ছিল এবং বলা হয় দিরাই-শাল্লা প্রগতিশীল রাজনীতির আঁতুরঘর। কিন্তু প্রদীপের নিচে অন্ধকার থাকার মতো মানবতার চাদোয়ার নিচে বর্বরতার অন্ধকার থেকেই গেছে, এই বাস্তবতারই প্রতিফলন ঘটলো এবার সংঘটিত নোয়াগাঁওকাণ্ডে। আবার প্রতিপন্ন হলো, দিরাই শাল্লা বঙ্গবন্ধু কিংবা বরুণ রায় কাউকেই গ্রহণ-ধারণ করতে পারে নি। পরিকল্পিত উপায়ে সচেতনতার সঙ্গে, রাজনীতিকে ব্যবহার করে, সদম্ভে চোরেরগাঁও জ্বালিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছিল এখানেই একদিন, দশকদুয়েক অতীতে। ভূলুণ্ঠিত মানবিকতার উদাহরণ হিসেবে সেটা ভুলে যাবার মতো কোনও ঘটনা নয়।
ভেবে দেখা দরকার, এখানে এবার কী ঘটছে। বিদগ্ধ মহলের ধারণা, এখানে সেই পাকিস্তান আমল থেকেই কতিপয় ধনাঢ্য মানুষ তাদের একান্ত ব্যক্তিগত ও পারিবারিক স্বার্থে এক ধরনের গোষ্ঠীতান্ত্রিক চক্র গড়ে তোলেছে এবং ধর্মকে ব্যবহার করে নিজেদের জাগতিক, অর্থাৎ আর্থনীতিক, স্বার্থ হাসিল করার প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে। এ কারণে তারা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করতে কসুর করেনি, এই প্রক্রিয়া এখনও পর্যন্ত তারা অব্যাহত রেখেছে এবং এই প্রকরণটি তাদের মধ্যে একটি স্থায়ী গোষ্ঠীতান্ত্রিক রাজনীতির জন্ম দিয়েছে। এই গোষ্ঠীতান্ত্রিক রাজনীতির কর্মসূচি নিয়ে একদার স্বাধীনতাবিরোধীরা এখন স্বাধীনতার পক্ষের দলে ভিড়ে গিয়ে প্রকৃতপ্রস্তাবে এক অভিনব প্রক্রিয়ায় স্বাধীনতার বিরোধিতার রাজনীতিরই এক ধরনের উজ্জীবন ঘটিয়েছে। এই প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির ভাবমূর্তিটাই এখানকার সাধারণ মানুষদের চেতনায় একটি বিকল্প সমাজমানসতায় পর্যবসিত হয়েছে। এই সমাজমানসতা তাদেরকে বার বার বর্বর হতে অনুপ্রাণিত করছে এবং তারা ধর্মের নামে নোয়াগাঁওকাণ্ড সংঘটনে কসুর করছে না। এর সমাধান কী হতে পারে, এমন ভাবনায় ভাবিত হলে, একটাই সমাধান সামনে আসে, আর সেটি হলো দিরাই-শাল্লায় একটি শুদ্ধি অভিযান চালাতে হবে এবং সর্বাগ্রে এইসব প্রতিক্রিয়াশীল ধনাঢ্য পরিবারগুলোর মানসতাকে প্রগতিশীল করে তোলার আগে এদের আর্থনীতিক ভিতটিকে গুঁড়িয়ে দিতে হবে। এদের আর্থনীতিক ভিতটিকে গুঁড়িয়ে দিতে না পারলে তারা ধর্মকে আর্থনীতিক স্বার্থে ব্যবহার করতে যে পারে সেই পারঙ্গমতাকে গুঁড়িয়ে দেওয়া যাবে না। আর এটি না পারলে এখানে বার বার নোয়াগাঁওকাণ্ড ঘটতেই থাকবে। চোরেরগাঁও তারা আবার পুড়িয়ে দেবে অতীতে একদিন যেমন দিয়েছিল, কিন্তু এই চোরদের সম্পদ কে চুরি করে নেয় এবং চোররা বাঁচার জন্যে চুরি করে, এই আর্থনীতিক রহস্যটি নিয়ে তারা কোনও দিনই মাথা ঘামাবে না এবং প্রকারান্তরে মানবিক না হয়ে অমানবিক হবে, ধর্মের নামে অধর্ম চরিতার্থ করে বরাবরের মতো আরও বর্বর হয়ে উঠবে।