গতকালের দৈনিক সুনামকণ্ঠের খবরে প্রকাশ : ১. বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার পলাশ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ইনজেকশন নেওয়ার জন্যে বিশ্বম্ভরপুর সরকারি হাসপাতালে গেলে সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্র দেখাতে বলার অপরাধে চিকিৎসকের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়েছেন চেয়ারম্যান সাহেব এবং চেয়ারম্যান সাহেবের ছেলে। এ সময় চিকিৎসককে মারধর করে কানের পর্দা ফাটিয়ে দেয়া হয়েছে। ২. তাহিরপুর উপজেলার ইউএনও’র বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, দেশে কেনা গরুকে চোরাচালানের গরু সাব্যস্ত করে নিলামে বিক্রি করার অভিযোগে। গরুর মালিক বৈধ কাগজপত্র দেখালেও সে কাগজপত্রকে আমলে নেওয়া হয়নি। অর্থাৎ কার্যত যে অপরাধী নয় তাকে অপরাধী বানিয়ে দেওয়া হলো। ৩. পুলিশ কর্তৃক আটককৃত ব্যক্তিকে ভ্রাম্যমাণ আদালতে উপস্থিতকরণের ঘটনায় তাহিরপুরের ওসিকে লিখিত ব্যাখ্যা প্রদানের নির্দেশ প্রদান করেছেন তাহিরপুর থানা আমলকারী আদালতের জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট। উল্লেখ্য যে, পুলিশ কর্তৃক আটককৃত ব্যক্তিকে বেআইনিভাবে ভ্রাম্যমাণ আদালতের সমীপে উপস্থিতকরণ একটি গর্হিত অপরাধ বলে আদালত আদেশনামায় উল্লেখ করেন। ৪. পরিকল্পনামন্ত্রী বলেছেন, ‘অপচয় দুর্নীতির চেয়েও ভয়ঙ্কর’।
উপরোক্ত চারটি ঘটনাপ্রসঙ্গ বিবেচনায় নিলে সাধারণ মানুষের কাছে কী বার্তা প্রেরিত হচ্ছে, একবার ভেবে দেখুন এবং সেই সঙ্গে বুদ্ধিবিবেকের কষ্টিপাথরে ঘষে বিবেচনা করুন, আমরা আমজনতা কোথায় আছি, আমাদের ভোটে যাঁরা নির্বাচিত হন, আমাদের পকেটের টাকায় যাঁদের বেতন হয়, তাঁরা আমাদের সঙ্গে কী করছেন। সকলকে দোষ দিচ্ছি না, সকলে এমনটি করছেন না, কিন্তু যাঁরা করছেন তাঁরা অনাদিকাল থেকে পার পেয়ে যাচ্ছেন কেন?
সরকারি কর্মচারী তাঁর উপর অর্পিত নির্দিষ্ট কাজ করবেন, কাজ করে বেতন নেবেন, কিন্তু কাজটি না করে ফেলে রেখে দীর্ঘসূত্রিতার হিমাগারে কাজকে তুলে রেখে সময়ের অপচয় করবেন কেন? কিংবা যে-কাজটির জন্যে তাঁকে বেতন দেওয়া হয়, সে-কাজটি করে দিয়ে ঘুষ নেবেন কেন? আর ঘুষ নেওয়া কিংবা সময়ের অপচয় করার পর তিনি কী করে কোন্ নৈতিকতা, আইন কিংবা যুক্তির জোরে বেতন নেওয়ার অধিকারী হতে পারেন? প্রশ্নটা অসঙ্গত বলে তো মনে হয় না। সাধারণত কোনও একজন দা-কামলাকে কাজে লাগালে কাজ শেষে তাঁকে পারিশ্রমিক দেওয়া হয়, কিন্তু এই নিয়ম আমাদের সরকারি দপ্তরগুলোতে কার্যকর নয়, সেখানে কাজ না করা হলেও মাসের পর মাস বেতন পরিশোধ করা হয় এবং প্রকাশ্যে স্বীকারও করা হয় দীর্ঘসূত্রিতার কর্মসংস্কৃতিকে এবং শেষ পর্যন্ত পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘অপচয় দুর্নীতির চেয়েও ভয়ঙ্কর। কেননা দুর্নীতি হলে তো ধরা যায়, কে কত টাকা খেয়ে ফেলেছেন। কিন্তু অপচয়ের ব্যয় তো নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। এছাড়া প্রকল্পে সবচেয়ে বড় অপচয় হচ্ছে সময়। তাই অপচয় রোধ করে দ্রুত প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রয়োজন।’ মন্ত্রীর এই ভাষ্যের মধ্যে দেশের সরকারি দপ্তরগুলোতে ‘সময়ের অপচয়’-এর আড়ালে দীর্ঘসূত্রিতার সংস্কৃতি প্রচলিত আছে তার ইঙ্গিত মেলে।
সত্যি বলতে কী এই বাংলাদেশটিকে একটি অদ্ভুত দেশে পরিণত করা হয়েছে। আসলে জীবনানন্দ কথিত ‘অদ্ভুত আঁধার’-এ নিমজ্জিত হয়ে আছে এই দেশ। অথবা শামসুর রাহমান কথিত ‘অদ্ভুত উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’-এর বাস্তবতা পরিলক্ষিত হছে চারপাশে। একটু ভাবুন বিষয়টা কতোটা ভয়ঙ্কর। যাঁরা আইন জানেন না কিংবা আইন জেনেও আইনকে লঙ্ঘন করেন তাঁরা কেন, কোন কারণে কিংবা কীসের জোরে-যোগ্যতায় সংশ্লিষ্ট পদগুলোতে বহাল আছেন, তাঁরা কেন স্বপদে অযোগ্য বিবেচিত হচ্ছেন না? যিনি আইন প্রয়োগ করবেন তিনি কেন আইন ভঙ্গ করবেন এবং আইন ভঙ্গ করার পরও তাঁর পদে তিনি কী করে বহাল থাকেন? আইন ভঙ্গ করে আইন প্রয়োগের দায়িত্বে থাকার সুনির্দিষ্ট আইনটি কী? যাঁরা কাজ করে না তাঁদেরকে কাজে বহাল রাখার যৌক্তিকতা কী? এই পরিপ্রেক্ষিতে জবাবদিহিতার সার্বভৌমত্বকে অকার্যকর করে রাখা হয়েছে কেন? সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে জবাবদিহিতার কার্যকারিতাকে কার্যকর করবে কে? তিনি তো আছেন। নেই এমন তো নয়। সারাদেশেই আছেন। আপনারা যে যেখানে আছেন সক্রিয় হোন। আপনাদের মুখের দিকে মানুষ চেয়ে আছে। অত্যাচারকে আর কতো সহ্য করবেন। দুষ্টের দমনে শিষ্টরা এগিয়ে আসুন। মানুষকে রক্ষা করুন।
আমরা তাহিরপুর থানা আমলগ্রহণকারী আদালতের জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। মনে হচ্ছে এইভাবে আইনভঙ্গকরণের ক্ষেত্রে আইনি প্রক্রিয়ায় আদালতের কাছে ব্যাখ্যা প্রদানে বাধ্য করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এই প্রসঙ্গে চূড়ান্ত কথা একটাই : এই মুহূর্তে সাধারণ মানুষের কামনা এই যে, আইনভঙ্গের কারণে, যে কোনও অন্যায়ের প্রতিরোধে জবাবদিহিতার সংস্কৃতি সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত হোক।