মাসুম হেলাল ::
পানি যখন বিটুমিনাস সড়কের শত্রু, তখন বিশ্বের সব চাইতে বৃষ্টিবহুল এলাকা ভারতের চেরাপুঞ্জি লাগোয়া সুনামগঞ্জে এ জাতীয় সড়কের উপযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন দীর্ঘদিনের। ঢাকার বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত যেখানে ১৮৫৪ মিলিমিটার সেখানে সুনামগঞ্জে বছরে ৩৩৩৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়।
অধিক বৃষ্টিপাত আর উজানের ঢলে প্রায় প্রতিবছর ছোটবড় বন্যার কবলে পড়ে সীমান্তবর্তী জেলা সুনামগঞ্জ। এ সময় পানিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে শত শত কিলোমিটার পাকা সড়ক, যেগুলোর শতকরা ৯০ ভাগ বিটুমিন দিয়ে তৈরি। তলিয়ে থাকার কারণে নষ্ট হয়ে যায় সড়কের বিটুমিনের প্রলেপের কার্যকারিতা। অনেকক্ষেত্রে পানি ‘ওয়াস আউট’ হয়ে যায় বিটুমিনের প্রলেপ। আবার টানা ভারি বর্ষণে অনেক দিন ভিজে থাকার কারণে আলগা হয়ে যায় বিটুমিনের বন্ধন। ফলে যানবাহন চলাচল শুরু হলেই উঠতে শুরু করে বিটুমিনের প্রলেপ। খানাখন্দ সৃষ্টি হয়ে দীর্ঘ মেয়াদি ভোগান্তির পাশাপাশি অপচয় হয় হাজার কোটি টাকা।
টেকসই উন্নয়ন ও সরকারি অর্থের অপচয় রোধে ভৌগোলিক অবস্থান এবং আবহাওয়ার চরিত্র বিবেচনায় নিয়ে এসে বৃষ্টিবহুল সুনামগঞ্জের জন্য পৃথক উন্নয়ননীতি গ্রহণের দাবি এই অঞ্চলের মানুষের।
চলতি বছরের জুন ও জুলাইয়ে এক মাসের ব্যবধানে ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে টানা তিন দফা বন্যার কবলে পড়ে সুনামগঞ্জ। দফায় দফায় বন্যায় সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বিটুমিনের তৈরি জেলার বেশিরভাগ সড়ক। বন্যায় কেবল স্থানীয় সরকার প্রকৌশলী বিভাগের (এলজিইডি) আওতাধীন ৯০০ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৪০০ কোটি টাকার উপরে।
এলজিইডি সূত্র জানায়, বন্যায় সড়কের ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে বিটুমিন উঠে যাওয়ায় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বেশি। বন্যা আর ভারি বর্ষণে এবার তাদের একটি সড়ককেও অক্ষত রাখেনি। এছাড়া ছাতক-সুনামগঞ্জ, জামালঞ্জ-সুনামগঞ্জ-সহ এলজিইডির ২২ সড়কের অংশবিশেষ ভেসে গেছে পানি তোড়ে।
এছাড়া, সড়ক ও জনপথ বিভাগের আওতাধীন প্রায় ২৪ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ৩১ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। সব মিলিয়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছুঁয়েছে হাজার কোটির ঘর।
এদিকে, বন্যা ও ভারি বর্ষণে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ এবং পৌরসভা নির্মিত বিটুমিন দিয়ে তৈরি সড়কগুলোরও। প্রথম গ্রেডের সুনামগঞ্জ পৌরসভার সবগুলো সড়ক বন্যা ও ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে ক্ষত-বিক্ষত। ভাঙাচোরা সড়কের কারণে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে জনসাধারণকে।
সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞদের মতে, বৃষ্টিবহুল এলাকায় বিটুমিন দিয়ে সড়ক তৈরি করলে কিছুতেই এর সুফল পাওয়া যাবে না। বৃষ্টিপাত শুরু হলেই বিটুমিনের প্রলেপ উঠতে শুরু করে। ফলে সড়ক নির্মাণ কিংবা সংস্কারের কয়েক মাসের মাথায় খানাখন্দে ভরে যায় বিটুমিন দিয়ে তৈরি সড়কগুলো। বিটুমিন দিয়ে তৈরি সড়ক এই অঞ্চলের আবহাওয়ায় কিছুতেই উপযোগী নয়। ভাল ফলাফল পেতে আরসিসি ঢালাই করা কংক্রিটের সড়ক নির্মাণের কোনও বিকল্প নেই এখানে।
সুনামগঞ্জ স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাহবুব আলম বলেন, সুনামগঞ্জের মতো বৃষ্টিবহুল এলাকায় বিটুমিন দিয়ে তৈরি সড়কের পরিবর্তে আরসিসি ঢালাই সড়কের দিকে ক্রমান্বয়ে সরে আসতে আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আসছি। যেহেতু আরসিসি সড়কের নির্মাণ ব্যয় অনেক বেশি ও নির্মাণ করতে সময়ও বেশি লাগে, তাই এটি কার্যকর করতে একটু সময় লাগবে।
এদিকে, বৃষ্টিপাত-প্রবণ সুনামগঞ্জে বিটুমিন দিয়ে তৈরি সড়কের উপযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলছেন অনেক জনপ্রতিনিধি।
সুনামগঞ্জ সুনামগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ বলেন, ভৌগোলিক কারণেই দেশের অন্যান্য অঞ্চলের চাইতে সুনামগঞ্জের চরিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। কাজেই উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণের ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারকদের এই এলাকার ভৌগোলিক চরিত্রকে বিবেচনায় নিয়ে এসে পৃথক উন্নয়ন নীতি গ্রহণ করতে হবে।
তিনি বলেন, আমাদের সীমান্তঘেঁষা মেঘালয় পাহাড় যেখানে বিশ্বের সবচাইতে বৃষ্টি বহুল এলাকা চেরাপুঞ্জির অবস্থান। যে কারণে বছরে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় এখানে। আর বৃষ্টির পানি হচ্ছে বিটুমিনের শত্রু। ফলে বৃষ্টির পানিতে ভিজে বিটুমিনের সড়ক খুব দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। আমাদের এই এলাকার জন্য বিটুমিনের সড়ক উপযুক্ত নয়।
তিনি বলেন, আবহাওয়াগত কারণেই সুনামগঞ্জে আরসিসি সড়ক নির্মাণ করতে হবে, যাতে এটি টেকসই হয়। এখানে বিটুমিনের সড়ক সরকারের অপচয় ছাড়া আর কিছু না।
সুনামগঞ্জ পৌরসভার মেয়র নাদের বখত বলেন, তিন দফা বন্যায় পৌর এলাকার সবগুলো সড়কই এখন বেহাল। প্রায় প্রতিটি সড়কের বিটুমিনের প্রলেপ উঠে গেছে। তিনি বলেন, আমরা আস্তে আস্তে বিটুমিন থেকে আরসিসি ঢালাই সড়কের দিকে যাত্রা শুরু করেছি। সম্প্রতি শহরের দুটি সড়ক আরসিসি দ্বারা নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে।