স্টাফ রিপোর্টার ::
আজ ৬ ডিসেম্বর সুনামগঞ্জ মুক্ত দিবস। একাত্তরের এই দিন ভোরে সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের দল শহরে ঢুকলে মুক্তিকামী জনতা আনন্দে রাস্তায় নেমে যোদ্ধাদের অভ্যর্থনা জানান। জয় বাংলা স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে জেলা শহর। এর আগে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের মুখে পাকিস্তানি হায়েনারা সুনামগঞ্জ পিটিআই ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। যাওয়ার সময় তারা তিনজন মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে নিয়ে যায়। পিটিআই টর্চারসেলে হত্যা করে যায় অগুনতি মানুষকে। এভাবেই হাজারো মা-বোনের সম্ভ্রম, শহীদের রক্ত ও বাংলার দামাল মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগে মুক্ত হয় সুনামগঞ্জ।
মুক্তিযোদ্ধারা জানান, সুনামগঞ্জকে হানাদারমুক্ত করতে বালাট সাব সেক্টরের কমান্ডার মেজর মোত্তালিব, ক্যাপ্টেন যাদব ও ক্যাপ্টেন রঘুনাথ ভাটনগর বিশেষ পরিকল্পনা নেন। যৌথ পরিকল্পনা অনুযায়ী দখলদার বাহিনীর উপর আঘাত হানতে কয়েকটি কোম্পানিকে একাধিক গ্রুপে ভাগ করে আক্রমণের দায়িত্ব দেয়া হয়। ‘এ’ কোম্পানিকে যোগীরগাঁও, ‘বি’ কোম্পানিকে হালুয়ারঘাট, সি কোম্পানিকে হাছননগর, ডি কোম্পানিকে ভাদেরটেক লালপুর এবং এফ কোম্পানিকে বেরীগাঁও কৃষ্ণনগর অবস্থানের নির্দেশ দেওয়া হয়। কোম্পানিগুলোকে সার্বিক রসদ সরবরাহের দায়িত্ব দেওয়া হয় এডিএম কোম্পানিকে। এছাড়া বনগাঁও সদর দফতরে অতিরিক্ত এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা প্রস্তুত ছিলেন যে কোন পরিস্থিতি সামাল দিতে। সন্ধ্যার পরপরই তারা পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী শহরে ঢুকতে শুরু করেন। মুক্তিযোদ্ধারা যৌথভাবে তিনদিক দিয়ে পাকিস্তানি হানাদারদের আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধারা প্রবেশ করার আগেই দালালদের মাধ্যমে খবর পেয়ে পাক হানাদাররা শহর ছেড়ে পালাতে শুরু করে। যাওয়ার সময় পিটিআই টর্চারসেলে বন্দিদের নির্মমভাবে হত্যা করে। সঙ্গে নিয়ে যায় মুক্তিযোদ্ধা তালেব আহমদ, কৃপেন্দ্র ও নাম না জানা আরেক মুক্তি সেনাকে। জয়কলস উজানীগাঁও নদীর পাড়ে নিয়ে রাজাকার আব্দুস সাত্তার বাহিনীর পরামর্শে এই তিন মুক্তিযোদ্ধাকে নির্মমভাবে হত্যা করে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়। পরে এলাকাবাসী তিন যোদ্ধার লাশ উদ্ধার করে জয়কলস উজানীগাঁও রশিদিয়া উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমাধিস্থ করেন।
এদিকে সুনামগঞ্জ মুক্ত দিবস উপলক্ষে জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন সংগঠন নানা কর্মসূচির আয়োজন করেছে। জেলা প্রশাসনের আয়োজনে মাসব্যাপী মহান বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানমালার অংশ হিসেবে সুনামগঞ্জ মুক্ত দিবসে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ জেলা ইউনিট কমান্ড ও সদর উপজেলা কমান্ডের সহযোগিতায় বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। আজ বুধবার সকাল ১১টায় জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স থেকে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের হবে। শোভাযাত্রাটি শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তপক অর্পণ করা হবে। বেলা ১২টায় শহীদ আবুল হোসেন মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হবে আলোচনা সভা।
অপরদিকে, একাত্তরের এই দিনে ছাতক উপজেলাও শত্রুমুক্ত হয়। মুক্তিবাহিনীর তীব্র প্রতিরোধের মুখে পাক-হানাদার বাহিনী পিছু হঠে বিশ্বনাথের লামাকাজী এলাকায় চলে গেলে মুক্তিযোদ্ধারা জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে ছাতক শহরকে হানাদার মুক্ত ঘোষণা করেন। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আনোয়ার রহমান তোতা মিয়া জানান, ৫ ডিসেম্বর ছাতকের সুরমা নদীর উত্তরপার নোয়ারাই ইউনিয়নের জয়নগর এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা শক্তিশালী অবস্থান নেন। এ সময় পাক-হানাদার বাহিনীর অবস্থান ছিল ছাতক সিমেন্ট কারখানা এলাকায়। মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র প্রতিরোধের মুখে ওই রাতেই কারখানা এলাকা ছেড়ে নদীপাড়ি দিয়ে ছাতক শহরে চলে যায় হানাদার বাহিনী। সকালে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের মুখে শহর ছেড়ে ঝাওয়ার ভাঙ্গায় অবস্থান নিয়ে প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় পাকবাহিনী। পরে ঝাওয়ার ভাঙ্গা এলাকা ছেড়ে গোবিন্দগঞ্জ এলাকায় অন্যান্য পিছু হঠা হানাদার বাহিনীর সাথে যোগ দেয় তারা। ওইদিন বিকেলে মুক্তিবাহিনীর সমর্থনে ভারতীয় মিত্রবাহিনী সিমেন্ট কারখানার নদীর তীরে অবস্থান নেয়। এখানে প্রতি বছর ৬ ডিসেম্বর ছাতক মুক্ত দিবস পালন করা হয়। এ উপলক্ষে আজ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের উদ্যোগে শহরে সর্বস্তরের জনতার আনন্দ র্যালি অনুষ্ঠিত হবে। বিকেলে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কার্যালয়ে আলোচনা সভা ও সন্ধ্যায় গোবিন্দগঞ্জে এক মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।