:: গার্গী ভট্টাচার্য্য ::
কমরেড বরুণ রায়। বিখ্যাত ব্যক্তি। রাজনৈতিক অঙ্গনে তাঁকে চেনেনা এমন লোক খুব কমই পাওয়া যাবে। তাঁকে নিয়ে একটা সত্য ঘটনা দিয়ে শুরু করি। যদিও আজকের লেখার প্রধান চরিত্র তিনি নন।
পাকিস্তান আমলে তাঁর উপর হুলিয়া জারি হয়। তাঁকে জীবন্ত ধরিয়ে দিতে পারলে পুরস্কার প্রদান করা হবে। এ অবস্থায় তিনি পালিয়ে বেড়ান বর্তমান সুনামগঞ্জ জেলার নানা আনাচে-কানাচে। কিন্তু প্রতি মুহূর্তেই ধরা পড়ে যাবার শঙ্কা। এ অবস্থায় তাঁর আশ্রয় মেলে শহরের উকিলপাড়াস্থ দিপালী চক্রবর্তীর বাসায়। দিপালী চক্রবর্তীও সে সময়ে ছাত্র ইউনিয়নের এক সক্রিয় কর্মী। তিনি কমরেডকে লুকিয়ে আশ্রয় দেন তাঁর গোয়ালঘরে। সেখানেই সপ্তাহখানেক কাটে তাঁর। এর মধ্যেই কিভাবে যেন গুপ্তচর মারফত এ খবর প্রশাসনের কাছে পৌঁছে যায়। হঠাৎ একদিন সদলবলে প্রশাসনের বাহিনী দিপালী চক্রবর্তীর বাসা ঘেরাও করে। এ খবর পেয়ে তড়িঘড়ি দিপালী চক্রবর্তী তার বাসায় কর্মরত একটি ছেলেকে পাঠান কমরেডের কাছে গোয়ালঘরে, সাথে দিয়ে দেন শাড়ি, ব্লাউজ। তিনি নিজে চলে যান বাড়ির প্রধান ফটকে, প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সাথে আলাপচারিতায়। সেখানে তিনি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সাথে তার বাসা ঘেরাও ও সার্চ ওয়ারেন্ট দেখানো নিয়ে বাদানুবাদে জড়িয়ে কালক্ষেপণ করতে থাকেন। আর এই ফাঁকেই কমরেড বরুণ রায় শাড়ি পরে মহিলা বেশে ঘোমটা টেনে বাড়ির পেছনের পুকুর পাড়ের বেড়া ডিঙিয়ে পালিয়ে যান সুরমা নদীর তীরে। সেখানে তাঁর জন্য আগেই দিপালী চক্রবর্তীর পাঠানো আরেকজনের (বাড়ির পাচক) মারফতে ঠিক করে রাখা ছিল নৌকা। কমরেড সেখানে পৌঁছে নৌকা করে পালিয়ে যান নদীর অন্যপাড়ের আরেক গ্রামে। এ যাত্রায় বেঁচে যান তিনি। এদিকে গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে দিপালী চক্রবর্তী তাঁর বাসা সার্চ করার জন্য কর্মকর্তাদের পথ করে দেন। কিন্তু ততক্ষণে তো পাখি উড়ে গেছে।
এই ঘটনার এই অমিত সাহসী নায়িকা দিপালী চক্রবর্তী আর কেউ নন; আমার মায়ের মা, আমার দিদা। অল্প বয়সে বিয়ের পর বিশাল সংসারের ভার এসে পড়ে তার উপর। তিনি নির্দ্বিধায় সে ভার বহন করে গেছেন। এ ক্ষেত্রে তার স্বামী তথা আমার দাদুভাইয়ের অবদানও কম নয়। ছাইচাপা আগুন তিনি তার স্ত্রীর মাঝে দেখতে সক্ষম হয়েছেন এবং তা নেভাতে নয় বরং তা প্রজ্জ্বলিত করতে সারাজীবনই স্ত্রীকে সঙ্গ দিয়ে গেছেন। আর এজন্যই সম্ভব হয়েছে তার পরবর্তী শিক্ষাগ্রহণ। স্কুলের গণ্ডি না পেরোতেই বিয়ে হয়ে আসা স্ত্রীকে তিনি সেই সময়েও বি.এ. পাস করিয়েছেন মানসিক সমর্থন জুগিয়ে। আর এই সমর্থনকে কাজে লাগানোর যোগ্যতা দিদার মধ্যে ছিল বলেই তিনি তার বড় সন্তানের জন্মের পর (আমার বড়মামা) পাস করেছেন এন্ট্রান্স (এসএসসি) আর তার শিক্ষার সমাপ্তি ঘটিয়েছেন তার ষষ্ঠ সন্তানের জন্মের পর বি.এ. পাস করার মধ্য দিয়ে। কলেজ জীবনে সংসারের পাশাপাশি রাজনীতিতেও সক্রিয় থেকেছেন- প্রথমে ছাত্র ইউনিয়ন, পরবর্তীতে মতিয়া চৌধুরী সমর্থিত ন্যাপ পার্টিতে যুক্ত হয়ে। মায়ের মুখে শুনেছি স্বাধীনতা পূর্ববর্তীকালে রাজনৈতিক সফরে এসে মতিয়া চৌধুরী একবার তাঁদের বাসায় গিয়ে থেকেছিলেন ১/২ দিন; সে সময় তিনি ‘অগ্নিকন্যা’ নামে খ্যাত। পরবর্তীতে দিদাসহ কয়েকজন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সক্রিয় সদস্যদেরকে রাজনৈতিক প্রয়োজনে আওয়ামী লীগে যোগদান করাতে মতিয়া চৌধুরী আরেকবার এসেছিলেন। বাড়িতে বিভিন্ন মিটিং এর আলোচনায় দিদার যৌক্তিক মন্তব্য ও অকুণ্ঠ সমর্থন দেখে সে সময়ের বয়োজ্যেষ্ঠ নেতারা দিদাকে ঠাট্টা করে নাকি নাম দিয়েছিলেন ‘জলকন্যা’। আমার মামাবাড়ির ঠিক পেছনেই সুরমা নদী, এই নদীর পাড়ে বাস বলেও অনেকে তাকে রসিকতা করে বলতেন ‘জলকন্যা’।
নানা কারণে এক সময়ে তিনি রাজনীতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন, তবে মহিলা পরিষদে তিনি সভানেত্রী হিসাবে সুনামগঞ্জে সক্রিয় থেকেছেন আজীবন। আমার মনে পড়ে, ছোটবেলায় মামাবাড়ি গেলেই দেখতাম সকাল-বিকাল কিংবা রাতে দুঃস্থ মহিলাদের আনাগোনা। তাদের নিয়ে দিদার নানা আলোচনা, কর্মযজ্ঞ। বয়স কম ছিল তাই সবকিছু বুঝতাম না। দিদার হুটহাট করে বেরিয়ে যাওয়া, মিটিং করা – এসবে বরং বিরক্ত হতাম। কারণ সে সময় তাঁর কাছে গল্প শোনাটা ‘মিস্’ হতো।
বাইরের এত কাজে যুক্ত থেকেও তাঁর ঘরের কাজের প্রতি অশ্রদ্ধা বা বিরক্তি দেখিনি কোনদিন। তাঁর হাতের সন্দেশ, পিঠা, নানা উপাদেয় খাদ্য যারা খেয়েছেন তারা এই সত্যের সঠিক স্বীকারোক্তি দেবেন বৈকি। শুধু তাই নয়, সংগীতের প্রতি তাঁর ছিল তীব্র মমত্ব। সেদিন না বুঝলেও আজ ঠিক বুঝতে পারি। তাঁর সন্তানদের সকলকেই তিনি সঙ্গীতের তালিম দিয়েছেন। মনে পড়ে, মামাবাড়ি বেড়াতে গেলে অবসর সময়ে তিনি ডেকে বলতেন, “যা, ছোটমাসির কাছে একটা নতুন গান তুলে নে”। মাঝে মাঝে তুলতাম, তবে বেশির ভাগই এতে বিরক্ত হয়ে তাঁকে দশকথা শুনিয়ে দিতাম। যেদিন নতুন গান শিখতাম, সেদিন তাঁর আনন্দ হতো বোধ হয় আমার চেয়ে বেশি। বাসায় অতিথি সমাগম হলে (সঙ্গীত বোদ্ধা হলে) আমাকে গান গাইতে বলতেন, অনিচ্ছাসত্বে গাইতাম। এরপর মামা, মা, মাসীদের গান চলতো একের পর এক, সাথে চা মিষ্টিসহ নানা উপাদেয় খাদ্য। কবিগুরু কিংবা কাজী নজরুলের গানের প্রেক্ষাপট নিয়েও আলোচনা করতেন। আমার মন তখন খেলায় যোগ দেয়ার জন্য আকুপাকু করত, সেসব আলোচনায় মেজাজ খারাপ হয়ে যেতো। আজ মনে হয়, কি আশ্চর্য ধীমত্তা নিয়ে জন্মালেই না এমনটা সম্ভব! যেখানে মহিলাদের আলোচনার মূল বিষয়েই থাকে শাড়ি, গহনা কিংবা কার বাড়িতে কে কোন দুর্ঘটনা ঘটাল সেখানে দিদা কি না এসব প্রসঙ্গে যেতেনই না কখনো! অন্তত আমি দেখিনি।
অসম্ভব স্পষ্টবক্তাও ছিলেন। ছোট ছেলে ছাড়া সব সন্তানদেরই বিয়ে দিয়ে গেছেন। দেখতাম মামীদের এটা ওটা শেখানোর জন্য তাঁর কত চেষ্টা, কড়া গলায় নির্দেশ যেমন দিতেন, তেমন আদরও করতেন। বৃদ্ধবয়সে তাকে দেখাশোনার জন্য যে মহিলা তার সাথে থাকতো, তাকে প্রায়ই দেখতাম তাঁর বিছানাতেই পায়ের কাছে পড়ে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। আমরা বিরক্ত হতাম, কিন্তু তিনি নির্দ্বিধায় এদের নিয়েই ঘুমাতেন। এমনকি তার বাসায় কর্মরত মহিলার ছোট বাচ্চাটির শৌচ পরিষ্কার করে দিতে আমি দেখেছি। আমি অবাক হয়ে বলেও ছিলাম, তুমি কেন করছ, ওর মা করতে পারে না? তোমার ঘিন্না নাই? তিনি হেসে বলেছিলেন, ওর মা কাজ করছে, বাচ্চাটা কতক্ষণ এভাবে থাকবে? তোদেরও তো দিয়েছি ছোটবেলায় আর ও গরিব বলে ওরটাতে ঘিন্না? এসব কি বলিস দিদি, সবাই মানুষ, এটা মনে রাখবি।
চট দিয়ে তৈরি তাঁর হাতে বোনা বিশাল সব কার্পেটসহ নানা রকম সৌখিন জিনিস হয়ত আজও কিছু কিছু আছে আমার মামাবাড়িতে যা দেখলে বিস্মিত হতে হয়- ‘দশভুজা’ বুঝি একেই বলে।
আমার দুঃখ দিদার মত আর কাউকে পেলাম না এ জন্মে। নিজেরও তাঁর সমকক্ষতা পাবার সামর্থ হবার নয়। ‘দশভুজা’রা বুঝি একই পরিবারে একবার করেই উঁকি মারেন। তাই এ পরিবারে আমাদের সেই গুণে ধন্য হবার সুযোগ নেই বোধ হয়। শুধু স্মৃতিমন্থনের গর্বে মথিত হওয়া ছাড়া। তাই হয়ে যাচ্ছি, হয়ে যাবো জীবনভর আর তোমার মৃত্যুবার্ষিকীতে এটুকুই জানিয়ে দিতে চাই তোমায় দিদা চুপিচুপি। ভালো থেকো দিদা ওপারে তোমার সমস্ত গুণ আর ভালো লাগার একান্ত সন্নিবেশনায়।