1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
  3. [email protected] : wp-needuser : wp-needuser
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১২:১৫ পূর্বাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

গল্প- প্রতীক্ষা : মাহদিয়া আঞ্জুম মাহি

  • আপডেট সময় শনিবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০

বরাবরের মতো এবারও পাহাড় সমান অভিযোগ নিয়ে আমার সামনে হাজির হলো আবির। প্রতিদিন অফিস থেকে আসতে না আসতেই তার হাজারো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় আমাকে। কিন্তু আজ একটু তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরেছে। এসেই আমাকে জিগ্যেস করছে , আবির নাকি আহির; কাকে তুমি বেশি ভালোবাস? এই একটা প্রশ্ন সবসময় আমাকে আটকে দেয়। আমি এই কঠিন প্রশ্নের সহজ উত্তরটা এখনও খুঁজে পাই না। মাঝে মাঝে তাকে রাগানোর জন্য একটি উত্তর দেই আমি কাউকেই ভালোবাসি না।
রাত জাগতে আমার মানা। আমার নগরীতে সন্ধ্যা নামার সাথে সাথেই ঘুমের রাজ্যে ডুব দিতে হয়। রাত ১০ টা বাজলেই আবির আমাকে ঘুমিয়ে পড়তে বলে। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি আমার ঘুম আসে না। আমি মিথ্যা ঘুমের ভান ধরে পড়ে থাকি। আর আবির যখন গভীর ঘুমে মগ্ন থাকে তখন চুপিচুপি তাঁর নিঃশ্বাসের শব্দ শুনি। একটা মানুষের নিঃশ্বাসের শব্দও যে এত মধুর হতে পারে তা আমি জানতাম না। এককালে আবিরের যন্ত্রণায় ঘুমাতে পারতাম না, অনেক নড়াচড়া করতো সে। আর এখন আহিরের যন্ত্রণায় ঘুমাতে পারি না। আবিরের থেকে সে আরও বেশি নড়াচড়া করে। সময়ে অসময়ে নড়াচড়া করে।
আবির আহিরকে একদমই সহ্য করতে পারে না। অনেক ইনসিকিউরড ফিল করে আহিরকে নিয়ে। সে ভাবে, আহির তাঁর জায়গা নিয়ে নিচ্ছে। আবিরের প্রতি আমার ভালোবাসায় কেউ ভাগ বসাচ্ছে। যখনই আমি তাঁর সামনে আহিরের কথা বলি, তখন সে কটকট করে আমার দিকে তাকায়। আর প্রতিদিন আমাকে জিঞ্জেস করে, আমি কাকে বেশি ভালোবাসি?
আহির কে জানেন? আমার শরীরের একটা অংশ; আমার অস্তিত্বের একটা অংশ। আমি মারা যাবার পরও পৃথিবীতে যার মাঝে বেঁচে থাকবো, সে হলো আহির। গত প্রায় ৯ মাস ধরে, আবির আমার বুকে ঘুমায়, আর আহির আমার গর্ভে।
আবিরের সাথে অনেক যুদ্ধ করেই বিয়ে হয়েছে আমার৷ ইউনিভার্সিটিতে পড়াকালীন সময়ে তার সাথে আমার পথচলা শুরু হয়। তখন আমি ভার্সিটিতে একদম নতুন৷ তেমন কারো সাথে আমার পরিচয় ছিল না। মাঝে মাঝে খুব সাধারণ আর সাদামাটা কারো দায়িত্ব নিতে খুব ইচ্ছে করতো। খুব ইচ্ছে হতো কারো জন্য একটু দুশ্চিন্তা করতে, মা হবার আগে একটু অভিভাবক হতে। কীভাবে যেন, চোখে পড়ে না এমন একজনকেই চোখে পড়ে গেলো। আমার চোখ তার দিকে, আর তার চোখ তার কাগজ আর ল্যাপটপের উপর। তবুও আজ আমি কাজ পাগল ওই মানুষটিকেই ভালোবাসি। যার মন সবসময় কাজেই থাকে, সে অন্তত অন্য মেয়ের দিকে তাকাবে না। এভাবেই শুরু হয়েছিল আমার আর আবিরের ভালোবাসা। একসময় তাঁকে পেয়ে কেঁদেছিলাম। এখনও কাঁদি, প্রতি রাতে কাঁদি।
রাত এখন ৩ টার কাছাকাছি। আবির গভীর ঘুমে বিভোর হয়ে আছে। অন্যদিন এই সময়টায় আমি অবশ্য ঘুমেই থাকি কিন্তু আজ কেন জানি অন্যদিনের তুলনায় একটু ব্যাতিক্রম। আমার চোখে ঘুম নেই। এই রাজধানীর সবাই হয়তো আবিরের মতো ঘুমাচ্ছে। কিন্তু আমার মতো কয়জন- ই বা এইরকম ভাবছে। এত কোলাহলের মধ্যে নিজেকে ভীষণ একা লাগে। চোখটা এখন জ্বালাপোড়া শুরু করছে, কই একটু ঘুমাবো তা না আহির নড়াচড়া শুরু করছে। যাক আজ আর ঘুমাবো-ই না।
এরকম নিস্তব্ধ পরিবেশে হঠাৎ কোথা থেকে যেন একটি আওয়াজ আসলো। আমি ঠিক আন্দাজ করতে পারছি না আওয়াজটা কিসের। মূহুর্তের মধ্যেই নিরিবিলি নিস্তব্ধ পরিবেশ কেমন যেন কোলাহলে ভরে গেল। চারদিক থেকে মানুষের চিৎকার আর কান্নার শব্দ আসছে সাথে অদ্ভুত আরেকটি শব্দ হচ্ছে। আমি কিছু না বুঝে আবিরকে ডাক দিলাম। কিন্তু তার কোনো সাড়া নেই। একবার ঘুমালে তাকে ওঠানোই দায়৷ অনেক ধাক্কার পরে সে উঠলো। আমি কিছু বলতে না বলতেই সে কি যেন একটা টের পেল। আমাকে কিছু না বলে তাড়াহুড়ো করে একটা শার্ট পড়তে পড়তে বললো, তুমি শুয়ে থাকো, আমি একটু দেখে আসি। আর হ্যাঁ, আমি যাতে এসে দেখি তুমি লক্ষী মেয়ের মতো শুয়ে আছো, নইলে কিন্তু একদম আদর করবো না।

আমার ভিতরে খুব অশান্তি লাগছে। আমি বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। আজ আবার নতুন করে ঘরটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছি। আমাদের ছোট্ট একটি রুম। রুমের প্রতিটা আসবাবপত্র আমাদের দুজনের পছন্দের কেনা। রুমের দেয়ালটা নীল রঙের। আকাশের রঙ নীল। প্রতিটি আসবাবপত্রে আমাদের দুজনের স্পর্শ আছে, ঘরের প্রতিটি আসবাবপত্র আমাদের ভালোবাসার সাক্ষী। হঠাৎ আবির এসে রুমে ঢুকলো। হাঁপাতে হাঁপাতে বলছে, সর্বনাশ আরশি, বাহিরে তো মিলিটারির লোকেরা গুলি বর্ষণ করছে। সবাই দরজা বন্ধ করে ঘরের মধ্যে লুকিয়ে আছে। কেউ কেউ শত্রুর মোকাবেলা করছে আবার কেউ ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। এখন আমরা কী করবো? তোমাকে এই অবস্থায় রেখে আমি কীভাবে বাহিরে যাবো। আর শত্রুরা আমাদের বিল্ডিংয়ের দিকে চলে আসছে। আবিরের কথা শুনে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে বসে আছি। হঠাৎ করেই সব স্বপ্নগুলো আমার পালিয়ে যেতে লাগলো। কি বলবো এখন আবিরকে? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
আবির তুমি আমার জন্য চিন্তা করো না৷ আমি ঠিক আছি। তুমি বাহিরে যাও শত্রুর মোকাবেলা করো। আমাদের এই দেশটাকে শত্রুদের হাত থেকে বাঁচাও। আমি যেমন তোমার ভালোবাসার মানুষ, তোমার প্রিয়জন ঠিক তেমনি অনেকের অনেক প্রিয়জন রয়েছে সবাইকে বাঁচতে হবে আর তাদেরকে বাঁচাতে হলে তোমাদের মতো লোককে এগিয়ে যেতে হবে। যাও তুমি। এদিকে গুলির শব্দ মনে হচ্ছে অনেকটা কাছে চলে আসছে। আমি জোর করে আবিরকে বের করে দিলাম। সে হেঁটে হেঁটে বেরিয়ে যাচ্ছে রুম থেকে…….
সে কি সত্যি চলে যাচ্ছে আমার কথা শুনে? সে কি বুঝে না, আমি চাই সে আমার পাশে আরেকটু সময় থাকুক। শেষবারের মতো তাকে দেখছি। সে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলো আমাকে একা রেখে। আচ্ছা, ছেলেরা এত কম বুদ্ধি নিয়ে জন্মায় কেন? সে কি বোঝে না আমি তাঁকে কতটা ভালোবাসি, কতটা চাই? তুমি খুব স্বার্থপর, তুমি খুব খারাপ আবির। শুধু মুখেই সব ভালোবাসা। আসলেই তুমি খুব খারাপ!
একটু পর আবার সে ফিরে আসলো। চোখ জলে ছলছল করছে। আমি বুঝতে পারছি আমাকে রেখে যেতে তার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমার মনটা অপরাধবোধে ভরে গেলো। না আবির, তুমি এতটাও খারাপ নও; বরং আমিই স্বার্থপর, শুধু নিজের কথাই ভাবি।
আবির, তুমি আমার বুকে মাথা রেখে শুয়ে থাকো। আবির কোনও কথা না বলে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকলো। আমি বুঝতে পারছি, যতটা না সে আমাকে অনুভব করার জন্য শুলো, তাঁর চেয়েও বেশি আমার গায়ে যাতে কোনোরকমের গুলির আঁচ না লাগে সেজন্য শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। কি জানি হয়তো আজকেই আমাদের ভালোবাসা বিলীন হতে চলছে। খুব কষ্ট হচ্ছে আমার। আমি মনে হয় আর আহিরকে আবিরের কোলে দিয়ে যেতে পারবো না। আবিরের কান্নার কোনো শব্দ শোনা না গেলেও আমি বুঝতে পারছি এই মূহুর্তে তার ভেতরে কি চলছে না চলছে। আমাদের রুমের দিকে গুলি আসতে শুরু করলো। আবিরের পিঠে হাত রেখে আমিও তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। তখন আবির আমাকে বললো, আরশি তুমি আমার পিঠ থেকে তোমার হাত সরাও। আমি তোমাকে শত্রুর গুলির হাত থেকে লুকিয়ে রাখবো। তুমি চুপচাপ ঘুমাও। আবির, তুমি খুব খারাপ। আমাকে সারাজীবন ভালোবেসে গেলে। আমাকে ভালোবাসার সুযোগটাও দিলে না।
কিছুক্ষণ পর সৈকত ভাই আর ভাবি আমাদের রুমে ঢুকলেন। আমরা একই বিল্ডিংয়ে থাকি শুধু তাদের রুমটা আমাদের রুম থেকে একটু দূরে। বুঝতে পারছি তারাও একই পরিস্থিতির স্বীকার। আবির উঠে দাঁড়ালো। ভাবি এসে আমার পাশে বসলেন। ভাবিকে সামনে পেয়ে আবির কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছে। সৈকত ভাই আর আবির যুদ্ধে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। আর ভাবিকে আমার পাশে রেখে যাচ্ছে। আবির শেষবারের মতো আমার কাছে আসলো। তার লাল হয়ে যাওয়া ভেজা চোখ, কাঁপা হাত আর ভিত চাহনিতে এত মায়া কেন? আমিতো নতুন করে আবার তার প্রেমে পড়ে যাচ্ছি। আবির কথা বলতে পারছে না। বার বার আমার দৃষ্টি থেকে তার চোখ সরিয়ে নিচ্ছে।
আরশি, তুমি একদম চিন্তা করো না। আমি খুব তাড়াতাড়ি তোমার কাছে ফিরে আসবো। দেখ, আমাদের দেশটাকে আমরা ঠিকই শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা করতে পারবো। এই বলে আবির থেমে গেল। তার গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। আমি তাকে ভরসা দিয়ে বললাম, তুমি যুদ্ধে যাও আমি তোমার অপেক্ষায় বসে থাকবো। আমি কোথাও যাবো না, এখনও যে আহিরকে তোমার কোলে দেওয়া বাকি। তুমি খুব তাড়াতাড়ি ফিরে এসো। তারপর আবির আর সৈকত ভাই বেরিয়ে গেলেন।
অতঃপর কেটে গেল কুড়িটি বছর। আবির আর ফিরে এলো না। আহির এখন অনেক বড় হয়েছে। দেখতে ওর বাবার মতোই হয়েছে। শুধু চোখটা আমার মতো পেয়েছে। এখন সে সেনাবাহিনীর একজন গর্বিত সৈনিক। আমি এখন ও আবিরের প্রতীক্ষায় পথ চেয়ে বসে আছি। আমার বিশ্বাস একদিন না একদিন ঠিকি আবির ফিরে আসবে। আমাদের ভালোবাসার চিহ্ন এখনও যে দেখার বাকি। আসবে, ঠিকি একদিন সে ফিরে আসবে.!

লেখক : মাহদিয়া আঞ্জুম মাহি
শিক্ষার্থী, সুনামগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজ।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com