1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
শনিবার, ০৩ জুন ২০২৩, ০৩:২০ পূর্বাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নিয়ে স্বপ্ন বুনছে হাওরচাষী

  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০১৭

শামস শামীম ::
চোখের সামনে হাওরের জলমগ্ন বিস্তৃত জমি। একটু একটু করে ভাসছে। রেখার মতো ছড়ানো এবড়ো-থেবড়ো আইল জলের ভেতর থেকে যেন উঁকি দিচ্ছে। যেন ডুবে যাওয়া স্বপ্ন ভাসছে একটু একটু করে। এর আশপাশেই জমি তৈরি করছেন গেল বারের ফসলহারা স্বপ্নভাঙ্গা কৃষক। ফসল হারিয়ে নিঃস্ব কৃষক পিতৃপ্রদত্ত ঐতিহ্যবাহী কৃষিকাজের মাধ্যমে আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। ভোর থেকেই জমি তৈরি করতে হাওরে ছুটছেন তারা। কেউ গরুতে হাল দিচ্ছে, কেউবা ট্রাক্টরে। হাওরের বর্তমান চিত্র এরকমই। তবে এখনো বিলম্বে পানি নামার সংকটে আছেন তারা।
জেলার অন্যতম বড় হাওর ‘দেখার হাওর’। চারটি উপজেলায় নিয়ে বিস্তৃত এই হাওরে কৃষি বিভাগের মতে প্রায় ৯ হাজার হেক্টর জমিতে আবাদ হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের মতে, এই হাওরে প্রায় ২৪ হাজার হেক্টর বোরো জমি রয়েছে। এই হাওরের খ- অংশ ঝাউয়ার হাওর। গত রোববার সকাল সাড়ে ৮টায় এই হাওরের গণিপুর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, হাওরের জাঙ্গাল শ্রেণির উঁচু জমিতে বীজতলা তৈরি করছেন কৃষক। নিচের মূল হাওরের জমিগুলো একটু একটু করে ভাসছে। স্পষ্ট দেখাচ্ছে ক্ষেতের আলগুলো। সেখানে কেউ মাছ ধরছিল। কেউ বা জমির বন পরিষ্কার করছিল।
গণিপুর গ্রামের কৃষক আফাজ উদ্দিন ঝাউয়ার হাওরে কাজ করছিলেন সকাল থেকেই। গত বছর তার প্রায় ৩৬০ হেক্টর জমির সম্পূর্ণ ফসল তলিয়ে গেছে। প্রায় ৬০ হাজার টাকা খরচ করে সেই জমিতে চাষ দিয়েছিলেন এই ক্ষুদ্র চাষী। ফসলহারা এই কৃষক এবার ঋণগ্রস্ত থাকায় অর্ধেক জমি চাষ করবেন। বাকিগুলো বর্গা দিবেন, না হয় পতিত ফেলে রাখবেন। আফাজ উদ্দিনকে দেখা গেল জমিতে পানি দিয়ে বীজতলা তৈরি করতে।
আফাজ উদ্দিন বলেন, ‘ইবার ছয় কিয়ার জমিন খরমু। ঋণফিন আছি। বেশি জমিন খরতামনা। পরতি বছরই খতি অর। তারবাদেও কিতা খরমু গিরস্তি না খইরা। ইবারও আশা ভরসা লইয়া লামছি। কিন্তু পানি অস্তে অস্তে নামের।’
তার পাশেই বীজতলায় বীজ ফেলছিলেন একই গ্রামের কৃষক তালেব মিয়া। এই হাওরে তার প্রায় এক হাজার একর জমি রয়েছে। গত বছর নিজেদের মজুরি বাদ দিয়েই প্রায় এক লাখ টাকা খরচ হয়েছে। সম্পূর্ণ ফসল ডুবে যাওয়ায় মূলধন তো দূরের কথা পরিবারের খাবারও সংগ্রহ করতে পারেননি। এখন ওএমএসের দোকান থেকে স্বল্পমূল্যে চাল কিনে পরিবারে যোগান দেন।
তালেব মিয়া বলেন, ‘গতবার বড় আশা লইয়া সব জমিন খরছিলাম। সেই আশা কাইড়া নিছেগা পানি। ইবারও অনেক আশা লইয়া ঋণফিন কইরা খেতে লামছি। জানিনা আল্লায় ইবার কপালে কিতা রাখছে’।
ঝাউয়ার হাওরের কৃষক মাহতাব আলী জমিতে প্রায় ৫ জন শ্রমিক নিয়ে কাজে নেমেছেন। শ্রমিকদের কেউ বীজতলায় হালচাষ করছে, কেউ ক্ষেত তৈরি করছে, পানি দিচ্ছে। প্রতিদিন শ্রমিকের পিছনে তার ২ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। সচ্ছল এই কৃষক কোনমতে হালচাষের খরচ সংগ্রহ করে এবারও আশা নিয়ে ক্ষেতে নেমেছেন সম্পূর্ণ জমিতে চাষ দিতে। তিনি শঙ্কিত হলেও আশা করছেন এবার যাতে ফসল দুর্যোগের মুখে না পড়ে। প্রাকৃতিক এই দুর্যোগ নিয়েই হাওরের কৃষক দীর্ঘ সংগ্রামের পথ পাড়ি দিচ্ছে এমনটাই বললেন এই কৃষক।
মাহতাব আলী বলেন, ‘গতবার ষোল্লআনা জমিন পাইন্যে নিছে। জমিনে ধান রইতেই ২ লাখ টাকা খরচ অইছিল। ইবারও কামলা-ছামলা লইয়া খেতো নামছি। জানিনা ভাগ্যে ইবার কিতা আছে। এই খাজ ছাড়া আর কুন্তা হিকছিনা। ইতার লায় বারবার ক্ষতি অইলেও বাফদাদার হিকানো খাজই খরি।’
তার পাশে শ্রমিকদের জন্য ভাত নিয়ে এসেছেন কৃষক ছয়ফুদ্দিন। শ্রমিকরা বীজতলায় কাজ করছে। কেউ জমি তৈরি করছে। ছয়ফুদ্দিন বলেন, ‘আত খালি। পানি যেলাখান আস্তে আস্তে নামের খইতাম পারতামনা সব জমিন খরতাম পারমু কি না। আর খরলেও ফসল উগারও তোলতাম পারমু কি না তাও জানিনা। আল্লার উফর বিশ্বাস কইরা খেতো নামছি’।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর জেলায় এই বছর ২ লাখ ২২ হাজার ৫৫২ হেক্টর জমিতে বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছে। গতবার ছিল ২ লাখ ২৩ হাজার ৮২ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ। বোরো চাষের সঙ্গে জেলায় প্রায় সাড়ে তিন লাখ কৃষক পরিবার রয়েছে। এবার সরকারিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ১ লাখ ৮২ হাজার কৃষককে গত এপ্রিল থেকে প্রতি মাসে ৫ শ টাকা ও ৩০ কেজি করে চাল সহায়তা দিচ্ছে। এখন তিন লাখ কৃষককে সার, বীজ ও নগদ এক হাজার টাকা সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।
এদিকে গতবার ফসল হারানোর পর এবার ধীরে ধীরে পানি নামায় হাওরে নতুন সংকটে চিন্তিত কৃষক। হাওরের পানি নিষ্কাশনের জন্য সরকার তাৎক্ষণিক ৩০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়ার পর সেগুলোও বণ্টন করা হয়েছে।
সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. জাহেদুল হক বলেন, গতবারের চেয়ে এবার লক্ষ্যমাত্রা কিছুটা কম। পানি বিলম্বে নামার কারণে বীজতলা তৈরি করতে সমস্যা হয়েছে। যার ফলে কিছুটা বিলম্বে জমি চাষ হলেও ফলনে তেমন প্রভাব পড়বেনা। কৃষি বিভাগ প্রায় ৩লাখ কৃষককে সরকারি সহায়তা দিচ্ছে বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, পানি ধীরে ধীরে নামতে শুরু করায় কৃষকরাও জমি তৈরি করছেন।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com