1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
  3. [email protected] : wp-needuser : wp-needuser
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০১:২৩ পূর্বাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

স্মরণ : সব্যসাচী সালেহ চৌধুরী

  • আপডেট সময় শনিবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০

:: হাসান মাহমুদ সুহেল ::
সালেহ চৌধুরী পেশায় ছিলেন সাংবাদিক, স্বভাবে শিল্পী। কিন্তু, প্রয়োজনে শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে সোচ্চার একজন আদর্শ দেশপ্রেমিক ব্যক্তিত্বের নাম। যিনি জীবনের প্রতিটি সময়ে অনুস্মরণযোগ্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি তার বিশাল দ্যুতিময় কর্মজীবন।
১৯৫২ সালে মৌলভীবাজার কাশিনাথ-আলাউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র সালেহ চৌধুরী। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকায় আন্দোলনে নামে ছাত্ররা। গুলি করে পুলিশ। বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন তিনি। পুরনো পত্রিকা সংগ্রহ করে রমজান আলীর সাথে লিখলেন পোস্টার। সেই পোস্টার শহরের স্থানে-স্থানে সেঁটে দেয়া হলো। সক্রিয় হলেন ছাত্রদের সংগঠিত করতে। হলো মিছিল। তারপরই মৌলভীবাজার পৌর পার্কে সফল ছাত্র সমাবেশ।
পঞ্চাশ দশকে সিলেট মুরারিচাঁদ কলেজে ছাত্র থাকা অবস্থায় প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনে জড়িয়ে যান, একই সাথে করেন শিল্প সাধনা, পরিচিতি লাভ করেন কবি ও প্রকাশক হিসাবে। সিলেট মুরারিচাঁদ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং স্নাতক অর্জন করে বৃত্তি নিয়ে লাহোরে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালে চলে যান। সেখান থেকে সমাজ কল্যাণে সাফল্যের সাথে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফেরেন ১৯৬৭ সালে। বুকভরা ক্ষোভ আর জ্বালা নিয়ে যোগ দেন সাংবাদিকতায়। দু’বছর লাহোরে অধ্যয়নকালে প্রত্যক্ষ করেছেন পাকিস্তানিদের বাঙালি বিদ্বেষী মনোভাব। সালেহ চৌধুরীর বর্ণনায় শুনি- “যারা পাকিস্তান বলতে অজ্ঞান- তাদের পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে ছয় মাস রাখলে-ও নাম আর মুখে উচ্চারণ করবে না। বাঙালিদের কোন দৃষ্টিতে দেখা হতো তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ প্রকাশনা সংস্থা ফিরোজ সন্স লিঃ-এর উর্দু অভিধান। এতে বাঙালি শব্দটি ব্যবহারের নমুনা হিসাবে যে বাক্যটি ছাপা হয় তা ছিল অনেকটা এ রকম – “আগর বাঙালি ইনসান হো তো প্রেত কহ কিসকো?” অর্থ হলো- “বাঙালি যদি মানুষ হয়, প্রেত বলব কাকে?”
ঊনসত্তের গণ-অভ্যুত্থানের সময়ের কথা শুনি নির্মল সেনের জবানীতে- নির্মল সেন তার লেখা ‘আমার জবানবন্দী’ বইতে ২৪ শে জানুয়ারি ১৯৬৯ সালের একটি বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি তখন থাকেন সেগুনবাগিচায় – “আমার দুয়ারে ধাক্কা পড়লো। দরজা খুলে দেখি সামনে দাঁড়ানো দৈনিক বাংলার সাংবাদিক সালেহ চৌধুরী। জামায় রক্তের ছাপ। সে জামাটা খুলে ফেলল। বললো আমাকে একটা জামা দিন। পুলিশের গুলিতে নবাবপুর স্কুলের ছাত্র মতিউর রহমান মল্লিক নিহত হয়েছে। এতক্ষণ সে মতিউরের লাশ কাঁধে নিয়ে মিছিল করেছে। এবার এসেছে জামা পাল্টাতে। সালেহ চৌধুরী আমার একটা জামা গায়ে দিয়ে বের হয়ে গেল।”
ঊনসত্তরের জলোচ্ছ্বাসে ও সত্তরের নির্বাচনে সাংবাদিক হিসাবে বঙ্গবন্ধুর সাথে ঘুরে বেরিয়েছেন সারাদেশ। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণেই পেয়ে যান দিকনির্দেশনা। স্ত্রী-সন্তানদের ঢাকা থেকে পাঠিয়ে দেন গ্রামের বাড়ি। ২৫ শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি সৈন্যদের মুক্তিকামী জনগণের উপর বর্বর আক্রমণের পরই সালেহ চৌধুরী সিদ্ধান্ত নেন- হয় স্বাধীনতা- নয় মৃত্যু। ঢাকা থেকে বেরিয়ে পড়েন উত্তরমুখি হয়ে। পায়ে হেঁটে-হেঁটে কিশোরগঞ্জ হয়ে বেশ কয়েকদিনে পৌঁছান সুনামগঞ্জের দিরাইয়ের নিজ গ্রাম গচিয়ায়। উপস্থিত হন ভাটি অঞ্চলের যুদ্ধের রণাঙ্গনে। কলম রেখে হাতে তুলে নেন অস্ত্র, যোগ দেন সরাসরি যুদ্ধে। নির্ঘুম রাতে কবি কবিতা লেখেননি, অস্ত্র হাতে শত্রু নিধনে জীবন বাজি রেখে বাজিয়েছেন রণ সংগীত।
অকুতোভয় সালেহ চৌধুরী টেকেরঘাট সাব-সেক্টর থেকে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করে ভাটি এলাকায় মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। শাল্লা, দিরাই, জগন্নাথপুর, আজমিরীগঞ্জ, তাহিরপুরসহ বিশাল ভাটি এলাকায় মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র নেতৃত্ব দিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের সন্ত্রস্ত করে রাখেন। তাই যুদ্ধকালীন সময়ে লোকজন আদর করে এই দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধাকে ডাকতো ‘মেজর সাহেব’।
মুক্ত সুনামগঞ্জে শহীদ মিনার নির্মাণে ছিলেন স¤পৃক্ত। শহরের সুরমা নদীর বিপরীত তীরে মেজর মোত্তালেবের ক্যা¤প। সন্ধ্যার পর ওখানে গেলেন সালেহ চৌধুরী। দেখলেন মেজর সাহেব উত্তেজিত। কারণ, মেজর মোত্তালিব চান আজ রাতেই শহীদ মিনার তৈরি করে দিতে হবে। ওদের কাছে ইট-সিমেন্ট আছে, রড নাই। রড ছাড়া মিনার তো ধসে পড়বে। তাই প্রকৌশলীরা কিছু সহজ নকশা এনেছিলেন। উনি তার একটাও পছন্দ করেননি। সালেহ চৌধুরী মেজর মোত্তালিবের ছুড়ে ফেলা নকশার একটা উঠিয়ে নিয়ে তার অপর পৃষ্ঠায় দ্রুত একটা নকশা এঁকে একজন প্রকৌশলীর হাতে দিয়ে বললেন- এটা দেখান তো, চলবে কি-না। রড ছাড়াই বানানো যেতে পারে। মেজর মোত্তালিব নকশাটা হাতে নিয়ে খুশি হয়ে উঠলেন- বেশ তো, এটা চলতে পারে।
সেদিনের সালেহ চৌধুরীর নকশায় তৈরি শহীদ মিনার আজও সুনামগঞ্জের প্রাণ কেন্দ্রে “যাদের রক্তে মুক্ত এ দেশ” ধারণ করে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
চলুন ১৬ ডিসেম্বরের স্মৃতিচারণ শুনি সালেহ চৌধুরীর কাছ থেকে- “পাথারিয়া বাজার থেকে আমার বাড়ি দু’মাইল। ফাঁড়ি পথে। সেবার আমন সম্ভবত ভালোই ফলেছিল। নেড়া-ঢাকা মাঠ দিয়ে হাঁটছিলাম। ঘড়িতে তখন চারটা বাজে। হঠাৎ মনে পড়ল গত রাতে শুনেছিলাম এই চারটার দিকে হানাদারেরা আত্মসমর্পণ করতে পারে। হঠাৎ এক অদম্য আবেগ আমাকে পেয়ে বসল। এখনই হানাদারেরা আত্মসমর্পণ করবে? আমরা বিজয়ী? আমার বুক ফেটে কান্না আসতে চাইছিল। নিজেকে সামলাতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল চোখ থেকে পানির ধারা নেমে আসবে। সঙ্গে থাকা ছেলেদের এ দুর্বলতা দেখাব না। ওদের কোনো রকমে বললাম, সবাই বসে পড়ো। একটু জিরিয়ে নিই। আমি নেড়ার ওপর শুয়ে পড়লাম। বাঁধভাঙ্গা ধারায় নেমে এলো চোখের পানি। সময় লাগল নিজেকে সামলে নিতে। সন্ধ্যের একটু পর পৌঁছলাম গচিয়া। খেয়া নৌকায় খাল পেরুতে গিয়ে দেখি ছোট চাচা কাগজের একটা বিবর্ণ মালা হাতে নৌকায় উঠে এসেছেন। আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে প্রায় ডুকরে উঠলেন- আমরা এখন স্বাধীন। পাকিস্তানিরা ঢাকায় আত্মসমর্পণ করেছে। গ্রামের ছেলে-বুড়ো মিছিল করে “জয় বাংলা” স্লোগান দিতে দিতে নিয়ে চলল নজরুল ভাইসাবদের বাড়িতে। আমাদের নিজের বাড়ি তো তখন ছাইয়ের গাদা।”
দেশ স্বাধীন হলে কিংবদন্তী ‘মেজর সাহেব’ ফিরে গেছেন তাঁর পুরনো পেশা সাংবাদিকতায়। সাংবাদিকতার পাশাপাশি লেখালেখি, সম্পাদনা, চিত্রাঙ্কন, কার্টুন, প্রচ্ছদ, ভাস্কর্য নির্মাণ করে কাটিয়ে দেন বাকি জীবন।
রণাঙ্গনের সহযোদ্ধাদের প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও ভালবাসার প্রকাশ দেখা যায় তাঁর অসামান্য এক প্রয়াসের ভেতর দিয়ে। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কোন সুযোগ সুবিধা নেননি কোন কালে। কিন্তু, একান্ত বাধ্য হয়েই ২০১৪-২০১৫ সালে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা গ্রহণ করতে হয়। সিদ্ধান্ত নেন সেই অর্থ কখনো নিজে ভোগ করবেন না। সেই অর্থ দিয়ে তিনি একে একে নির্মাণ করবেন, শহীদ সহযোদ্ধাদের নামে স্মৃতিস্তম্ভ। দুটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করে যেতে পেরেছিলেন। সহযোদ্ধাদের প্রতি এমন নিখাঁদ ভালোবাসা আর কেউ দেখিয়েছেন বলে জানা নেই।
ভালোবাসতেন বই পড়তে। দাবা খেলাতে ছিল বিশেষ অনুরাগ। প্রিয়জনের সাথে গল্পে-আড্ডায় ছিলেন নিরলস। ভালবাসতেন জন্মভূমি সুনামগঞ্জ, যে কোনো একটা অজুহাত পেলেই ঢাকা থেকে ছুটে আসতেন সুনামগঞ্জে, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান সাথী মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে।
তিনি সৃষ্টি করে গেছেন বর্ণাঢ্য সৎ জীবনযাপনের অনন্য উদাহরণ। বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী সালেহ চৌধুরীর আজ মৃত্যুবার্ষিকী। মৃত্যুর পর ঢাকা ও দিরাইয়ের গচিয়া গ্রামে তাঁকে দেওয়া হয় পূর্ণ রাষ্ট্রীয় সম্মান। দেশজুড়ে অগণিত মানুষের হৃদয়ের দাবি- জাতীয় পর্যায়ে তাঁর একটি স্বীকৃতি অবশ্যই প্রাপ্য। সুনামগঞ্জের ভাটি অঞ্চলের বঞ্চিত মানুষ কি আশা করতে পারেনা সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে সালেহ চৌধুরীর নামে কোন স্থান, প্রতিষ্ঠান বা সড়কের নামকরণ করা হোক? মানুষ আশাবাদী হয় মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে দেখে। মনে করে বঙ্গবন্ধু কন্যা মরণোত্তর উপযুক্ত পুরস্কার দিয়ে সালেহ চৌধুরীর দেশমাতৃকার প্রতি ভালোবাসা ও ত্যাগের মূল্যায়ন করবেন।
এই রক্তভেজা স্বাধীন মাটিতে ছদ্মবেশী প্রতারকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। মানুষ মানবিক গুণাবলী বিবর্জিত হয়ে পড়ছে। কেন? সময় এসেছে ভেবে দেখার। আমরা কি সৎ দেশপ্রেমিক প্রচারবিমুখ মানুষদেরকে উপযুক্ত সম্মান দিতে পেরেছি? কথায় আছে, যে জাতি বীরদের সম্মান দিতে জানে না, সে জাতিতে বীরের জন্ম হয় না। সব্যসাচী সালেহ চৌধুরীর চারিত্রিক ঔজ্জ্বল্য আগামী প্রজন্মকে আলোকিত করুক। জাতীয় এ বীরের প্রতি হৃদয় গহীনের ভালোবাসা নিবেদন করছি।
[তথ্যসূত্র :- ১। ভাটি এলাকায় মুক্তিযুদ্ধ আমার অহংকার : সালেহ চৌধুরী, ২। আল ইসলাহ, বর্ষ : ৮৫ সংখ্যা : ৩]

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com