১৯৮৪ সালে আমি সাংবাদিকতার অঙ্গনে পা রাখি। তখন ব্যাঙের ছাতার মতো এতো পত্রিকা ছিল না, আর ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও অনলাইনের কথা তো কল্পনার অতীত। সিলেটের স্বনামধন্য সাংবাদিক তখনকার বহুল প্রচারিত জাতীয় দৈনিক বাংলার বাণীর প্রতিনিধি, সিলেট প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত মহিউদ্দিন শীরু সম্পাদিত সাপ্তাহিক গ্রাম সুরমা পত্রিকার মাধ্যমে আমার যাত্রা শুরু। পরবর্তীতে তার উৎসাহ উদ্দীপনায় দৈনিক বাংলার বাণীর সুনামগঞ্জ জেলা প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করি দীর্ঘদিন। আমি সাংবাদিক রণেন্দ্র তালুকদার পিংকু (বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী), ফখরু কাজী ভাই সহ আরো অনেকের সাথে ওঠাবসা ছিল। ফখরু ভাই ছিলেন ঐ সময়ে আমাদের জুনিয়রদের গাইড। ফখরু ভাই তার এক বন্ধু প্রয়াত আজিজুল হক ভাইর পুরাতন বাস স্টেশনের বাসার সামনে বিকেল বেলা আড্ডা দিতেন। আমি ফখরু ভাইর নিত্যসঙ্গী। এই সময়ে সাংবাদিক আবেদ মাহমুদ চৌধুরী সুনামগঞ্জ জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নূরুল হুদা মুকুট ভাইর দুই সন্তান অর্চি ও সচিকে প্রাইভেট পড়াতো। পড়িয়ে সে মুকুট ভাইয়ের হাজীপাড়ার বাসা থেকে হেঁটে হেঁটে প্রতিদিন আসত। পুরাতন বাস স্টেশন এসেই আমাদের কাছে আসত। ফখরু ভাইকে সে চাচা বলে সম্বোধন করত। এক সময় আবেদ সাংবাদিকতার জগতে আসতে ফখরু ভাইকে জানালে তিনি তাকে স্বাগত জানান। সম্ভবত নব্বই দশক হতে পারে। শুরু হলো আমাদের সাথে তার বিভিন্ন স্থানে সংবাদ সংগ্রহ ও ওঠাবসা।
দেওয়ান ইমদাদ রেজা চৌধুরী সম্পাদক, ইশতিয়াক আহমেদ শামীম নির্বাহী সম্পাদক মিলে বের করেন সাপ্তাহিক সুনামগঞ্জ সংবাদ। আবেদ ঐ পত্রিকায় ক্রীড়া সম্পাদক হিসেবে যোগ দেয়। পরবর্তীতে ঢাকার একটি জাতীয় দৈনিকে লাল সবুজ পত্রিকায় জেলা প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করে। এর কিছুদিন পর দৈনিক আজকের কাগজে যোগদান করে দীর্ঘ দিন দায়িত্ব পালন করে। সর্বশেষ ইলেকট্রনিক মিডিয়া আরটিভিতে জেলা প্রতিনিধি। আবেদের পারফরমেন্স বিবেচনায় কর্তৃপক্ষ তাকে স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে পদোন্নতি দেয়। অবশ্য এই সময়ে সবাই তাকে নিয়ে মজা করত, এই বলে যে, সুনামগঞ্জে একমাত্র স্টাফ রিপোর্টার বাকি সবাই জেলা প্রতিনিধি সুতরাং খাওয়া চাই। কি আর করা বাধ্য হয়ে খাওয়াতে হতো সবাইকে। সে নিজেও ভোজন রসিক ছিল, একসাথে দুই তিন হালি ডিম খেতে পারতো। গরুর মাংসের প্রতিও ছিল প্রচণ্ড দুর্বলতা। আমার বাসায় খেতে খুব আগ্রহী ছিল, প্রায়ই তার ভাবীকে (আমার গিন্নি) দেখা হলে বা মুঠোফোনে একই কথা- ভাবী আপনার হাতের রান্না খুব সুস্বাদু, অবশ্য তা সহকর্মীদের কাছেও প্রচার করতো।
কয়েক বছর আগে সে দুটো পত্রিকার ডিক্লারেশন নিয়ে নেয়। একটি সাপ্তাহিক সুনামগঞ্জের কথা অপরটি দৈনিক আজকের সুনামগঞ্জ। দৈনিক আজকের সুনামগঞ্জ বের হবে আবেদ আমাকে নিয়ে বিভিন্ন পরিকল্পনা শুরু করে এবং আমাকে উপদেষ্টা সম্পাদক রাখে। পত্রিকা বের হওয়ার আগে ও পরে এতো সভা, প্রতিনিধি সভা করেছিল যে এক পর্যায়ে সবাই ক্লান্ত। এ নিয়েও সহকর্মী সাংবাদিকদের মাঝে বেশ হাস্য রসের সৃষ্টি হয়। আবেদ সৃজনশীল ও পরিপাটি ছিল। কাজের প্রতি তার দরদ ছিল। তার পত্রিকা অফিস খুব সুন্দর করে সাজানো গোছানো রাখতে ভালবাসত। আমরা সহকর্মী সাংবাদিকগণ তার পৌর বিপণির অফিসে প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যায় চা পান করতাম সঙ্গে ঝাল মুড়ি, বিস্কুট ইত্যাদি। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে আবেদের অফিসে বসে, তার খেয়ে আবার তাকে নিয়েই ঠাট্টা তামাশা করা ছিল কিছু ‘বিচ্ছুবাহিনী’র কাজ।
আবেদ ছিল আমার অতি প্রিয়জন, সে আমাকে খুব সম্মান করত, ভরসা করত। তার সাথে পরিচয়ের পর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমার অতি কাছের মানুষ ছিল। আমরা যখন প্রেসক্লাবের নতুন কমিটি করতাম কিংবা নির্বাচন করতাম আবেদ আমাকে ছেড়ে যায়নি কখনো। সে বলত রাজু ভাই আপনি যেদিকে আমি সেদিকে। আমিও প্রেসক্লাব এবং রিপোর্টার্স ইউনিটিতে তাকে সম্মানজনক পদ দিতে প্রাণপণ চেষ্টা করে যেতাম। সর্বশেষ সিনিয়র সহ-সভাপতি পদটিও আমার প্রস্তাবেই দেয়া হয়। ২০১৭ সালে আমরা সুনামগঞ্জের প্রায় ৪০জন প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার গণমাধ্যম কর্মীদের নিয়ে গঠন করি সুনামগঞ্জ রিপোর্টার্স ইউনিটি। এই সংগঠনেও আবেদকে সিনিয়র সহ-সভাপতির পদ দেয়া হয়। প্রেসক্লাবের নির্বাচন এলেই আবেদকে আমার সঙ্গ ছাড়াতে অনেক চেষ্টা তদবির করেও কোন ফল হয়নি। যার জন্য আমি আবেদের কাছে চিরকৃতজ্ঞ।
আবেদ তার যে কোন বিষয়ে আমার সাথে পরামর্শ করত। সে বুলচান্দ উচ্চ বিদ্যালয়ে পরিচালনা কমিটির সভাপতি ছিল এর আগেও একবার ছিল। তার অক্লান্ত পরিশ্রমে বিদ্যালয়ের ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। এ বছর যখন পরিচালনা কমিটির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, ভোটে নির্বাচিত হয় আবেদ কিন্তু প্রতিপক্ষ থেকে একটি অভিযোগ দায়ের করা হয় ইউএনও বরাবর। আবেদ মহাদুঃশ্চিন্তায়। কি আর করা রাজু ভাইর ডাক পড়লো। যাই হোক এ যাত্রাও তার মান-সম্মান অক্ষুণ্ন থাকে।
এই কয়েক মাস আগের একটি ঘটনা। আবেদ ফোন দিয়ে জানালো সন্ধ্যার পর যেন তার অফিসে গিয়ে চা পান করি, জরুরি কথা আছে। আমি সময় মতো হাজির হই। আবেদ বললো আরটিভি কর্তৃপক্ষ কয়েকজন স্টাফ রিপোর্টার দেশের বাইরে কোন এক অনুষ্ঠানে পাঠাবে সে তালিকায় আবেদও আছে, তাকে পাসপোর্ট করতে বলেছে। আমি বললাম করে ফেল সমস্যা কি। সে বললো সমস্যা আছে, পুলিশ ভেরিফিকেশন সার্টিফিকেট নিয়ে ঝামেলা। আমাকে নিয়ে এসপি অফিসে গিয়ে তাদের পরামর্শ মোতাবেক অনেক ঝামেলার পর পাসপোর্টটি করা হয়। কিন্তু আবেদের ভাগ্যে সেই সুযোগটি আর হয়ে উঠেনি। কে জানত বিধাতা তাকে অকালে নিয়ে যাবেন।
এ রকম অসংখ্য স্মৃতি রয়েছে আমার আর আবেদের। এসব স্মৃতি কোন দিনই ভুলার নয়। পরিশেষে আবেদের দুটো অবুঝ কন্যা সন্তান ফালগুনী ও সাবাহ এবং তার স্ত্রীসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের যেন আল্লাহপাক হেফাজত করেন এবং আবেদকে বেহেশত নসিব করেন সেই দোয়া করি কায়মনোবাক্যে।