‘তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে তার ওপর নির্যাতন করা হয় …’। সম্প্রতি কারাগার থেকে জামিনে ছাড়া পাওয়া একজন এমন অভিযোগ করেছেন। সংবাদটি জাতীয় একটি দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর এই অভিযোগটি কতোটা সত্যি সেটা কেউ জানে না। তাঁর হাতে কোনও প্রমাণ নেই। তবে তেমন একটা কীছু হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে, ইতিহাসে তার প্রমাণ আছে ভুরি ভুরি। তাই প্রমাণ না পেয়েও তাঁর কথাকে উড়িয়ে দেওয়ার কোনও যুক্তি আছে বলেও মনে হয় না। খতিয়ে দেখা দরকার এবং তার চেয়েও বেশি দরকার এমন অমানবিকতাকে রাষ্ট্রপক্ষ থেকেই সুনিশ্চিতভাবে দূর করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা। তা না হলে ‘রাষ্ট্র একটি নিপীড়ক যন্ত্র’ এই অভিযোগ থেকে রাষ্ট্র নিজেকে মুক্ত করতে পারবে না।
প্রশাসনের হাতে আটক হওয়া ব্যক্তিদের এমন অভিযোগ করার একটি রীতি প্রচলিত আছে সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই। ব্রিটিশ আমলে কবি নজরুলকেও আটকাবস্থায় নির্যাতন করা হয়েছিল এমন অভিযোগ আছে। ব্রিটিশ আমল ও পাকিস্তান আমলে সকল রাজনৈতিক বন্দিকেই নির্যাতনের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। আমরা সাধারণ মানুষেরা সভা-সমিতিতে জড়ো হয়ে কারামুক্ত নেতার ভাষণের বদৌলতে সে-সব লোমহর্ষক বয়ার্ণনা (বয়ান+বর্ণনা) শুনেছি। এই তালিকায় বঙ্গবন্ধু যেমন আছেন, তেমনি আছেন আমাদের বরুণদা কিংবা হোসন বখত।
ব্রিটিশ শাসনামলে এমন কি পাকিস্তানি আমলেও বাংলাদেশে রাষ্ট্রব্যবস্থা ছিল ঔপনিবেশিক এবং মূলত শাসনবৈশিষ্ট্যের দিক থেকে নির্যাতনমূলক। পাকিস্তান আমলে কমিউনিস্ট নেত্রী ইলা মিত্রকে পুলিশ নির্যাতন করেছিল তাঁর লজ্জাস্থানে গরম সিদ্ধ ডিম ঢুকিয়ে দিয়ে। এই বর্বরতা চর্চার কোনও প্রয়োজন ছিল না। ২০২১ সালে উপনীত হয়ে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে কারাগার তুলে দেওয়ার উদ্যোগ যেখানে গ্রহণ করা হচ্ছে কোনও কোনও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এবং তাছাড়া আমরা এখন স্বাধীন হয়েছি, এমতাবস্থায় ঔপনিবেশিক আমলের মতো আটককৃত ব্যক্তির উপর বর্বর পদ্ধতিতে নির্যাতন করার একটা অন্যরকম অর্থ দাঁড়ায়।
বিদগ্ধ মহলের ধারণা এই যে, যে-কোনও রাষ্ট্রের পক্ষে আরও আরও মানবিক হওয়ার উদ্যোগকে পরিহার করা কোনও যুক্তিতেই সঙ্গত নয়। এই বিবেচনায় অবিমৃষ্যকর নির্যাতনের দায় রাষ্ট্র এড়াতে পারে না, কীছুতেই। এই তো কীছু দিন আগে একজন ওসি ক্ষমতার অপব্যবহার করে একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাকে গুলি করে মেরে ফেললেন, রাষ্ট্রের প্রশাসনিক ছত্রছায়ার শরণাগত হয়ে। আমাদের রাষ্ট্র কিন্তু সে দায় নেয় নি, এই ওসির বিচার চলছে। তাই প্রকাশিত সংবাদ থেকে যখন অবগত হওয়া যায় যে, কোনও নাগরিককে ‘তুলে নিয়ে যাওয়ার পর অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে তার ওপর নির্যাতন করা’ হয়েছে, সে-ক্ষেত্রে প্রশ্ন থেকেই যায় রাষ্ট্র ব্যবস্থা এমন কেন হবে, যে-ব্যবস্থার অধীনে মানুষ মানুষের উপর ক্ষমতার অপব্যবহার করার বা নির্যাতন করার মওকা পেয়ে যাবে এবং রাষ্ট্র পারতপক্ষে ক্ষমতার অপব্যবহার প্রতিরোধ করতে পারবে না? স্বাধীন দেশে রাষ্ট্রকে ঔপনিবেশিক আমলের মতো নির্যাতনমূলক হওয়ার তো কোনও যৌক্তিকতা নেই, যেহেতু আমাদের রাষ্ট্র ঔপনিবেশিক অত্যাচার থেকে বেরিয়ে আসার সংগ্রামে জয়ী হয়ে তবেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।