বিশেষ বিবেচনায়, কেউ যদি মন্তব্য করেন যে, পুঁজিতান্ত্রিকতার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা আমলাতান্ত্রিকতা বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার নিয়ামক কিংবা নিয়ন্ত্রক, তা হলে বোধ করি তিনি খুব একটা মহাভারত অশুদ্ধ করে বসবেন না। কিন্তু কথা হলো আমলাতান্ত্রিকতার প্রভুত্বের মধ্যে একটা চিরন্তন পশ্চাৎপদতা আছে, যে-টাকে অস্বীকার করার কোনও জো নেই। এই পশ্চাৎপদতার একটি বড় লক্ষণ হলো, যে-কোনও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে আমলাতান্ত্রিকতা ‘করিবকর্মা’ নীতিকে কার্যকর করে তোলে সভ্যতার অগ্রগতিকে স্থবির করে তোলে। আমলাতান্ত্রিকতা মেকলেপনার লেজুরবৃত্তি থেকে বিচ্যুত হয় না কখনও। আঠারো শতকের প্রথমার্ধে ভারতবর্ষে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদী মেকলে ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতাকে স্থায়ী করতে (অর্থাৎ বিটিশ সাম্রাজ্যবাদের পক্ষ থেকে ভারতীয় একটি শ্রেণির দ্বারা ভারতীয় সকল শ্রেণিস্তরের মানুষজনকে শাসন ও শোষণ করার ব্যবস্থাটিকে স্থায়ী করার জন্যে) তৎকালের ভারতবর্ষে একশ্রেণির রাজকর্মচারী (মুৎসুদ্দিগোষ্ঠী) তৈরি করেছিলেন, যাদের সম্পর্কে তার (মেকলের) বিখ্যাত মন্তব্য হলো এই যে, এইসব রাজকর্মচারীরা হবেন খালেচামড়ায় ভারতীয় কিন্তু মগজমননমর্জি ও আচার-আচরণে (অর্থাৎ চেতনাগতভাবে) ইংরেজ। সেই থেকে আমাদের দেশের আমলাতান্ত্রিকতার মধ্যে যে-প্রভুত্বের বীজ উপ্ত হয়ে ছিল তা উৎপাটন সম্ভব হয় নি, বরং তা শতধারায় বিকৃত হয়ে শেষ পর্যন্ত স্বাধীনোত্তর বাংলাদেশে উন্নয়নের অস্থিতিকর পরিসরে ‘বেগমপাড়ায় বিনিয়োগকারী’ হয়ে উঠেছে। তার প্রমাণ গত শুক্রবারের দৈনিক সুনামকণ্ঠে দুইটি উদ্ধৃত সংবাদশিরোনাম। একটি শিরোনাম, “সরকারি কর্মচারীদের প্রধানমন্ত্রী ॥ কোনো মানুষকে তাচ্ছিল্য করবেন না” এবং অন্যটি, “ ‘বেগমপাড়ায়’ বিনিয়োগকারী আমলাদের খোঁজে দুদক”। একটিতে আমলাতান্ত্রিকতার প্রভুত্বের বিষয়টি ও অন্যটিতে আর্থিক দুর্নীতির সার্বিক কার্যক্রমের অভিমুখটি বিদেশমুখিনতাগ্রস্ত হয়ে খোদ আমলাতান্ত্রিকতা যে দেশপ্রেম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে তা বিবৃত হয়েছে এবং প্রকারান্তরে সংশ্লিষ্টদের দেশদ্রোহীতাকে প্রতিপন্ন করেছে। বিদগ্ধমহল মনে করেন, অনতিবিলম্বে এই প্রবণতার অবসান কাম্য।
প্রধানমন্ত্রী ও দুদকের বর্তমান সক্রিয়তা এই বিপর্যয় থেকে দেশকে উদ্ধার করতে ইতিবাচক সূচনা, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু তাঁদের এই তৎপরতা কতোটুকু কার্যকর হবে জানি না। একদা বঙ্গবন্ধু এই প্রবণতার বিরোধী ছিলেন এবং তাঁর নিয়োজিত আমলারাই প্রকারান্তরে তাঁর প্রভুত্ব ও শোষণবিরোধী শাসননীতির বিরোধিতার অংশীদার ছিল।