৮ই ডিসেম্বর সমাগত প্রায়। ৮ বছর আগের এ দিনটি আমাদের, বিশেষ করে আমার ভরসা, প্রেরণা ও শেষ আশ্রয়স্থলে অভরাট শূন্যতা সৃষ্টি হওয়ার এক করুণতম দিন। এ দিনটির কথা লিখতে গেলে আমার অসহায়ত্বের বর্তমানটা আরো বেশি পীড়াদায়ক হয়ে উঠে। কেবলই মনে হয়, কেউ নেই-কিছু নেই, আজ আমি বড় একা। চারদিক বিস্তৃত এ একাকীত্ব আমার ভাষাজ্ঞান কেড়ে নেয়, ইচ্ছাকে পিছু টানে। প্রতি বছরই ভাবি, মনের অভিব্যক্তিটা ব্যক্ত করব। কিন্তু স্থান-কাল-পাত্র সবার জন্য সবক্ষেত্রে একরকম নয়। তাই হয়ে ওঠেনা।
সত্তরের দশকের শেষদিকে বরুণদাকে আমি প্রথম দেখি সম্ভবত সিপিবি’র কংগ্রেস উপলক্ষে আয়োজিত জেলা কমিটির এক বর্ধিত সভায়। নজির ভাই আমাদের সাথে দাদাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন, আমি তখন পার্টির গ্রুপ সদস্য। স্কুল জীবনে কোন কোন দেয়ালে লেখা দেখেছি, মাঝে-মধ্যে স্লোগানও দিয়েছি, “বরুণ রায়ের হুলিয়া নিতে হবে তুলিয়া, বরুণদা এগিয়ে চল আমরা আছি তোমার পাশে” ইত্যাদি। সেই বরুণদাকে সামনেÑ এত কাছ থেকে দেখে নিজেকে ধন্য মনে করেছি। গর্বিত হয়েছি বরুণদার অনুসারী হতে পারায়।
বরুণদার সংগ্রামী জীবনের অনেক কাহিনী তখন অনেকের মুখে শুনেছি। লোমে-রক্তে শিহরণ জাগানো এসব কাহিনী সময় ভেদে বিস্ময় ও ভয় সঞ্চারিয়া হলেও অনুপ্রেরণা ও আত্মবিশ্বাস নির্মাণে তা ছিল অনন্য উপাদান।
শ্রুতপূর্ব এসব কাহিনীর সত্যতা প্রমাণিত হয় দাদার সাথে একই আদর্শে সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে আনুষ্ঠানিক পথচলা শুরুর পর। ‘ডি ক্লাস’ প্রশ্নে আমার মনে দ্বন্দ্ব ছিল বেশ কিছুটা সময়জুড়ে। তাত্ত্বিক শিক্ষার প্রথম হাতেকড়ি নজির ভাইয়ের কাছে। একসময় পার্টির আনুকূল্যে সোভিয়েত রাশিয়ায়ও গিয়েছি। ওখানেও নেতাদের সামাজিক, প্রশাসনিক ও আদর্শিক অবস্থান থেকে ডি ক্লাস সম্পর্কিত দ্বন্দ্বের নিরসন সম্ভব হয়নি। নজির ভাই-এর তাত্ত্বিক পড়াশোনা, রাজনৈতিক জ্ঞানের ব্যাপ্তি ও গভীরতা, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে একটা গণতান্ত্রিক এবং ‘মানুষ’-এর রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনে চিন্তা-চেতনা আজো একেবারে উবে যায়নি বলেই আমি এখনও মনে করি। নজির ভাই-এর পথচ্যুতি বরুণদার জন্য যথেষ্ট পীড়াদায়ক ছিল। কারণ, ‘৯১-এর জাতীয় নির্বাচনে পার্টি ও জোট থেকে উক্ত আসনে বরুণদাকেই প্রার্থী হিসাবে সর্বাত্মক সমর্থন দেয়া হয়। তিনি বার বার তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। এ প্রসঙ্গে তার ব্যাখ্যা ছিল, তিনি বয়সের ভারাক্রান্ত, দায়িত্ব পালনে অসমর্থ। সুতরাং সমাজ ও জাতি গঠনে তরুণ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হোক। একথা বলতে দ্বিধা নেই যে, কমরেড নজির হোসেনকে তিনি তার যোগ্য উত্তরসূরীই মনে করতেন। এখানে পূর্বাপর হিসাব-নিকাশের কোন অবকাশ ছিলনা, ক্ষমতা ও পদ ধরে না রাখার ইচ্ছা, বিশ্বাস ও আবেগের প্রাধান্যই সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাবক ছিল। বরুণদা যে শ্রেণির জাতক, তার কাছ থেকে এহেন আত্মত্যাগের ইচ্ছা, বিশ্বাস-আবেগ কোনটাই কাম্য নয়। এখানেই ‘ডি’ ক্লাসের উদাহরণ মেলে। বরুণদার কাছে শুনেছি, ডি ক্লাস মানে শিক্ষককে মাঠে নেমে হালচাষ করা নয়, কৃষকের জেলে হয়ে যাওয়া নয়। নিজেকে কোন বিশেষ শ্রেণির না ভেবে শ্রেণিবৈষম্য ভেঙে সকলকেই রাষ্ট্র ও জনগণের সেবক ভাবা এবং কাজের ক্ষেত্রে ছোট-বড় না দেখে সবকাজকেই সমমর্যাদা দানের দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা।
একদিন সকাল প্রায় ১১টা, বাজার থেকে ফিরছি, সদর থানার বিপরীতে দাঁড়ানো বরুণদা, সাথে দুটো ব্যাগ। রিকসা পাচ্ছেননা। কেউ যেতে চাচ্ছেনা। এমনি সময় ৪০/৪৫ বছর বয়সী এক চালক, ডাকতেই- না। কাছে গেলাম, জিজ্ঞেস করলাম, বরুণ বাবুর নাম শুনেছ? বলল-হাঁ, তাকে দেখেছ? না। উনিই বরুণ বাবু। বলতেই বিনীতভাবে রিকসা ঘুরিয়ে বললÑ আদাব মাফ কইরা দিয়েন, চিনতে পারিনাই।
বরুণদা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘চিনবার কথা তো না’।
সন্ধ্যায় দাদার বাসায় গেলে বললেন, “আমার নামটাকে রিকসাড্রাইভার সম্মান করেছে, আমি তাকে সালাম করেছি। কি এমন করেছি আমরা যে, আমাদের মনে রাখবে? বরং এরা আমাদের জন্য অনেক ত্যাগ করেছে।”
দাদারা যখন হুলিয়া মাথায় নিয়ে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে লুকিয়ে বেড়াতেন এদের মতোই আরো অনেকে পুলিশের হয়রানি সহ্য করেও তাদের আগলে রেখেছে। আশির দশকে ‘ভাসান পানি ’ আন্দোলনের সময় মৎস্যজীবী নেতা মালু মিয়া, বাড়ি লালপুর, তার মেয়ের বিয়ে। মালুভাই বরুণদাকে নিমন্ত্রণ করার সাহস পাচ্ছেনা। এতবড় নেতা, কি করে গরিবের ঘরে যেতে বলবে? আমি তাকে আশ্বস্ত করলাম, তুমি যাও- দেখবে দাদা খুব খুশি হবেন। তবু সে আমাকে না নিয়ে যাবেনা। অগত্যা তার সাথে গেলাম। কিন্তু সামনে গিয়ে মালু ভাই’র কণ্ঠ রুদ্ধ, ঠোঁট ও জিহবা আড়ষ্ঠ, দু’হাতের আঙুলগুলো পরস্পরকে ম্যাসেজ করছে। তার এ অবস্থা দেখে আমি বললাম, দাদা মালু ভাই’র মেয়ের বিয়ে। আপনাকে নিমন্ত্রণ করতে এসেছে। দাদা বললেন “এইটাতো ভাল খবর, কই মালুতো কিচ্ছু কয়না।”
মালুর ঢোক গেলা দেখে পিছন ফিরে একটু হেসে নিলাম। মালুর নিমন্ত্রণপর্ব শেষে দাদা স্বভাবসুলভ রসিকতায় বললেন, ব্রাহ্মণ ঠাকুর যাইবানি? আমরাতো শূদ্র। তাইন গেলেতো আমরার সাহস হয়। নির্ধারিত দিনে মালু’র অবিশ্বাস ও ভয়ে ছাই ফেলে বরুণদাসহ আমরা বিয়ে বাড়িতে হাজির। মালু ভাই’র উঠোন জনাকীর্ণ, বরুণদা যাবেন সবাই শুনেছে, কিন্তু মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতে পারেনি। কারণ আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এতবড় নেতার এতছোট ঘরে পদধুলি দেয়ার উদাহরণ প্রায় বিরল। ‘ডি’ ক্লাস’র এটা একটা উদাহরণ।
৯০’র দশকের শেষ প্রান্তে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বরুণদার রাজনৈতিক চিন্তায়ও পরিবর্তন দেখা দেয়। চিন্তার এ পরিবর্তনের ফলশ্রুতিই কমিউনিস্ট পার্টির ভাঙন। এক পক্ষের নেতারা নিজেদের সাচ্চা কমিউনিস্ট ও অপরপক্ষকে বিলোপবাদী হিসাবে আখ্যায়িত করতে থাকেন। কিন্তু সত্তর বছরের সুপ্রতিষ্ঠিত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা এক ফুৎকারে তাসের ঘরের মতো কেন ধূলিসাৎ হল, তার বিচার-বিশ্লেষণ, নিজদেশে পার্টির রণনীতি-রণকৌশলে ত্রুটি ছিল কি-না এসব খতিয়ে দেখার গুরুত্ব সিপিবি’র কাছে কতটুক আছে, তা জানিনা।
বরুণদা প্রায়ই বলতেন, বুর্জোয়াদের দ্বারা সৃষ্ট গণতন্ত্র বুর্জোয়ারা বেশিদিন চালাতে পারবেনা। তারা একদিন গণতন্ত্রের পতাকা ফেলে দিয়ে নিজেদের মধ্যে অর্থনৈতিক যুদ্ধ শুরু করবে। কমিউনিস্টদের উচিত তখন গণতন্ত্রের পতাকাটি তুলে ধরা এবং তাকে সমুন্নত রাখা। একসময় কেউ-কেউ বলতে লাগলেন বরুণদা মন্দিরে যাতায়াত শুরু করেছেন। এ নিয়ে দাদার সাথে মাঝে-মধ্যে কথা হত। দাদা বলতেন ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাইÑ’ এর উপর বিশ্বাস রেখে তুমি মন্দির-মসজিদ, গির্জা-প্যাগোডা যেখানেই যাও, মানুষ ভিন্ন অন্য কোন প্রাণি বা পদার্থ পাবেনা।
যারা আমাকে ওখানে নিচ্ছেন, তারা দীক্ষা নেয়ার প্রস্তাব দিচ্ছেন না। আমি গেলে তারা খুশি হন, মানুষের খুশিতে বাগরা দেব কেন? ‘নাস্তিকতাবাদ’ সম্পর্কে দাদার বক্তব্য ছিল, অস্তিত্বে বিশ্বাস না করাই নাস্তিকতা। ধর্মযাজক ও ব্যবসায়ীরা অস্তিত্বকে কেবল ঈশ্বরেই সীমাবদ্ধ করে রেখেছে। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা ও নিত্যনতুন আবিষ্কারের গুরুত্ব তাদের কাছে তেমন একটা নেই। বিজ্ঞান ছাড়া তাদের একমুহূর্ত চলেনা। তবু একে সম্মান দিতে তারা নারাজ। এরা অকৃতজ্ঞ। এদিক বিবেচনায় বাস্তববাদীরা সবচেয়ে বড় আস্তিক।
দাদার জীবনের শেষ কয়েকবছর প্রায় প্রতিদিনই দাদার সাথে বসেছি। দু-একদিন এর ব্যতিক্রম হলে ধরে নিতেন আমি সুনামগঞ্জে নেই। এর বেশি হলে দাদাকে অবগত করে যেতাম। পত্রিকা পড়তে শেষদিকে অসুবিধা হত, গুরুত্বপুর্ণ খবরগুলো শুনাতাম।
’৮৯-এ বাবা মারা যান। মারা যাওয়ার আগে বোনের বিয়ে এবং বাবার চিকিৎসায় প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়, আমি চরম অর্থ সংকটে। বন্ধু-বান্ধব শুভানুধ্যায়ীদের কাছে হাত পাতার সুযোগ ফুরিয়েছে বেশ আগেই। এমতাবস্থায় বাসার কিছু অংশ বিক্রি করে দেয়ার চিন্তা করছি। দাদার সাথে বিষয়টা শেয়ার করার পর বাবার চিকিৎসক শ্রদ্ধেয় ডা. প্রদ্যুৎ ভট্টাচার্য’র সাথে কথা বলে আমাকে জানালেন বাবার এখন যে পর্যায় তাতে উন্নতির তেমন কোন সম্ভাবনা নেই। বাসা বিক্রি করে সকলকে নিয়ে পথে বসার কোন প্রয়োজন নেই। আশ্বাস দিলেন যা করার সকলে মিলেই করব। কদিন পরেই বাবা মারা যান। দাদা কখনও সময় ও কথার বরখেলাপ করেননি। আমাকে পথে বসতে দেননি।
দাদা, আজ তুমি নেই। দিনের একটা সময় কাটে তোমারই এক ঘনিষ্ঠ স্বজন ‘রাখাল স্যারের’ সাথে। সমাজ, ধর্ম, রাজনীতি, অর্থনীতি সব নিয়েই স্যারের সাথে খোলামেলা আলাপচারিতায় লিপ্ত হই। নির্দ্বিধায় আমার আনন্দ-বেদনা, অভাব-অভিযোগ তার সাথে শেয়ার করি। আমার জন্য তার সহানুভূতির দুয়ার সবসময় খোলা থাকে। দু-একদিন দেখা না হলে তিনিও ভাবেন আমি সুনামগঞ্জে নেই। জানিনা, আর কতদিন এ অম্ল-মধুর ক্ষণগুলো আমাদের মাঝে থাকবে। তোমার শূন্যতা আমাদের মাঝে চিরদিনই অভরাট থাকবে-একথা নিশ্চিত করে বলতে পারি। তোমাকে লাল সালাম।