পেঁয়াজের দাম দু’শ টাকা, কমই তো। বক্তব্যটা এক সাধারণ ভোক্তার। তার কথার মাঝে যে ক্ষোভের আগুন জ্বলছিল তা স্পষ্ট। এই আগুন আজ প্রতিটি ভোক্তা হৃদয়ে জ্বলে উঠছে। পেঁয়াজের বর্তমান বাজার মূল্য ডাবল সেঞ্চুরি ছাড়িয়ে ২২০ থেকে ২৫০ টাকা। এটা কতটুকু অসহনীয় তা ক্রেতাসাধারণ টের পাচ্ছেন। কিন্তু ক্ষমতাসীন সরকার বাহাদুরের টনক নড়ছে না। পেঁয়াজের এই অস্থিতিশীলতা বেশ কিছুদিন যাবৎ চলে আসলেও সবাই নীরব, কেবল সরব অসাধু পেঁয়াজ কারবারিরা। এ নিয়ে সকল শ্রেণিপেশার মানুষের মধ্যে এক ধরনের বাড়তি বেদনা কাজ করছে। পেঁয়াজের ক্রমাগত দাম বৃদ্ধিতে এটিকে ষড়যন্ত্র আখ্যায়িত করে জাতীয় সংসদে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সংসদ সদস্যরা। দেশজুড়ে চলছে ক্ষোভ। কিন্তু এখনো কোনো প্রতিকার নেই।
গত ১৪ নভেম্বর রাতে একাদশ সংসদের পঞ্চম অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘মিসর ও তুরস্ক থেকে কিছুদিনের মধ্যে ৫০ হাজার মেট্রিক টন পেঁয়াজ আসবে। আমদানি করা পেঁয়াজ জেলায় জেলায় পাঠানো হবে। টিসিবি ট্রাকে করে তা বিক্রি করবে।’ [সূত্র : কালের কণ্ঠ, ১৫.১১.১৯] এর আগে পেঁয়াজের মূল্য বৃদ্ধিতে ১৭ সেপ্টেম্বর বাণিজ্য সচিব ড. জাফর উদ্দিন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকের পর উদ্বিগ্ন না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, ‘দাম দু-একদিনের মধ্যে স্বাভাবিক হয়ে আসবে। পেঁয়াজের মজুদ সন্তোষজনক। বাজারে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ [সূত্র : আমাদের সময়, ০১.০৯.১৯] সরকার প্রধান থেকে শুরু করে সরকারের দায়িত্বশীলদের এ বক্তব্য যে শুধু লোকদেখানো তা সাধারণ মানুষের আর বুঝতে বাকি নেই। এভাবে মুখরোচক নানা কথা বলে মুনাফালোভী পেঁয়াজ কারবারিদের বরং সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে। যা দৃশ্যমান বাস্তবতা বৈকি।
১৫ নভেম্বরের পত্রিকাগুলো ছিল পেঁয়াজময়। সংবাদ বর্ণনায় পেঁয়াজের বিরক্তিকর কথাই উঠে এসেছে। খবরে বলা হয়, দুই মাস ধরে পেঁয়াজের দাম লাগামহীনভাবে বাড়তে বাড়তে ডাবল সেঞ্চুরি ছাড়াল। একদিনের ব্যবধানে গত ১৪ নভেম্বর কেজিপ্রতি ৫০ থেকে ৬০ টাকা বেশি দরে পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে। রাজধানী ঢাকার বাজারে দাম ছিল ২২০ টাকা। ঢাকার বাইরে ১৭০ থেকে ২১০ টাকা পেঁয়াজ বিক্রির খবর পাওয়া গেছে। এটি পেঁয়াজের দামের রেকর্ড। টিসিবি’র তথ্য মতে, ২০১৬ সালে পেঁয়াজের দাম ছিল ৩৯ টাকা। ২০১৭ সালে ৫৫ টাকা, ২০১৮ সালে ৫৬ টাকা। চলতি বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর ছিল ৪৫ টাকা। ২৯ সেপ্টেম্বর দাম দাঁড়ায় ৮০ টাকায়। বর্তমানে পেঁয়াজ ২২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যা রীতিমতো রেকর্ডই নয়, ভোক্তা বধের অবস্থায় চলে গেছে। এতে করে সাধারণ মানুষ পেঁয়াজের আকাশচুম্বী দরে দুর্বল হয়ে পড়ছেন। এই অস্থিতিশীলতায় ব্যবস্থার বিপরীতে নানা কথা বলে অবৈধ কারবারিদের আরও উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে গত বছর দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে ২৩ লাখ ৩০ হাজার টন। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে আমদানি হয়েছে ১০ লাখ ৯২ হাজার টন। সরকারি সংস্থাগুলোর হিসাব অনুযায়ী দেশে পেঁয়াজের মোট সরবরাহ ৩৪ লাখ ৬৬ হাজার টন। বছরে দেশে চাহিদা ২৪ লাখ টন। বর্তমানে প্রশ্ন-উদ্বৃত্ত ১০ লাখ ৬৬ হাজার টন পেঁয়াজ গেল কোথায়। ভোক্তাদের অভিযোগ, পাইকারি ব্যবসায়ীরা ইচ্ছামতো দাম বাড়াচ্ছেন। এটাই চরম সত্য কথা। কিন্তু এদের বিরুদ্ধে সরকারের কোন প্রতিক্রিয়া নেই।
সরকার সংশ্লিষ্ট সংস্থার লোকদেখানো মহড়া আর কথা মিষ্টি মহরৎ মুনাফাভোগী মন্দ মানুষের প্রতি মৌন সমর্থন কি না সেটাই ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবৈধ অদ্ভুত এই ব্যবসায়ী চক্র এত সাহস কোত্থেকে পাচ্ছে তা নিয়েই ভাবছে সাধারণ মানুষ। ভোক্তার বারোটা বাজিয়ে এরা আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার যে অনৈতিক অশুভ অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে তা কেবল সাধারণ মানুষের সাথে প্রতারণাই নয়, সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে পকেটে ঢুকিয়ে গোঁফে তেল মেরে আয়েশী বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে বৈকি। আপাতঃদৃষ্টিতে পেঁয়াজ কারবারিদের ভয়ংকর মূল্য বৃদ্ধির বাজার বাহাদুরি দেখে তাই মনে হচ্ছে।
নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিতিশীলতা আসলে নতুন কিছু নয়। এটা আমাদের চলমান বাস্তবতা। আজ পেঁয়াজের দামে যে মূল্য কারসাজি চলছে কাল হয়তো রসুনের দরে দেখা দেবে নৈরাজ্যকর নতুন খেলা। পরশু আলু তরশু কাঁচামরিচের ঝালে হাফিয়ে উঠবে ক্রেতাসাধারণ। পরের দিন ডাল, তেল, চালের মূল্য সংকটে নাকাল হবে দেশ। এর রেশ কাটতে না কাটতেই মাছ, মাংস, সবজিসহ অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের দামে অসন্তুষ্টি দানা বাঁধবে। এভাবে একের পর এক নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে বাড়তি মুনাফা লুটে নিচ্ছে অবৈধ মুনাফাভোগীরা। বিভিন্ন অজুহাতে তারা বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে অতিরিক্ত মূল্য হাঁকানোর মাধ্যমে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার চেষ্টা করছে। মূল্য বৃদ্ধির এই অনৈতিক চাপে পিষ্ট হচ্ছে স্বল্প আয়ের মানুষ। মূল্য মুমূর্ষু মানুষের পকেট কানা করে এই ফায়দা হাসিলের চেষ্টা আসলে কতটুকু যুক্তিযুক্ত তা ভেবে দেখা প্রয়োজন।
যোগানের তুলনায় চাহিদা বেশি থাকলে দাম কমবেশি বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। প্রায় সব দেশের বাজারে এমনটি ঘটে থাকে। কিন্তু আমাদের বাজার ব্যবস্থায় শুধু বাড়েই না, অবৈধ ব্যবসায়ীরা ভোক্তাপ্রাণের বারোটা বাজিয়ে তাদের জীবন নষ্ট করে দেয়। নীতিনৈতিকতাকে তুড়ি মেরে সর্বদাই অবৈধ অগ্রহণযোগ্য উপায় অবলম্বন করছে তারা। যেখানে দেশ ও সাধারণ মানুষের কথা না ভেবে নিজেদের অবৈধ অর্থ কামানোর কথাই সর্বদা ভাবা হচ্ছে। পেঁয়াজের বর্তমান বাজার দেখে মনে হচ্ছে- পেঁয়াজে যন্ত্রণাকর ঝাঁজ, মুনাফা আদায়ই আসল কাজ। এ নীতিভ্রষ্ট বাস্তবতা আমাদের স্বভাব চরিত্রে স্থায়ী আসন গেঁড়ে বসে আছে। সাধারণ মানুষকে এই মুনাফাভোগীদের কবল থেকে মুক্ত করতে হলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়া কোন বিকল্প নেই।
গত মাসখানেক ধরে পেঁয়াজের অস্থিতিশীল বাজার ব্যবস্থা ক্রেতা সাধারণের ভোক্তা জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলছে। এতে মারাত্মক বিপাকে পড়েছে নিম্ন আয়ের মানুষ। দেশের অগণিত মানুষকে বিপদে ফেলে অনৈতিক অর্থ কামিয়ে নিচ্ছে গুটিকয়েক অসাধু ব্যবসায়ী। যাদের কাছে পরাভূত সরকার সাধারণ মানুষ। সরকারের যথেষ্ট ক্ষমতাকেও পরোয়া করছে না এসব অপ ধান্দাবাজ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী। আসলে এর অর্থ কী জানতে চায় জনগণ। সরকার ও সাধারণ মানুষের সাথে প্রতিযোগিতায় নামা এসব পেঁয়াজ প্রবাঞ্চকেরা রাষ্ট্রযন্ত্রকে পরাস্ত করে দেদারসে চালিয়ে যাচ্ছে মানুষ ঠকানোর কঠিন কারবার। ২৫০ টাকা কেজি পেঁয়াজের দর দেখে ভোক্তাগণ ভেবে নিচ্ছেন আসলে সরষের মধ্যেই ভূত লুকিয়ে আছে। যদি সরষেতে ভূত থাকে তাহলে সে ভূত তাড়ানো যে অসম্ভব এটা সবাই জানে। আর সে ভূতই বাজারে অস্থিতিশীল অরাজকতার অস্বাভাবিক খেলা খেলে যাচ্ছে। সরষে ও ভূতের ব্যাপারটি এ কারণেই সামনে আসছে, যখন দেখা যায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দাম কমার হুঁশিয়ারি দেওয়ার পরও ২২০ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ বিক্রি হয়, তাহলে মানুষের আর বুঝতে বাকি থাকে না যে এগুলো আসলেই লোকদেখানো লৌকিকতাই কেবল।
সাধারণ মানুষের প্রশ্ন, কেন এমনটা হচ্ছে? এটা কি সরকারের অবহেলা না অযোগ্যতা; না সরকারের ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা সুযোগসন্ধানী স্বার্থান্বেষী মহলের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এ ব্যবসায়ী চক্র পেঁয়াজে ফায়দা লোটার চেষ্টা করছে। নইলে কেনই বা সাধারণ মানুষকে ২৫০ টাকা কেজি পেঁয়াজ কিনে খেতে হবে। সম্প্রতি ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিলে বাজার অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। তারই জের ধরে অনেক ব্যবসায়ীকে জরিমানাও করে ভ্রাম্যমাণ আদালত। ব্যাস দায়িত্ব এখানেই শেষ। পরে পেঁয়াজের দাম কিছুটা কমে আসলেও বর্তমান বাজার রেকর্ড সৃষ্টি করে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও অসাধু ব্যবসায়ীদের মূল্য বৃদ্ধির এই লুকোচুরি খেলায় চিড়েচ্যাপ্টা সাধারণ মানুষ। অন্ততঃ এসব মানুষের কথা চিন্তা করে অবৈধ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠিন ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। তবে এর জন্য সামান্য টাকা জরিমানা করে এদেরকে ব্যবসায়ের অনুমতি দিলে চলবে না। জরিমানার পাশাপাশি ব্যবসাভ্রষ্ট এসব মানুষকে তাৎক্ষণিক সাজা দিয়ে জেলে পাঠাতে হবে। কারণ কোন অভিযুক্ত ব্যবসায়ীর ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড হলে পরবর্তীতে সে ৫ লাখ টাকা মুনাফা অর্জনের অবৈধ চেষ্টা চালিয়ে যাবে, এতে কোন সন্দেহ নেই। তাই শুধু জরিমানা না করে অপরাধ অনুযায়ী কারাদণ্ডের ব্যবস্থা করতে হবে।
[বিশ্বজিত রায়, সাংবাদিক ও কলামিস্ট, জামালগঞ্জ]