প্রলম্বিত বর্ষায় ধূম্রবরণ মেঘ অপসৃত হয়নি। এরই ফাঁকে নীল আকাশে দৃশ্যমান পুঞ্জিভূত শুভ্র মেঘমালা। রঙ বদলের মেঘে মেঘে বিনি ডাকের চিঠি এক বার্তা পৌঁছে দিয়ে যায়Ñ শরৎ এসে গেছে। সেই সাথে জানিয়ে দেয় শারদীয় দুর্গাপূজার আগমন বার্তা। সনাতনধর্মী বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসবের সূচনা। দিগন্তজুড়ে কাশফুলের দোলা। ঝরা শিউলির আল্পনা, সাদা মেঘের ভেলা এই নিয়ে বাংলার শরৎ। জলবায়ু পরিবর্তনে ঋতু চরিত্র বদলে গেছে। শরতে বানভাসী বাংলা। জলমগ্ন প্রান্তর, কাশবন। তবুও সকালের জানালায় বাদলভাঙা সোনারঙ রোদের খিলখিল হাসিতে শরতের পুলকিত আহ্বান। এ ঋতু সবাইকে জড়িয়ে রাখে এক মায়াবী বন্ধনে। এ বন্ধনের ব্যাপ্তি সর্বজনীন। এমন আত্মিক বন্ধনের এক শুভলগ্নে শাশ্বত মাতৃরূপের বিশ্বরূপীণ প্রকাশে হিমালয় কন্যার পিতৃগৃহে আগমন। মহালয়ার শুভক্ষণে শুরু হয় সেই শুভাগমনের প্রস্তুতি। মর্ত্যরে প্রকৃতিতে আবাহনের সুর, আগমনীর পুলক। ধূপধুনা, পুষ্প চন্দনের শুচিস্পর্শ, মঙ্গল শঙ্খের ধ্বনি আর ঢাক কাসরের সুর লহরী আমাদেরকে প্রাণিত করে, স্পন্দিত রাখে ক’টি দিনের জন্য। এ উৎসব আমাদের আবেগের সাথে এমনভাবে মিশে আছে যে, এ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার কোন অবকাশ নেই। দুঃখ, কষ্ট, বিষাদ, দুর্যোগ, দুর্ঘটনা ছাপিয়েও প্রাণ প্রাচুর্য্যরে সরবতা-মুখরতা জানান দিয়ে যায় আমাদের মানবিক হার্দিক অস্তিত্ব। উৎসব সর্বজনীনতার সম্পৃক্তিতে আপন উপলব্ধির নবরূপায়ণ। হৃদয়ের জাগরণে বেঁচে থাকার অনুভব। রবীন্দ্রনাথের শারদোৎসব নাটকের সেই উপানন্দ হয়ে একলা দূরে সরে থাকার মত কাউকে হয়তো আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।
সৃষ্টির আদিকাল থেকেই দেবী দুর্গার আরাধনা। শ্রীকৃষ্ণ গোলকধামে রাসমণ্ডলে দেবীর পূজা করেছিলেন। স্বয়ং ব্রহ্মা দেবীকে আবাহন করেছিলেন মধু কৈটভ অসুরদ্বয়ের বিনাশের জন্য। ত্রিপুরাসুরকে বধ করার আগে শিব এবং দুর্বাশার অভিশাপগ্রস্ত ইন্দ্র দুর্গার আরাধনা করেছিলেন। সকল দেবতার শক্তি ও রূপ নিয়ে আবির্ভূতা দশভুজা দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করে স্বর্গ পুনরুদ্ধার করেছিলেন। মহাভারতের বিরাট পর্বে যুধিষ্ঠির ত্রাণ মন্ত্র পাঠ করেছিলেন দেবীর উদ্দেশ্যে। এই স্ত্রোত্রে দেবী চতুর্ভুজা। যুদ্ধযাত্রার প্রাক্কালে অর্জুন দেবীর যে স্তব করেছিলেন সেখানে তিনি বিন্ধ্যবাসিনী। রামচন্দ্র সীতা উদ্ধারের জন্য শরৎকালে দুর্গাপূজা করেন। পুরাকালে রাজা সুরথ রাজ্য পুনরুদ্ধারের জন্য বসন্ত ঋতুতে দেবীর আরাধনা করেছিলেন। দেবী কখনও দ্বিভুজা, কখনও চতুর্ভুজা আবার কখনও দ্বাদশভুজা, অষ্টাদশভুজা হয়ে ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে, ভিন্ন রূপে, ভিন্ন মন্ত্রে, বিভিন্ন সময়ে নানাভাবে পূজিত হন। আকৃতিতে ভিন্নতা থাকলেও প্রকৃতিতে দুর্গা সততই দুর্গতিনাশিনী। কিন্তু কী এমন দৈবযোগসূত্রে দেবী বাঙালির হৃদয় আবেগে একচ্ছত্র অধিকার বিস্তার করে আছেন তা বলা কঠিন। আর কি এমন রহস্য মাহাত্ম্যে কৈলাস পর্বতবাসিনী দেবী সমতলের এই শস্য-শ্যামলা বাংলার ছায়া নিবিড় গৃহকোণকেই আপন করে নিলেন তাও বুঝার সাধ্য নেই।
দেবী সপরিবারে পূজিতা হন কেবল বঙ্গ দেশেই। বৈচিত্র্যময় সনাতন ধর্মের বিচিত্র ভাবনা এখানেও সকল ধর্মীয় দর্শনকে অতিক্রম করে তার অনন্য ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্যকে প্রতিষ্ঠা করেছে। পরিবার সমন্বিতা দুর্গা বাঙালির কাছে দেবীই শুধু নন, একাধারে মাতা এবং কন্যা। সপরিবারে যুদ্ধযাত্রা হয় না। তাই সশস্ত্রা দশ প্রহরণ ধারিণী দুর্গা হয়ে উঠেন একান্তই ঘরের মেয়ে উমা। দীর্ঘদিন স্বামীগৃহে অবস্থানের পর স্নেহময়ী জননী মেনকার আহ্বানে পিত্রালয়ে আগমন। যেন বাঙালি গৃহস্থ পরিবারের নিতান্ত সহজ-সরল ঘটনা। শারদোৎসবের প্রাণময় ঘরোয়া রূপ। সরল আবেগের। কিন্তু কী হৃদয়স্পর্শী ভাব কল্পনা। স্বর্গের দেবতা স্বেচ্ছায় এসে স্থান নেন মানুষের ঘরে। বাঙালি সমাজ ব্যবস্থার যৌথ পারিবারিক কাঠামোর সনাতনী ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠা পায় পরিবার সমন্বিত দুর্গা প্রতিমায়। দেবালয়ের ভয়, সম্ভ্রমের বেষ্টনী ভেদ করে পারিবারিক সম্পর্কের শ্রদ্ধা-ভক্তি-বাৎসল্যে স্বল্প ক’দিনের অবস্থান কি মধুময় আবেগময় করে তুলে শুধু পূজামণ্ডপ নয়, প্রতিটি গৃহকোণ। সঙ্গে জামাতা। কিন্তু কেমন যেন সংকোচে, আড়ালে। তবে কি শ্বশুরালয়ে জামাতার কোন অনাদর? কদাপি নয়। বাঙালি সংস্কৃতিতে জামাই আদরের তুলনা নেই। ভোলাভালা শিবকে নিয়ে শাশুড়ি মেনকা তো মরমে মরে যান। স্বর্গের দেবতা আর মর্ত্যরে মানুষের এমন ভাব সাদৃশ্য, এমন সঘন মিতালীর নাগাল পাওয়া যায় না আর কোন পূজায়, পার্বণে, কোন উৎসবে। মন্দিরের মৃন্ময়ীদেবী মন্ত্র গুণে প্রাণ প্রতিষ্ঠায় ভক্ত হৃদয়ে চিন্ময়ী হয়ে উঠেন। আর অন্তরের উমা প্রাণময়ী হয়ে উঠেন অনুভব আর হৃদয়ের আবেগে। নির্দোষ বোধ বিশ্বাসে।
মাতৃ আরাধনার শাস্ত্রীয় নিয়মাচার পূজা মণ্ডপে সীমাবদ্ধ থাকলেও উৎসবের ব্যাপ্তি ছড়িয়ে পড়ে প্রকৃতির নানা আয়োজনে, সমাজের বিভিন্ন স্তরে। নদী মেখলা, কাদা পলির এ বদ্বীপে সংমিশ্রিত বাঙালি জাতিসত্বার গৌরবময় ঐতিহ্যের সাংস্কৃতিক মুকুরে হাজার উৎসবের অজস্র রঙ, সহস্র রূপ- নববর্ষ, নবান্ন, ২৫শে বৈশাখ, ২১শে ফেব্রুয়ারি, বই মেলা, পৌষ পার্বণ, বসন্ত উৎসবের মত শারদোৎসবও এক অনিবার্য উত্তরাধিকার। এতে প্রতিফলিত আমাদের যুগ যুগান্তরের লোকায়ত ঐতিহ্য, কালান্তরের সংস্কৃতি। শারদোৎসবকে ঘিরে কত আগমনী সংগীত, বিজয়া বিসর্জনের গান। কত আনন্দ-বেদনার সুর। কত পদাবলি পাঁচালি, কত সাহিত্য, চারু কারুকলার বিচিত্র প্রকাশ বঙ্গ সংস্কৃতিকে পুষ্ট করে রেখেছে। আমাদের পরিচয়কে করেছে উন্মোচিত, সুস্পষ্ট। আর পূজার যত উপাচার উপকরণ, পঞ্চ পল্লব সে তো- আম্র, পাকুড়, বট, অশ্বথ, জগডম্বুর পল্লব। মহাস্নানের জলে জাম গাছের কষ, বেড়ালা গাছের, কুল গাছের, বকুলগাছের কষ। নবপত্রিকায় – কলাগাছ, কালকচু, হরিদ্রা, জয়ন্তী, মানকচু, বেল, ডালিম, ধানগাছ, শ্বেত অপরাজিতার লতা, পাটের আঁশ, শিমুলসুতা। পঞ্চ শষ্যে- ধান, মাষকলাই, তিল, মুগ, যব। আরো কত ফুল ফল। দুর্বা বিল্বপত্র। প্রতিটি উপাচার উপকরণের এক একটি বৈশিষ্ট্য। এর আলোচনা এ পরিসরে নয় তবে এগুলি যে এই বাংলার কাদা পলি মাটি সঞ্জাত, একান্তই এদেশের কৃষি ও উদ্ভিদ থেকে সংগৃহীত তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলার প্রকৃতি আর বাঙালির সকল পরিচয় নিয়েই তো এই উৎসব। পুজোয় অংকিত আল্পনা, চিত্রিত ঘট, অলংকরণকৃত পট, শিল্পীত আরতি, সজ্জিত পুষ্পমাল্য, ঝংকৃত উলু, নিবেদিত অঞ্জলি, নিনাদিত শঙ্খ, লহরিত ঢাক-কাসর এতো আমাদের ঐতিহ্যের মহার্ঘ্য সঞ্চয়। প্রাণবন্ধনের অপরাজিতা, আঁচলে চোখ মুছে মায়ের মুখে বিসর্জনের মিষ্টি, বিজয়ার আলিঙ্গন এমন অমিয় আবেগনির্ঝর আর কোথায়?
মানুষের মণীষার উন্মেষকাল থেকেই পূজা আমাদের সংস্কার সংশ্লিষ্ট হয়ে হাঁটছে। ভিন্ন থেকে ভিন্ন তার রূপ, বিচিত্র তার প্রকাশ। কালের বিবর্তনে দুর্গাপূজাই হোক আর শারদোৎসবই হোকÑ এমন মিলনমেলা আর এমন প্রাণোচ্ছ্বাসের প্রকাশ আর কোন পূজাতেই পাওয়া যায় না। শুধু বাংলাদেশ আর পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরাই নয়, ত্রিপুরা, মেঘালয়, আসাম, ঝাড়খণ্ড, দিল্লি, উড়িষ্যা প্রভৃতি অঞ্চলেও দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। নেপালেও হয়। বাঙালিরা যেখানেই থাকুক শত প্রতিকূলতা, বৈরী পরিবেশেও পূজার আনন্দ আহ্বান উপেক্ষা করতে পারেনা। ব্রিটিশ ভারতে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু বার্মার মান্দালয় জেলে আটক থাকাকালীন কর্তৃপক্ষের সাথে সংগ্রাম করে জেলের ভিতর মহাধূমধামে দুর্গাপূজার আয়োজন করেছিলেন। রাজবন্দীদের সাথে সাধারণ কয়েদীরাও সেদিন জেলের ভিতর প্রথম পূজার আনন্দ উপভোগ করেছিল। দেবীদুর্গা ও দেশ জননীকে একাকার করে বঙ্কিমচন্দ্র যে ভাবনার সূত্রপাত করেছিলেন- অরবিন্দ, বিবেকানন্দ, সুভাষ বসুর চিন্তা ও কর্মে প্রতিফলিত ও বেগবান হয়ে তা ক্রমে বাংলায় ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত বিপ্লবীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এ দেশের বাস্তুচ্যুত দুর্দশাগ্রস্ত শরণার্থীরা অসুর রূপী বর্বর পাকসেনাদের কবল থেকে দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য শিবিরে শিবিরে দুর্গাপূজার আয়োজন করেছিলেন। পৌরাণিক দেবীর শাস্ত্রীয় আরাধনা ছাপিয়ে পারিপাশির্^ক আয়োজনে নির্দ্বিধায় উঠে আসে সমকালীন বাস্তবতা। একাত্তরে কলকাতার পূজা ঘিরে জেগে উঠে যুদ্ধরত বাংলাদেশ। শরণার্থী ভারাক্রান্ত, মহামারির আশঙ্কায় শঙ্কিত, অর্থনৈতিক মন্দায় জর্জরিত, বিপ্লবের দহনে দগ্ধ, ক্লিষ্ট বিবর্ণ কলকাতা শারদ ছোঁয়ায় কেমন প্রাণবন্ত কল্লোলিনী হয়ে উঠে। বিশাল মণ্ডপ। চোখ ধাঁধানো আলোকসজ্জা। মণ্ডপের বাইরেও অনেক জায়গাজুড়ে বিভিন্ন আয়োজন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রসঙ্গ বাংলাদেশ এবং মুক্তিযুদ্ধ। কোথাও মৃৎশিল্পে, চিত্রশিল্পে বিভিন্ন উপকরণের শিল্পশৈলীতে দৃশ্যমান শরণার্থী স্রোত, গণহত্যা, মুক্তিবাহিনীর বীরত্ব, পরাজিত পাকসেনা, নারী নির্যাতন। রাজাকার-আলবদরও বাদ যায় না। কোথাও পটুয়া কামরুল হাসানের চিত্রনে দানবরূপী ইয়াহিয়া খানের মুখাকৃতি নিয়ে মহিষাসুর দেবীর পদতলে স্থান পেয়েছে।
বর্তমানে ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ায় যেখানেই বাঙালির বসবাস সেখানেই সাড়ম্বরে দুর্গোৎসব পালিত হচ্ছে। দেবীর মর্ত্যে আগমনের জন্যÑ নৌকা, দোলা, গজ, ঘোটক পঞ্জিকার পাতায় যাই নির্দিষ্ট থাক না কেন, কুমারটুলী থেকে বের হয়ে বিমানে চড়েই দেবী পৌঁছে যান লন্ডন, ম্যানচেস্টার, মন্ট্রিল, টরেন্টো, নিউইয়র্ক, সিডনি শহরে। সঙ্গে ঢাকি, পুরোহিত, নানা দুষ্প্রাপ্য উপাচার। এখন অবশ্য অনেক পুরোহিত ঠাকুরেরই স্থায়ী ঠিকানা হয়ে গেছে সে দেশে। শারদাকাশে সাদা মেঘের ভেলা না ভাসলেও, দিগন্ত ছোঁয়া কাশফুলের দোলা না থাকলেও, তিথি ক্ষণ ঠিক মত প্রতিপালিত না হলেও দুর্গোৎসবকে কেন্দ্র করে বাঙালির মিলনমেলায় প্রবাসের প্রতিটি পূজাম-প হয়ে উঠে একখ- মুখরিত বাংলাদেশ। চুটিয়ে পূজার আনন্দ উপভোগ। এমন আনন্দধারায় অবগাহন, নৃত্যগীত, বসন-ভূষণ, ভোজনে প্রাচুর্য্য থাকলেও অজান্তেই কখন মনের গহনে মোচড় দিয়ে উঠে দেশের টান, বাড়ির টান, নাড়ীর টান। শারদীয়া এ টান পিছু ছাড়েনা বাঙালির। মা, বাবা, ভাইবোন, পড়শী, স্বজন, সহপাঠী, খেলার সাথী সান্নিধ্যের আকুলতা। নিজের গ্রাম, পাড়ার পূজা প্যান্ডেলের ভিড়ে কত চেনা মুখ, কত প্রিয়জন। সন্ধ্যায় দল বেধে শহর চষে বেড়ানো, পুজোর আড্ডা, হুল্লোর। আনমনে ভিড় করা শারদস্মৃতির ভারে হঠাৎ উদাসী প্রবাসী মন। ভরসা তখন সেলফোন, স্কাইপে, ভাইভার, ওয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক। প্রযুক্তির বদৌলতে কিছুক্ষণের জন্য হলেও স্বজন নৈকট্যের প্রিয় অনুভব। দুই প্রান্তের পূজার আনন্দ ভাগাভাগি হয় এভাবেই। আন্তর্জালে বিজয়ার শুভেচ্ছা ছড়িয়ে পড়ে নানা প্রান্তে।
এক সময় রাজা-মহারাজা, জমিদার, ধনিক, বণিক শ্রেণির দরদালানের বেষ্টনীতে সীমাবদ্ধ ছিল দুর্গাপূজার আয়োজন। সময়ের বিবর্তনে বারোয়ারী পূজার প্রচলন। পরবর্তীতে প্রায় শতাব্দী কাল ধরে প্রচলিত এখনকার এই সার্বজনীন পূজাই এনে দিয়েছে উৎসব আমেজের সর্বজনীন ব্যাপ্তি। জাতপাত, ধনী নির্ধনের গণ্ডি অতিক্রম করে সমাজের সকল স্তরে ছড়িয়ে পড়ার মাঝেই শারদোৎসবের প্রাণময় গৌরব।
সময়ের সাথে তাল রেখে নতুন আঙ্গিক, নতুন উপকরণ, নতুন নতুন ভাবনার চারু-কারু, চিত্রশিল্প, মৃৎ ও ভাস্কর্যের বহুমাত্রিক উপস্থাপনায় প্রতিটি পূজা অঙ্গন হয়ে উঠে শিল্পের এক সৃজনভূমি। বিচিত্র ভাবনায় অপরূপ স্থাপত্যশৈলীর দৃষ্টিনন্দন বিশালাকার মণ্ডপ, আয়োজন আনুষ্ঠানিকতার অনেকাংশই দখল করে নিয়েছে। সাম্প্রতিক থিম পূজার প্রচলন যোগ করেছে অন্য এক বিশিষ্ট মাত্রা। প্রতিমার গঠনশৈলীও পরিবর্তিত হয়ে এসেছে বৈচিত্র্য। প্রাচীন পারিবারিক পূজা ব্যতীত সর্বজনীন কোন পূজায় এখন আর সাবেকি একচালার কাঠামো গড়া হয় না। বাঙালি ক্ষয়িষ্ণু পরিবারের ভগ্ন মানসিকতার প্রতিফলনেই কি দেবী দুর্গার যূথবদ্ধ কাঠামোকে ভেঙে পৃথক করা হয়েছে এমন প্রশ্ন অনেক সময় উচ্চারিত হলেও উচ্চকিত না হওয়ায় বৈচিত্র্যময় সনাতন ধর্মের যুগোপযোগী আরেক বৈচিত্র্য সর্বজনীন পূজায় নিশ্চিতভাবেই প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে। আবার পারিবারিক পূজায় একচালা কাঠামো প্রচলিত থাকলেও, যৌথ পারিবারিক বন্ধন যে সর্বক্ষেত্রে অক্ষুণ্ন রয়েছে তা বলা যাবে না। বিচ্ছিন্নতাবোধের প্রাবল্য ও আত্মকেন্দ্রিকতায় সে ঐতিহ্যময় ঐক্যসূত্রের বন্ধন ক্রমে শিথিল হয়ে পড়ছে। ধর্মবোধের সাথে হৃদ্বোধ, ভক্তির সাথে বাৎসল্যের সংযুক্তি না ঘটলে পরিবার সমন্বিতা দেবীর মাহাত্ম্য অনুধাবন করা যায় না। ধর্মভাবে দেবী, স্বর্গের দেবতা হয়েই থাকেন আর হৃদয়বোধে হয়ে যান ঘরের কন্যা বা স্নেহময়ী জননী, মিলনগ্রন্থী, আনন্দের উৎস।
যতই বৈচিত্র্য আসুক, যতই ভিন্নতা থাকুক, দেবী দুর্গার শাশ্বত মাতৃরূপ সৃষ্টির আদি থেকে উৎসারিত যা মহাকালের সীমা অতিক্রম করে চিরায়ত সত্যে প্রতিষ্ঠিত। যতই জাঁকজমক, আড়ম্বর, ঐশ্বর্যের প্রকাশ থাক্ না কেন শারদপ্রাতের স্নিগ্ধ সোনারোদ আমাদেরকে ফিরিয়ে আনে মায়ের কোলে। শরৎ প্রকৃতির এই মায়াবী আহ্বান করে ঘরমুখো। বৎসরের এই সময়ে পিতৃগৃহে কন্যা, ভাতৃগৃহে ভগিনীর আগমনে স্বল্পসময়ের জন্য হলেও এক অনাবিল আনন্দের ঢেউ জাগে। শারদোৎসবের ছোঁয়ায় যে শুদ্ধ আবেগের বাণ- তা কোনো কৃত্রিমতার বাঁধ মানে না। এ উৎসবেই আমাদের শেকড় গ্রথিত থাক। কৃত্রিমতা আর আড়ম্বরের স্রোতে ভেসে যেতে যেতে যেন ঠিকানাবিহীন না হয়ে পড়ি। এই উৎসবের মাধ্যমেই যেন আমরা আমাদের ঐতিহ্য, অহংকার আর গর্বের বিষয়গুলোকে আত্মস্থ করতে পারি।