1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
  3. [email protected] : wp-needuser : wp-needuser
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ১২:৫৯ অপরাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

শাল্লায় অনিয়ম থামছে না : অক্ষত বাঁধে বরাদ্দ লাখ লাখ টাকা

  • আপডেট সময় রবিবার, ৭ মার্চ, ২০২১

জয়ন্ত সেন ::
হাওরের বোরো ফসলরক্ষায় অপ্রয়োজনীয় ও অক্ষত বাঁধে লাখ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়ে সরকারের অর্থের অপচয় করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। শুধু তাই নয়, বাঁধে বাঁধে চলছে নানা অনিয়মও। সরেজমিনে গিয়ে এমন তথ্যই পাওয়া যায়।
উপজেলার কালিকোটা হাওর উপ-প্রকল্পের আওতায় রাহুতলা বাজার হতে রাহুতলা কবরস্থান পর্যন্ত ১,২৫৪মি. বাঁধের ভাঙ্গা বন্ধকরণ ও মেরামত কাজে ৭০নং পিআইসিকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে প্রায় সাড়ে ১৫ লাখ টাকা। বাঁধে গিয়ে কথা হয় ওই বাঁধের সভাপতি আলীম উদ্দিনের সাথে। তিনি বলেন, এখানে বাঁধেরই প্রয়োজন নাই। এখানে আশ্বিন মাসে পানি উঠে। আষাঢ় মাসে তো পানি উঠে না আর এখানে পানি উঠলে হাওয়ার বাঁধ কেনো কোনো বাঁধই ঠিকবে না। তবে এখানে ৪শ’ মি. দিলেই হতো আর ৮শ’ মি. না দিলেও হইত। বাজারের পশ্চিম অংশেও দক্ষিণ দিকে না দিলেও চলতো। কারণ, উত্তরে বাজার আছে। রাহুতলা গ্রামের দক্ষিণ দিকে বাঁধ না দিলেও চলতো। এসময় উপস্থিত জনতাও বলেন জরিপ করার সময় স্থানীয়দের মতামত নেয়নি জরিপকারীরা।
ছায়ার হাওর উপ-প্রকল্পের আওতায় বিষ্ণুপুর গ্রাম হতে বিষ্ণুপুর নতুন হাটি পর্যন্ত ৫০০মি. কান্দার উপর দিয়ে অপ্রয়োজনীয় বাঁধে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৮ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। স্থানীয়রা বলছেন, এখানে বাঁধ লাগে না।
১৩২নং পিআইসির সভাপতি শ্রীহরি দাসকে প্রকল্প এলাকায় পাওয়া যায়নি। ১৩৩ নং পিআইসিতে কোনো সাইনবোর্ড পাওয়া যায়নি। খোঁজ নিয়ে জানা যায় ওই পিআইসির সভাপতি কিশোরগঞ্জ জেলার ধনপুর ইউপি চেয়ারম্যান হরনাথ দাস।
বিষ্ণুপুর গ্রামের বাসিন্দা বাবুল দাস বলেন, হরনাথ চেয়ারম্যানের জমিই নাই এই হাওরে। বাড়ি বাঁধ থেকে সাড়ে ৩কিলোমিটার দূরে। বাঁধের অনেক জায়গা অক্ষত। একেবারে বাঁধের গোড়া থেকে এক্সেভেটর দিয়ে মাটি তুলছেন তিনি। বিষ্ণুপুর নতুন হাটি হতে সেচ পা¤েপর পূর্ব পর্যন্ত। ৪৮৫ মি. বাঁধে বরাদ্দ প্রায় সাড়ে ১৫লাখ টাকা।
মুঠোফোনে হরনাথ দাস বলেন আমি প্রতি বছরই পিআইসি পাই। জমি নাই তো কি হয়েছে? আমি চেয়ারম্যান হিসাবে আমার অধিকার নাই?
ছায়ার হাওর ১৪৯নং পিআইসির সভাপতি মানিক মিয়ার বাঁধে অনিয়মের যেনো শেষ নেই। বাঁধেই গোড়া থেকে মাটি কাটা, কোথাও আবার অক্ষত বাঁধের উপরের ১ফুট মাটি এস্কেভেটর দিয়ে সরিয়ে লেভেল করা হচ্ছে। কোথাও কাদা মাটি দেওয়া হচ্ছে বাঁধের উপরে। সুরমা নদীরপাড় কেটেও মাটি তোলা হচ্ছে। মানিক মিয়া বলেন, আমি আর জীবনে পিআইসি নেবো না। তার ১২০৯মি. বাঁধে বরাদ্দ ১৮লাখ ৫২ হাজার টাকা।
ছায়ার হাওর কোকরার খাল হতে জরাইন্না খালের পূর্ব পর্যন্ত ১৪৫ নং পিআইসির সভাপতি বানেশ্বর সরকারের ১০২৮মি. অক্ষত বাঁধে বরাদ্দ ১৫ লাখ ৬৩ হাজার টাকা। ১ফুট আবার কোথাও ৬ইঞ্চি মাটি ফেলা হচ্ছে। পুরনো বাঁধে মাটি না কাটলেও হতো বলে জানান এলাকাবাসী।
শ্মশান হতে শ্যামপুর বাজার পর্যন্ত ৯১১মি. অক্ষত বাঁধে বরাদ্দ ১৫লাখ ১৭হাজার টাকা। পূর্বে শ্যামপুর গ্রাম রয়েছে পশ্চিমে সুরমার তীরে বাঁধ। অল্প অল্প মাটি কেটে দায়সারাভাবে কাজ শেষ করা হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, সভাপতি অমর সরকারের ১৪৭নং পিআইসিতে গ্রামের ছোট একটি ভাঙ্গা বন্ধ করলেই সরকারের অন্তত ১০লাখ টাকা বেঁচে যেতো।
১৪৮ নং পিআইসিও ১৩২১মি. বাঁধে উপরে ১ফুট মাটি ফেলছেন। এছাড়াও ১৩৬, ১৩৭, ১৩১সহ অনেক বাঁধেই কাদামাটি দিয়ে বাঁধ তৈরি করতে দেখা যায়। বাঁধে রয়েছে মাটিমিশ্রিত বালু। যা বাঁধকে দুর্বল করে দিবে বলে জানান স্থানীয়রা।
সভাপতি হাবিবুর রহমানের ১৪০ নং পিআইসিতে নীতিমালা লঙ্ঘন করে গোড়া থেকে মাটি উত্তোলন হচ্ছে। বাঁধে সাইনবোর্ডও নেই। তিনিও প্রতি বছর পিআইসি নেন বলে জানা যায়।
অন্যদিকে, কালিকোটা হাওরে ৬৭ ও ৬৮ নং পিআইসির বাঁধ কান্দার উপর দিয়ে নেওয়া হয়েছে। ৬৭নং পিআইসির সভাপতি শফিকুল ইসলামের ৬১৩ মি. বাঁধে বরাদ্দ ১৬লাখ ৫৭হাজার টাকা আর ৬৮নং পিআইসির সভাপতি ছাদিরুল ইসলামের ৭৫২মি. বাঁধে বরাদ্দ ১৫লাখ ৫৭হাজার টাকা। এসব বাঁধ হাওরের প্রাকৃতিক অবকাঠামোকে নষ্ট করে দিচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে গোচারণ ভূমি, ধান মাড়াই ও খড় শুকানোর জায়গা।
আটগাঁও ইউপির নিজগাঁও গ্রামের বাসিন্দা মঈন উদ্দিন বলেন রাহুতলা, মির্জাপুরের ২টি বাঁধ এইখানে লাগেই না। এইডারে আরো নষ্ট করতাছে। মাইট্রল দিয়া একদিনে কাটাইলেই অইবো। একই কথা আরো অনেকই জানান।
এ বিষয়ে পাউবোর শাখা কর্মকর্তা আব্দুল কাইয়ুম বলেন, ১৫৬টা বাঁধে বরাদ্দ হয়েছে ২৩ কোটি ৩৩ লাখ ১৬ হাজার টাকা। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, অপ্রয়োজনীয় এই প্রশ্নের উত্তর আমি বহুবার দিয়েছি। অপ্রয়োজনীয় কথাটা বলতে হলে আগে সার্ভে কইরা বলতে হবে। হাওরের যে এলার্মেন্ট আছে-এলার্মেন্ট অনুযায়ী আমাদের ডিজাইন দেওয়া আছে। অতিরিক্ত বরাদ্দের বিষয়ে তিনি বলেন, এইডাও সার্ভের উপর নির্ভর করতাছে।
জমি নাই এমন লোক পিআইসি পেয়েছে, অনেক বাঁধ অপ্রয়োজনীয় ও অতিরিক্ত বরাদ্দের বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আল মুক্তাদির হোসেন বলেন, কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল গত ২৮ তারিখে। এখন এইগুলো বলে তো সমাধান করা যাবে না। এখন কোনো বাঁধে ত্রুটি আছে কিনা সেটা দেখেন আর যখন পিআইসির কমিটি করবো তখন উপজেলা কমিটিকে এই কথাগুলো বলবেন।
তবে সুনামগঞ্জ জেলা পাউবো-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী শামসুদ্দোহার মুঠোফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।
উল্লেখ্য যে, দেশের একমাত্র দুর্গম ও উন্নয়নের দিক থেকেও সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া সুনামগঞ্জ জেলার শাল্লা উপজেলা। ২৫৬.০৩ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের-এ উপজেলায় ১লাখ ১৩ হাজারেরও অধিক জনসংখ্যা রয়েছে। তবে দরিদ্র্য মানুষের সংখ্যাই বেশি। কারণ, এলাকাটি একমাত্র বোরো ফসলের উপর নির্ভরশীল। স্বাধীনতার পূর্বে ও পরে হাওরের সোনালী ফসল রক্ষার ক্ষেত্রে উদাসীনতাই পরিলক্ষিত হচ্ছে। ফলে অতিখরা, অতিবৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি ও অনাবৃষ্টির কারণে এসব অঞ্চলের মানুষ বেঁচে থাকার জন্য রীতিমত প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করতে হতো। ২০১৭ সালে অকাল বন্যায় দেশের সাতটি জেলার ফসল তলিয়ে যায়। চারিদিকে তখন হাহাকার অবস্থা। সুনামগঞ্জ পাউবোর অফিস ঘেরাও করে বিক্ষোভকারী কৃষক-জনতা। এমন পরিস্থিতিতে নড়েচড়ে বসে সরকার। ৩০ এপ্রিল ২০১৭ সালে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আসেন দুর্গম উপজেলা শাল্লায়। কৃষকের ত্রাতা হয়ে পাশে দাঁড়ান তিনি। খাদ্যশস্য ও নগদ অর্থ দিয়ে খেটে খাওয়া কৃষকদের দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা থেকে রক্ষা করেন শেখ হাসিনার সরকার। পাশাপাশি কৃষকের ফসল নির্বিঘ্নে ঘরে তোলার জন্য বাতিল করা হয় ঠিকাদারি প্রথা। ২০১৭ সালের সংশোধিত কাবিটা স্কিম বাস্তবায়নে নীতিমালা অনুযায়ী গঠন করা হয় পিআইসি। হাওরে জমি আছে এমন কৃষকরাই পিআইসি কমিটি গঠনের মাধ্যমে হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধের দায়িত্বে থাকবেন। কিন্তু এতেও রয়েছে নানা অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতি। পাউবো নানা কৌশলে অক্ষত বাঁধেও লাখ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়ে সরকারি অর্থ লুটপাটের ক্ষেত্র তৈরি করেছে। নীতিমালা অনুযায়ী ২৮ ফেব্রুয়ারি বাঁধের কাজ শেষ করার কথা থাকলেও শেষ হয়নি বাঁধের কাজ। পরে দ্বিতীয় দফায় সময় বাড়ানো হয় ৭মার্চ পর্যন্ত। কিন্তু সময় বৃদ্ধি করা হলেও এখনো বাঁধের কাজ শতভাগ স¤পন্ন হয়নি। অন্যদিকে শুধু সার্ভের দোহাই দিয়ে সরকারের কোটি কোটি টাকা অপচয় করা হচ্ছে বলে মত উপজেলার সচেতন নাগরিকদের। অনেকই বাঁধের বিকল্প হিসেবে নদী খননের উপর জোর দিয়েছেন।
অধ্যাপক তরুণ কান্তি দাস বলেন হাওরের এই অনিয়ম ও দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে গেলে হাওরের জন্য আলাদা মন্ত্রণালয় গঠন করা প্রয়োজন। তাহলেই এর সঠিক সমাধান হবে। পাশাপাশি হাওরের উন্নয়নও ত্বরান্বিত হবে আর নদী খনন এখন সময়ের দাবি বলে তিনি জানান।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com