মু. আবদুর রহীম স্যার ছিলেন আমাদের মাতৃভাষার শিক্ষক। ব্রিটিশ-ভারতে আসাম প্রদেশের শিক্ষা বিভাগ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণে ছিল। রহীম স্যার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ১৯৪৭ সালে অনুষ্ঠিত মেট্রিকুলেশন পরীক্ষার সর্বশেষ ব্যাচের পরীক্ষার্থী ছিলেন। সে-বছর জুবিলী হাইস্কুল থেকে যে পাঁচজন ছাত্র প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে তিনিও ছিলেন একজন। এরপর তিনি সুনামগঞ্জ কলেজ থেকে আই.এ. এবং সিলেট মুরারীচাঁদ কলেজ থেকে বি.এ. পাস করেন। অন্য কোনো পেশায় না থেকে তিনি শিক্ষকতায় আত্মনিয়োগ করলেন।
ছাত্রজীবন থেকেই রহীম স্যার সাহিত্যসাধনায় নিমগ্ন ছিলেন। মাতৃভাষার শিক্ষক হিসেবে জুবিলী হাই স্কুলে যোগ দেওয়ার পর ছাত্র-শিক্ষকদের নিয়ে তিনি জমিয়ে তুলেন সাহিত্যের আসর। ১৯৮৫ সালে অবসরে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তাঁর তত্ত্বাবধানে প্রায় প্রতি বছর প্রকাশিত হতো স্কুল ম্যাগাজিন। সেইসব বিদ্যালয় বার্ষিকীগুলোতেই হাতেখড়ি হয়েছিল বহু প্রথিতযশা দেশবরেণ্য লেখকের।
স্কুল-জীবনে তিনি মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের কর্মী হিসেবে পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু পাকিস্তান হাসিলের পরপরই প্রগতিকামী ছাত্রদের সঙ্গে সঙ্গে তাঁরও মোহভঙ্গ হয়। স্বাধীনতাকামী তরুণেরা বুঝতে পারেন, ব্রিটিশ চলে গেলেও প্রকৃত স্বাধীনতা আসেনি। অর্জিত স্বাধীনতার স্বরূপ বুঝতে তাঁদের দেরি হয়নি। তাঁরা অনুধাবন করলেন, যা হয়েছে তা নিছক ক্ষমতা হস্তান্তর। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বদলে পাকিস্তানি সা¤্রাজ্যবাদের প্রতিষ্ঠা। গণমানুষের মুক্তির বিষয়টি থেকে যায় উপেক্ষিত। তাই পাকিস্তানি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজে পুঞ্জিভূত হতে থাকে ক্ষোভ। পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র দুই বছরের মাথায় ১৪ আগস্ট ১৯৪৯ সালের সাপ্তাহিক নও-বেলাল পত্রিকার স্বাধীনতা সংখ্যায় ‘ভূঁয়া স্বাধীনতা’ শিরোনামের সাহসী প্রবন্ধটি তার-ই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এটিই স্যারের মুদ্রিত আকারে প্রকাশিত প্রথম কোনো লেখা। তখন তিনি এম.সি. কলেজে অধ্যয়নরত।
গতকাল মু. আবদুর রহীম স্যার পরলোক গমন করেছেন। ভাষাসৈনিক আবদুর রহীম স্যারের প্রতি বিন¤্র শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর জীবনের প্রথম লেখাটি নও-বেলাল পত্রিকার পাতা থেকে উদ্ধার করে এখানে ছাপানো হলো। (ভূমিকা ও সংগ্রহ কল্লোল তালুকদার)
ভূয়া স্বাধীনতা
মু. আবদুর রহীম
বিদেশী প্রভুদের নিষ্ঠুর চোখরাঙানি ও স্বদেশী মনিবদের উপেক্ষা অবহেলার মধ্যে এতদিন দেশের চাষা ভূষারা সযতেœ নিজের মধ্যে নিজেকে লুকিয়ে বেঁচে রয়েছে। প্রতিরোধের বল তাদের ছিল না, প্রতিবাদের ভাষাও তারা পায়নি। এতদিন শাসনে ও শোষণে ওদের তাজা দেহের সমস্ত রক্ত নিঃশেষ হয়ে কঙ্কাল বেরিয়ে পড়েছে। ওদের চোখের জল কেউ দেখতে পায়নি, কিন্তু সে নীরব অশ্রুতে ওরা সকলের অলক্ষিতে দেশের মাটির উর্ব্বরতা বৃদ্ধি করেছে। বাবু সাহেবদের খোরাক বয়ে বয়ে ওদের শিরদাড়া বাঁকা হয়ে গেছে, তবু বাবুদের মুখ দিয়ে তাদের প্রতি সহানুভূতির একটা কথাও উচ্চারিত হয়নি। ঘৃনিত দাসত্ব ও লাঞ্ছিত জীবন যাত্রার চাপে ওদের সকল স্বাধীন মনোবৃত্তি দিন দিন নীচে নেমে গিয়ে অবনতির সর্ব্বনিম্ন তলায় তলিয়ে গেছে। ওদের ভাববারও ক্ষমতা নেই যে,
“অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে
তব ঘৃণা তারে যেন তৃণ সম দহে।”
কিন্তু মহাকালের গতি কেউ রোধ করতে পারে না। সে আপন মনে আপন নিয়মে চলছে, কাউকে উঠাচ্ছে, কাউকে নামাচ্ছেÑ তার গতি ঘূর্ণায়মান। সূর্য্য উঠছে আবার ডুবছে, রাত হচ্ছে, দিন আসছে। গতির চাঞ্চল্যই নিয়ম, স্থিতি ব্যতিক্রম। এই যে পরিবর্তনের অলক্ষ্য নিয়মে দুনিয়ার প্রাকৃতিক বস্তু সকল নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে তা থেকে মানুষের ভাগ্যও মুক্ত নয়। ভাঙ্গাগড়ার নিয়ম সর্ব্বত্রই ক্রীয়াশীল। ইতিহাসের পাতায় পাতায় আমরা এই সত্যেরই সমর্থন পাই। আরবের অর্ধসভ্য বেদুইনরা এক মহাপুরুষের সোনার কাঠির ছোঁয়ায় একদিন অকস্মাৎ গভীর নিদ্রা ভেঙ্গে জেগে উঠল, তাদের হুঙ্কারে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হল, এশিয়া ইউরোপ ও আফ্রিকার এক বিরাট অংশ তাহাদের বিজয়মাল্য পরিয়ে বরণ করে নিল। সাত’শ বছরে যে বিরাট আরব শক্তি ধীরে ধীরে গড়ে উঠল তা কিন্তু এক ফুৎকারে ধূলায় মিশে গেল এই নিয়মেরই নিষ্ঠুর বিধানে। পারসীক, ব্যবীলনীয় ও রোমীয় সভ্যতা সম্বন্ধে এই একই নিয়মই খাটে।
এই নিয়মকে আশ্রয় করেই একদিন এই সোনার ভারতে বৃটিশ জাতি চেপে বসেছিল। প্রায় দুইশত বৎসর পরে তাদের উপরে উঠার কাল শেষ হল। এল নেমে যাওয়ার আহ্বান। এত বড় শক্তি হয়েও তারা কিন্তু সে আহ্বানকে উপেক্ষা করতে পারল না। তাই তারা আজ তল্পি গুটিয়ে নিতান্ত ভাল মানুষের মত নিজেদের আস্তানায় গিয়ে ঠাঁই করেছে।
আমরা আজ স্বাধীন হয়েছি। কিন্তু সত্য বলতে কি স্বাধীনতা হবার আগে বৃটিশকে তাড়াবার উত্তেজনায় এই স্বাধীনতা শব্দটার দিকে তত নজর দেইনি। মনে ভেবেছি স্বাধীনতা বুঝি কল্পবৃক্ষের মত কোন কিছু, এটা পেলেই আমাদের সব পাওয়া হয়ে যাবে। আজ কিন্তু বারবারই মনে প্রশ্ন জাগছে- স্বাধীনতার অর্থ কী? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়াই আমাদের আজকের প্রধান সমস্যা। মনে হচ্ছে ভাঙ্গাগড়ার উত্থান পতনের এই যে নিয়ম এরও বুঝি ধারা উপধারা আছে। নতুবা এটা কি করে সম্ভবপর হল আমাদের রত্ন সিংহাসনে বৃটিশরা উঠেছিল, আর আমরা নেমে গিয়েছিলুম, এখন তারা নেমে গিয়েছে, আমরা উঠছি না কেন? সূর্য্য উঠেছে কিন্তু আমরা যে তিমিরে সেই তিমিরেই রয়ে গেছি। এর কারণ কী? আমাদের স্বাধীনতা সূর্য্যকে কোন পাষাণ পর্ব্বত আড়াল করে রাখেনিত?
হ্যাঁ, এটাই আজ আমাদের দেখতে হবে। আমরা স্বাধীন হয়েছি তবু পরাধীনতার অভিশাপ রয়ে যায় কেন? যে লোহার শৃঙ্খলে আমাদের হাত-পা এতদিন বাঁধা ছিল তা ছিড়ে গিয়েও এখনও হাত-পা থেকে সরছে না কেন?
প্রায় অর্ধশতাব্দীর কঠোর জীবন-মরণের অগ্নি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে পাকিস্তানের সপ্তকোটি রিক্ত, বঞ্চিত ও সর্ব্বহারা মানুষ ভেবেছিল এতদিনে বুঝি তাদের দুঃখ দৈন্যের একটি প্রতিকার হবে। এতদিন সাত সমুদ্রে তের নদীর ওপারে তাদের ধনদৌলত গিয়ে জড় হয়েছে। কিন্তু এখন তো আর সে বালাই নেই। এখন তারা তাদের শ্রমলব্ধ ধনসম্পদ নির্ব্বিঘ্নে ভোগ করতে পারবে, স্বাধীন দেশে তারা নিজেদের স্বাধীনভাবে গড়ে তুলতে পারবে, থাকবে না অত্যাচার অবিচার, শাসন-শোষণ, অভাব-অনটন, থাকবে না হাহাকার-হানাহানি। কিন্তু স্বাধীনতা লাভ করবার পর এসব আশা-আকাঙ্ক্ষা শুধু আকাশ কুসুমেই পরিণত হয়েছে। দুটা বছরের তিক্ত অভিজ্ঞতায় আজ হাড়েহাড়ে বুঝতে পারা যাচ্ছে যে, স্বাধীনতা মানে শুধু বৃটিশকে তাড়ানোই নয়, তার সঙ্গে আরও কিছু আছে। স্বাধীন কথাটাই শুধু মানুষকে তুষ্ট করতে পারে না; তার পেটে অন্ন চাই, পিঠে বস্ত্র চাই, রোগে ঔষধ চাই, আর মনের স্ফূর্তিত চাই-ই। Man cannot live by bread alone কথাটা সত্য বটে, কিন্তু Man cannot live without bread কথাটা ততোধিক সত্য। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মিঃ লিয়াকত আলী খান এক বক্তৃতায় যা বলেছিলেন তার মানে এই যে, পাকিস্তানবাসীরা অন্নবস্ত্র না পাক তাঁর কোন দুঃখ নেই, কিন্তু তিনি কিছুতেই তাদেরে তাদের স্বাধীনতা হারাতে দেবেন না। কথাটার মধ্যে ভাবাবেগ আছে আর আছে স্বাধীনতার অতিরঞ্জিত মাহাত্ম্য বর্ণনা। বাস্তবিক দেশের মানুষ যদি ভাত কাপড় না পায় তবে স্বাধীনতার কি মূল্য থাকে তা আমরা বুঝিনে। আমরা দেশকে স্বাধীন করেছি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করেছি, পাকিস্তানের জয়গানে আমরা মুখর। কিন্তু আমরা বিজয়ের উন্মাদনায় ভুলে যাই যে, আমাদের বড় প্রভুরা সরে গেলেও ছোট প্রভুরা এখনও তাদের গদীতে কায়েম আছেন। আর এই ছোট প্রভুরা যে শোষণে বড়দের চাইতে মোটেই কম নন তা অতি সত্য কথা। বাঘের কামড়ের চেয়ে জোঁকের শোষণ অধিকতর মারাত্মক। কারণ বাঘের দৌরাত্ম এক মিনিটেই শেষ হয়ে যায়, কিন্তু জোঁক ধীরে ধীরে রক্ত শোষে তিলে তিলে শরীর দুর্ব্বল করে মারে।
কর্নওয়ালিশের কলম থেকে জমিদারী প্রথার যে ভুত বেরিয়ে আমাদের ঘাড়ে চেপে বসেছিল তার ভার আজও আমাদের বইতে হচ্ছে। কই, স্বাধীনতা তো আজ পর্য্যন্ত এ ভুতের কোন কিনারা করতে পারল না! আজ যারা আমাদের ভাগ্য নির্ধারণের গদী দখল করে আছেন তাদের হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে, অন্ততঃ আরও কয়েক বৎসর তাঁরা আমাদের এ ভুতের ব্যাগারী থেকে মুক্তি দিতে অনিচ্ছুক। যে সমস্ত ভাগ্যবানরা আজ রাতারাতি পাকিস্তানের মন্ত্রী, হোমড়া-চোমড়া সেজে বসেছেন, তাঁরাতো সেই পুরানো আমলাতান্ত্রিক জবরদস্ত শাসন ধারাকেই আঁকড়ে রয়েছেন। ঘুষের বাজার আজকাল এমনি গরম যে, শুনা যায় এমন কোন কাজ নেই যা ঘুষ-ব্যাটা করতে পারে না। এই ঘুষেরই দুর্জ্ঞেয় মহিমায় নাকি আজ শতশত মন চাউল খাসিয়া পাহাড়ের পথে ভারত ডমিনিয়নে চলে যাচ্ছে। দুর্মূল্যতার তো কথাই নেই। তেল, কাপড়ের দাম তেরশ পঞ্চাশকেও ছেড়ে গেছে। চিনি ময়দা প্রভৃতি তো পাকিস্তানে আজ কামনার বস্তু। চুরি-ডাকাতি যেরূপ বেড়ে গেছে তাতে শুধু ঠগী-বর্গীদের কথাই মনে পড়ে। আবার এমনও অনেক স্থলে দেখা গেছে যেখানে রক্ষকই ভক্ষক হয়ে বসেছেন। স্বজনপ্রীতির জঘন্য নেশাও আমাদের প্রভুদেরে উৎকটভাবে পেয়ে বসেছে। শত সহস্র শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা যে স্বাধীনতা অর্জ্জন করেছি তার আশীর্ব্বাদ এইগুলি।
এই যদি স্বাধীনতার চিত্র হয় তবে এতে সাধারণ মানুষের লাভ কতটুকু? স্বাধীন দেশেও যদি মানুষের মানসম্ভ্রম ধন-সম্পদ নিরাপদ না হল তবে এমন স্বাধীনতার আমাদের প্রয়োজন কী? মদ, সুদ, জুয়া, ঘুষ ও চোরকারবার যে দেশে স্বচ্ছন্দে রাজত্ব করতে পারে তার নাম পাকিস্তান না রেখে নাপাকিস্তান রাখাই তো যুক্তিযুক্ত। পাকিস্তানের কর্ণধারগণ কি পাকিস্তান নামের মোহে এইসব নাপাক রীতিনীতির প্রতি চিরদিন উদাসীন থাকবেন? থাকলে তাঁরা জেনে রাখুন গণবিপ্লব আসন্ন। কারণ প্রকৃতির শ্বাশ্বত নিয়মেই পাকিস্তানের অধিবাসীরা আজ জেগে উঠেছে।