কলকাতায় ক’দিন ধরে নিষ্প্রদীপ মহড়া। বাসে, ট্রামে, অলিতে গলিতে, রকের আড্ডায় বাংলাদেশের যুদ্ধ নিয়ে আলোচনা। কেউ দেখেছে পাকিস্তানি ট্যাংক ধরে নিয়ে আসা হয়েছে কলকাতায়। নিয়াজী নাকি পালিয়ে গেছে। কাদের সিদ্দিকীকে একজন দেখে এসেছে কলকাতার এক হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়েই যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে রওয়ানা দিয়েছে। বাঘা সিদ্দিকীর নাকি আলৌকিক শক্তি আছে। কেউ সামরিক ট্রাকে চোখবাঁধা পাকিস্তানি সৈন্যও দেখেছে। আবার কেউ ট্রাকভর্তি মুক্তিফৌজ জয়বাংলা বলতে বলতে কলকাতার রাস্তা দিয়ে যেতে দেখেছে। আরো কতো কাহিনী।
গলি দিয়ে একদল ছেলে খাটিয়ায় শবদেহ সাজিয়ে ‘হরি বল, বল হরি’ বলে কাঁধে করে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। আগে আগে খই ছিটিয়ে চলছে একজন। কর্পোরেশনের টেপকলে কাপড়-বাসন ধুতে মহিলাদের জটলা। বয়স্কা মহিলাটি গলা বাড়িয়ে শবযাত্রীদের একজনকে উদ্দেশ্য করে জানতে চাইলেন- কে গ্যালো রে পটলা? নির্বিকার উত্তর- ইয়াহিয়া।
– দ্যাখো দেখিনি কাণ্ড! ইয়াহিয়া বুঝি মত্তে এলো কলকাতায়।
মোড়ের বাড়ির জানালায় বসে থাকা বৃদ্ধা কিছু না বুঝেই সংস্কারবশত মৃতদেহের উদ্দেশ্যে দুই হাত কপালে ঠেকালেন। শবমিছিলটি গলির বাঁকে অদৃশ্য হয়ে গেল। দূর থেকে শোনা যাচ্ছেÑ হরি বল, বল হরি।
ইন্দিরা গান্ধী ইউরোপ-আমেরিকা সফর শেষে মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী এবং অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির সাথে বৈঠক করলেন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের অনুরোধ জানিয়ে আরো একটি পত্র ভারতের প্রধানমন্ত্রীর নিকট হস্তান্তর করেন। পত্রে দাবি করা হয়Ñ বাংলাদেশের দুই-তৃতীয়াংশ মুক্তিবাহিনীর দখলে। শরণার্থীদের স্বদেশে ফেরার ব্যবস্থা করার জন্য অনুরোধ জানিয়ে বলা হলোÑ শীতের আগে দেশে ফিরতে না পারলে শরণার্থীদের আরেকটি দুর্যোগের সম্মুখীন হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
বাস্তবিক পক্ষেই শীত জেঁকে বসেছে হিমালয়ের কাছাকাছি এবং আসাম-মেঘালয়ে পাহাড়ের কোলে অবস্থিত শরণার্থী শিবিরগুলোতে। নিমোনিয়া, ব্রংকাইটিসে আক্রান্ত হয়েছে অনেক। পর্যাপ্ত কম্বল সরবরাহ করা যাচ্ছে না। ভারতের বাজারে কম্বলের সংকট। বেশির ভাগই বিদেশ থেকে আনতে হচ্ছে। উল কিনে স্থানীয়ভাবে কম্বল তৈরির পরিকল্পনাও নেয়া হয়েছে। বিভিন্ন সংগঠন শীতবস্ত্র বিতরণ করলেও তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। শীতের তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে আরেকটি ভয়াবহ অবস্থার সম্মুখীন হতে হবে। গ্রীষ্ম, বর্ষা পেরিয়ে শীত আরেকটি উপসর্গ হয়ে অবধারিত মৃত্যুর বার্তা নিয়ে এগিয়ে আসছে শরণার্থী শিবির পানে।
স্বাধীন বাংলা বেতারে ছাতক, সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজারের যুদ্ধে পাকবাহিনীর পিছু হঠে যাওয়ার খবর প্রচারিত হয়েছে। পাক জেনারেলদের হম্ভি-তম্বি এখন শুধু তাদের মুখে মুখেই সীমাবদ্ধ। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের বাংকারে বসে নিয়াজী পাকসেনাদের প্রতি ইঞ্চি জমির জন্য যুদ্ধ চালিয়ে যাবার নির্দেশ দিচ্ছেন। জেনারেলরা যত না বলছে তার চেয়ে বেশি বলছে দেশীয় দালালরা।
জামায়াত আয়োজিত এক মিছিল পরবর্তী সমাবেশে দলটির আমীর অধ্যাপক গোলাম আজম ঘোষণা করেনÑ ভারত পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তে নয়, বরং এদেশের মুসলমানদের ঈমানের উপর হামলা চালিয়েছে। তিনি বলেন, মুসলমান কখনো পরাজিত হয় না। তারা শহীদ অথবা বিজয়ী হয়ে গাজী হয়। …জামায়াত নেতা বলেন, ভারতীয় হামলার বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানি মুসলমানরা যে ঐক্যবদ্ধ আজকের মিছিল তারই প্রমাণ। তিনি বলেন, আমাদের মানচিত্র অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। হানাদার শত্রুকে নির্মূল করে আসাম, পশ্চিম বাংলা, কাশ্মীরকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করে আমরা এই মানচিত্র পূর্ণ করে ছাড়বো।
সুনীল শুক্লার একটি পোস্টকার্ড পেলাম। সামনের দিকটাতে কলমের টানে স্ক্যাচ। পাকসেনা দু’জন হাত উঁচিয়ে আত্মসমর্পণ করছে। পেছনে ক’জন রাজাকার। লুঙ্গি, হাফ প্যান্ট পরা মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র তাক করে আছে। অপর পৃষ্ঠায় অর্ধেক অংশে ঠিকানা, বাকি অর্ধেকে দু’লাইন মাত্র লেখাÑ যুদ্ধ জয়ের অপেক্ষায় আছি। আপনারা কেমন? জয়বাংলা।
সম্ভবতো রণাঙ্গন থেকে আর কোনো খবরাখবর প্রেরণের নিয়ম নেই। এমনিতেই একদিন ট্রেনিং ক্যাম্পে বসে ছবি এঁকে বড় বিপদে পড়েছিল বেচারা। তবুও বুঝতে পারলাম মুক্তিফৌজ এখন ফ্রন্টফুটেই আছে।