1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
  3. [email protected] : wp-needuser : wp-needuser
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ০৯:০৩ অপরাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

জয়পুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় : সুন্দরের গহীনে লুকিয়ে আছে দেশভাগের করুণ আখ্যান

  • আপডেট সময় বুধবার, ৬ নভেম্বর, ২০১৯

শামস শামীম ::
উপরে নীলসাদা মেঘের ওড়াওড়ি। নিচের চারদিকে নীলাভ জলের কান্তার। ছোট একখ- ভূমি জেগে আছে অথৈ জলের বুকে। সেখানে জাতীয় পতাকার রঙে আবৃত একটি প্রতিষ্ঠানের ছায়া নীলাভ জলে প্রতিবিম্বিত হয়ে এক অন্যরকম আবহ তৈরি করে। জলের বুকে লাল-সবুজের ঢেউ তোলা সেই ছায়া এখন আকৃষ্ট করছে টাঙ্গুয়ার হাওরে বেড়াতে যাওয়া হাজারো পর্যটককে। তবে এই অনিন্দ্য সুন্দরের মধ্যে শাশ্বত এক দুঃখবোধ ধারণ করে আছে বিদ্যালয়টি। সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে দেশভাগের নির্মম আখ্যান লুকিয়ে আছে প্রতিষ্ঠানটির নামের সঙ্গে।
তাহিরপুর উপজেলার দুর্গম জয়পুর গ্রামটি টাঙ্গুয়ার হাওরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। এক সময় এই গ্রামে বসবাসকারীদের সবাই ছিলেন সনাতন ধর্মাবলম্বী। আজ তাদের প্রতিষ্ঠিত গ্রামটি টিকে থাকলেও হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন লোকও আর গ্রামটিতে বসবাস করেন না। বর্তমানে গ্রামটিতে অন্তত ৪০টি মুসলিম পরিবার বসবাস করে। ছেচল্লিশের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার শুরুতেই গ্রাম ছাড়তে থাকেন হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা। ১৯৪৭ সনে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে ভারত ভাগ হলে এর ছাপ পড়ে প্রত্যন্ত এই অঞ্চলেও। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠলে মানসিক নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে চিরতরে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত গ্রামটি ছেড়ে চলে যান একে একে সবাই। তবে এর আগেই প্রান্তিক মানুষের শিক্ষাদীক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠা করে যান এই স্কুলটি।
১৯৪০ সালে পাটলাই নদীর উত্তরপূর্বতীরে টাঙ্গুয়ার হাওরঘেরা জয়পুর গ্রামেই বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন জয়পুর গ্রামবাসী। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানটি লাগোয়া ছিলাইন তাহিরপুর গ্রামে অবস্থিত হলেও সেই প্রতিষ্ঠাকালীন জয়পুর নামেই টিকে রয়েছে। এখন প্রতিষ্ঠানটি নামেই কেবল প্রতিষ্ঠাকালীন জনগোষ্ঠীর স্মৃতি ধারণ করে আছে। তবে শিক্ষার্থীদের কেউই এই দেশভাগের নির্মম আখ্যানের খবর জানেনা। জানেনা এলাকার সচেতন মানুষজনও। টাঙ্গুয়ায় মুগ্ধ দেশ-বিদেশের পর্যটকরাও সেই গল্প জানেন না। কেউই খবর জানেনা কোন দুঃখে স্কুল প্রতিষ্ঠাকারী গ্রামের সবাই চিরতরে দেশান্তরি হলেন।
প্রায় দুই মাস আগে ক্ষুদ্র মেরামত প্রকল্পের বরাদ্দে একতলা পাকা ভবনের এই স্কুলটিকে পুরোটাই সবুজ আর লালে রঙচঙ করা হয়েছে। সরকার স্কুল সংস্কারে যে বরাদ্দ দিয়েছে তা থেকে অন্যান্য সংস্কার করেও পুরোটাই রঙকাম করা হয়েছে। পুরো ভবনটিই লাল সবুজের প্রচ্ছদে মোড়া। প্রতিটি পিলারে দেওয়া হয়েছে লাল রঙের টান। প্রতিটি জানালার কার্নিশেও রয়েছে লাল রঙের টান। সিঁড়ির উপরের অংশের চিলেকোঠা আকৃতির পুরো ঘরটি সবুজে রাঙিয়ে মাঝখানে লালবৃত্ত দিয়ে পতাকার আকৃতি দেওয়া হয়েছে। শেষ বিকেলে যখন সূর্য ডুবো ডুবো করে হাওরের নীল জলে তখন লাল সবুজে মোড়া বিদ্যালয়টি অন্যরকম রূপ নিয়ে ধরা দেয়। সুন্দরের ভেতর দিয়ে বাঁচিয়ে রাখে এক চিরন্তন দুঃখবোধের গল্পকে।
দুর্গম এলাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন প্রায় ৭৯ বছর আগে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আশপাশের পিছিয়েপড়া ছেলেমেয়েদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে। সেই উদ্দেশ্য এখনো পুরোটা বাস্তবায়ন হচ্ছেনা। দুর্গম এলাকায় অবস্থানের কারণে কোন শিক্ষক এখানে দায়িত্ব নিতে চান না। যার ফলে ৭ পদের স্কুলে বেশিরভাগ সময়ই শূন্য থাকে। গত ১০ বছর ধরে চারজনের পদ শূন্য রয়েছে। তিনজন শিক্ষক কোনমতে ২৪৩ শিক্ষার্থীকে পাঠদান করছেন। এর মধ্যে একজন শিক্ষক মো. হাদিউজ্জামান যিনি এই গ্রামেরই সন্তান। ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তাকেই নিয়মিত স্কুলে দেখা যায়। শিক্ষক সংকটের কারণে পড়ালেখার মান নিম্নমুখি হওয়ায় আজ পর্যন্ত বিদ্যালয়ের কোন শিক্ষার্থী মেধাবৃত্তি পায়নি। গত বছর প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় এই বিদ্যালয়ে পাসের হার ৭৯ শতাংশ।
স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, ক্ষুদ্র মেরামতের বরাদ্দে স্কুলটি সম্প্রতি লাল-সবুজ রঙে আবৃত হয়েছে। চারদিকে জলের বিস্তার থাকায় লাল-সবুজের ঢেউ জলে প্রতিবিম্বিত হয়ে অন্যরকম আবহ তৈরি করে। কিন্তু এই সুন্দরের আড়ালেও এক করুণ গল্প লুকিয়ে রয়েছে। যে গ্রামবাসী বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দেশভাগের নির্মম ঘটনায় আজ তারা চিরতরে দেশান্তরি। পঞ্চাশের দশকেই তারা বাস্তুভিটা ছেড়ে চলে গেছেন।
বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি আব্দুল আলিম বলেন, কাক্সিক্ষত লক্ষ্য পূরণ করতে হলে স্থানীয় শিক্ষক প্রয়োজন। বিশেষ বিবেচনায় স্থানীয় শিক্ষক নিয়োগ দিলে বিদ্যালয়ে শিক্ষক অবস্থান করবেন। শিক্ষক সংকটের কারণে কোনমতে আমাদের বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
তাহিরপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান করুণা সিন্ধু চৌধুরী বাবুল বলেন, দেশভাগের বেদনা উপমহাদেশের ইতিহাসে এক করুণ ও নির্মম আখ্যান। ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্রের জন্ম হলে কিভাবে মানুষ বিভক্ত ও দেশান্তরি হয় তার উদাহরণ এই উপমহাদেশ। তিনি বলেন, দেশভাগ হাওরের মানুষদেরও দেশান্তরি করেছে। জয়পুর তার উদাহরণ। তবে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে এই অজোপাড়া গাঁয়ের আধুনিক মানুষজন যে লক্ষ্যে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তা বাস্তবায়ন করতে হবে।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com