গতকালের দৈনিক সুনামকণ্ঠের একটি উদ্ধৃত সংবাদশিরোনাম ছিল, ‘হাওরবাসীর হতাশার বাজেট!’ পাঠ করে মনটা কেমন করে উঠে, বেবলা দিনের মতো জীবনের সকল প্রত্যাশা ফিকে হয়ে যায়। হাওরবান্ধব সরকারের বাজেটে যদি হাওরউন্নয়ন উপেক্ষিত হয় তবে তো হতাশ না হয়ে কোনও উপায় থাকে না। জলের-তলের-মাটির দেশ বলে বিখ্যাত হাওরাঞ্চল সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই সরকারি উন্নয়ন পরিকল্পনায় বাদপড়া এলাকার তালিকার অন্তর্ভুক্ত ছিল। বিশেষ করে যোগাযোগ অবকাঠামো গড়ে তোলার বিষয়টি এমনভাবে বিবেচিত হয়েছিল যে, ধরে নেওয়া হয়েছিল কোনওকালেই এই জলমগ্ন এলাকার মাটি ডাঙা হয়ে জলের উপরে বুক ভাসাতে পারবে না, চিরকাল এখানকার মাটি জলের তলেই বুক চিতিয়ে শোয়ে থাকবে অর্থাৎ কখনওই সড়ক অবকাঠামো গড়ে তোলার উপযুক্ত হয়ে উঠবে না। ব্রিটিশ আমলের আমলাতন্ত্রিক উত্তরসূরিরা দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নের সময় তাদের দিক থেকে সঙ্গতকারণেই হাওরাঞ্চলকে বঞ্চিত রাখতেন। এই কারণে ব্রিটিশ আমল থেকে দেশের সমন্বিত খাদ্যভা-ার (অনাদিকাল থেকে প্রখ্যাত ধান, মাছ, পাখি, সবজির প্রাকৃতিক ভা-ার) উন্নয়ন পরিকল্পনায় অকারণ উপেক্ষার শিকার হয়ে আসতে আসতে এখনও পর্যন্ত অনুন্নতই রয়ে গেছে, যেমন হাওরাঞ্চলে এখনও পর্যন্ত শস্যক্ষেত্র থেকে ফসল পরিবহনের সড়ক তৈরি করা হয়নি কোথাও, অথচ বাংলাদেশের বর্তমান আর্থনীতিক সচ্ছলতার নিরিখে ফসল পরিবহনের সড়ক তৈরি করা এখনকার সময়ে অসম্ভব কোনও কাজ হতে পারে বলে মনে হয় না। এর চেয়ে বড় বড় কাজ ইতোমধ্যে শেখ হাসিনা করে দেখিয়ে দিয়েছেন।
সাধারণ বিবেচনায় উত্থাপিত বাজেটে হাওরাঞ্চল একেবারে উপেক্ষিত হয়েছে বলা যায় না, এটা যে-কেউই বলে দিতে পারেন এবং একটু গভীরভাবে বিবেচনা করে এও বলে দিতে পারেন যে, হাওরের বিশেষ প্রাকৃতিক-সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলে, হাওরাঞ্চলের জন্য বাজেটে প্রদত্ত সুবিধা হাওরের টেকসই উন্নয়নে তেমন সহায়ক ভূমিকা পালন করবে না। কিন্তু আমরা বিষয়টিকে বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে সব সময় বিবেচনা করে অভ্যস্ত। কারণ আমাদের অঞ্চলটি দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো নয়, এর বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে, এবং এই বৈশিষ্ট্যটি হলো এই এলাকাটি হাওরাঞ্চল; এখানে জল, জলজসম্পদ ও এইসব নিয়ে বিশেষ প্রাকৃতিক পরিবেশে আলাদা জীবনসংস্কৃতি এখানে গড়ে উঠেছে। তাই আমাদের মনে হয়, হাওরাঞ্চলের বিশেষ বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় বাজেটে উত্থাপিত আর্থনীতিক প্রকল্পসমূহ যথেষ্ট তো নয়ই বরং এক অর্থে এইসব প্রকল্প হাওরাঞ্চলের উন্নয়নের পক্ষে কাক্সিক্ষত ভূমিকা রাখতে পারবে বলে মনে হয় না। আমরা মনে করি, এদিক থেকে বিবেচনায় দেশের ভাটি এলাকার প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যানুসারে হাওরাঞ্চলের উপযুক্ত উন্নয়ন পরিকল্পনা করার সময় সমুপস্থিত হয়েছে। এ জন্য হাওরাঞ্চলকে সমন্বিত মহাপরিকল্পনা কার্যকর করা জরুরি। যে-পরিকল্পনায় থাকবে ধান, মাছ, বৃক্ষ, ফল, সবজি, পাথর, কয়লা, গ্যাস ইত্যাদি এবং সেই সঙ্গে থাকবে পর্যটনস্থান হিসেবে সমগ্র হাওরাঞ্চলকে ঘিরে এক সমন্বিত পরিকল্পনা।