শামস শামীম ::
১৯৭১ সনের অগ্রহায়ণ মাস। অগ্রাণের মাঠে মাঠে সোনার ধান কচি রোদ্দুরে নুয়ে নুয়ে হাসছিল। সেই অকৃত্রিম সৌন্দর্য্য দেখারও তখন কেউ ছিলনা। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের ভয়ে সেই ধানমাঠে কাকপক্ষীর উপস্থিতি কমে গিয়েছিল। ভীতিকর পরিস্থিতি ছিল চারপাশে। সুনামগঞ্জ শহর শত্রুমুক্ত করে যখন মুক্তিযোদ্ধারা পূর্ণ বিজয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন সেই দিনই কুখ্যাত রাজাকার আব্দুল খালেকের নির্দেশে ৬ ডিসেম্বর সকালে হত্যা, নারী নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালানো হয়। স্থানীয় স্কুলমাঠে ধর্মান্তরিত করে নদীর তীরে লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হয় নিরীহ ২৬ জনকে। আজো সেই ভয়াবহ দিনের কথা মনে করে ভয়ে আতকে ওঠেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। লাইনে দাঁড়ানো সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে থাকা দু’জন এখনো সেই স্মৃতি মনে করে নীরবে কাঁদেন।
দিরাই উপজেলার শ্যামারচর-পেরুয়া এলাকা ছিল হিন্দু অধ্যুষিত একটি এলাকা। এই এলাকায় শিক্ষিত ও প্রাগ্রসর চিন্তার মানুষ বসবাস করতেন। শিক্ষা, সংস্কৃতি, ব্যবসাসহ সামাজিক নানা ক্ষেত্রে তারা শীর্ষে ছিলেন। স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে তারা শত বছর ধরে বসবাস করছিলেন সুনামের সাথে। তবে বৃটিশ আমলের শেষদিকে এই এলাকায় ভাগ্যন্বেষণে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসতে থাকেন মুসলমান সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় তারা এই এলাকায় আতঙ্ক হয়ে দেখা দেয়। তখনই হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রভাব কমতে থাকে। ভাগ্যন্বেষণে আসা বাইরের মুসলমান সম্প্রদায়ের দাপট বাড়তে থাকে। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় তারা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এই সময়েই দলে দলে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন। একাত্তরের প্রতিরোধ যুদ্ধের সময়ই বাড়িঘর ছেড়ে তারা দেশ ছাড়তে শুরু করেন। সত্তরের নির্বাচনে দৌলতপুরের আব্দুল খালেক চেয়ারম্যান পিডিপি প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন। তার বাড়িতে প্রতিরোধ যুদ্ধের সময় প্রগতিশীল আন্দোলনের নেতা সোনাহর আলী ইস্টবেঙ্গলের মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে মারা যান।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা জানান, ১৯৭১ সনের ৬ ডিসেম্বর শ্যামারচর বাজারে পেরুয়া গ্রামের নিরীহ মানুষদের জড়ো নারকীয় গণহত্যা চালিয়েছিল রাজাকার আব্দুল খালেক বাহিনী। ওইদিন সকালে মরা সুরমার ঘোলা জল মানুষের রক্তে লাল হয়েছিল। পেরুয়া গ্রামের শতাধিক মানুষকে জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করা শেষে সুরমা নদীর তীরে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে রাজাকার ও খান সেনারা হত্যা করে ২৬ জনকে। পরে গ্রামে ঢুকে নির্বিচারে হত্যা, খুন, ধর্ষণ ও লুণ্ঠন শেষে পুরো গ্রাম আগুনে পুড়িয়ে দেয়। বয়স কম থাকায় লাইনে দাঁড়ানোর পরও মাথার উপর দিয়ে গুলি চলে যাওয়ায় সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান কিশোর শৈলেন রায় ও হীরেন্দ্র শেখর রায় সেন্টু নামের দুই ভাই। এ গণহত্যায় তাদের পরিবারের ৬ জনের মৃত্যু হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে শ্যামারচর বাজারে আমীর উদ্দিনের রাইস মিলে পাঞ্জাবীরা ক্যাম্প স্থাপন করে এলাকায় রাজাকারদের দিয়ে ধর্ষণ, লুটপাট ও হত্যাযজ্ঞ চালাতো বলে মুক্তিযোদ্ধারা জানিয়েছেন।
মুক্তিযোদ্ধারা জানান, ১৯৭১ সনের ৫ ডিসেম্বর শ্যামারচর বাজারে রাজাকারদের ক্যাম্পে আক্রমণ করতে এসে মুক্তিযোদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। পরদিন সকালে প্রতিশোধ নিতে শ্যামারচরে পেরুয়া গ্রামের হিন্দুদের ডেকে আনে রাজাকার আব্দুল খালেক। ২৬ গ্রামবাসীকে ব্রাশফায়ারে হত্যার পর গ্রাম লক্ষ্য করে নদীর দক্ষিণ পাড় থেকে গুলি ছুঁড়ে আতঙ্ক তৈরি করা হয়। পরে গ্রামে ঢুকে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও নির্বিচারে ধর্ষণ করে তারা। এই গ্রামের অনেক ধর্ষিতা নারীসহ নির্যাতিতরা এখনো জীবিত আছেন। নির্যাতনের ক্ষতচিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছেন তারা।
একাত্তরের ওই দিনের ভয়াল স্মৃতি মনে এলে এখনো ভয়ে কুকড়ে যান প্রত্যক্ষদর্শী শৈলেন ও সেন্টুসহ পুরো গ্রামবাসী। বিভীষিকার কথা মনে করে এখনো ভয় পান রাজাকারের নাম মুখে আনতে। তারা জানান, স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরও পেরুয়া গণহত্যাস্থল অরক্ষিত। কোন স্মৃতিচিহ্ন নেই। শহীদের স্বীকৃতি পাননি স্বজনরা। রাজাকাররা এই এলাকায় শক্তিশালী হওয়ায় এই গণহত্যাকে রাজনৈতিক আশ্রয়ে দীর্ঘদিন আড়াল করে রাখা হয়েছিল বলে মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযোগ। জানা গেছে, ২০১৫ সনে পেরুয়া গণহত্যায় শহীদ স্বজন রজনী কান্ত দাস দৌলতপুর গ্রামের তিন রাজাকারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে পাবলিক পিটিশন দায়ের করেন। গত মাসে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান আব্দুল হান্নান খান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। পরদিন তিনি সুনামগঞ্জ সার্কিট হাউসে বাদীদের ডেকে এনে প্রাথমিক তদন্তকাজ সম্পন্ন করেন। জানা গেছে এই মামলাটি ট্রাইব্যুনালে আমলে নেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযোগ, ৭৫-এর পর রাজাকার ও তাদের প্রভাবশালী দোসরদের কারণে এই গণহত্যার বিষয়টি চাপা পড়ে। যুদ্ধাপরাধীর সন্তানরা কৌশলে রাজনৈতিক আশ্রয় নেয়। ধনজনে তারা এলাকায় শীর্ষ অবস্থানে থাকায় এবং রাজনৈতিকভাবে নেতৃস্থানীয় থাকায় কেউ তাদের বিরুদ্ধে কখনো মুখ খুলতে সাহস পায়নি। তাই এ গণহত্যা সম্পর্কে এতদিন তেমন কিছু জানতনা নতুন প্রজন্ম। জেলার অন্যান্য গণহত্যাস্থলে স্মৃতিসৌধ নির্মিত হলেও এখানে স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরও শহীদ স্মরণে কোন স্মৃতিসৌধ হয়নি। জানা গেছে গণহত্যা স্থল দখল করে আছে রাজাকার ও তাদের স্বজনরা।
গণহত্যায় শহীদ একাধিক পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গ্রামের বিশিষ্ট পরিবারের সন্তান রামকুমার রায়, তার ছেলে চিত্তরঞ্জন রায়, ভাই ডা. রামানন্দ রায়, ভাতিজা সমর রায়, হিমাংশু শেখর রায় এবং বোনের ছেলে মিলন রায়কে গুলি করে ওইদিন লাইনে দাঁড় করিয়ে হত্যা করে পাকিস্তানী হায়েনারা। ছোট ছোট সন্তান ও স্ত্রীদের সামনেই ঘটে এই বিভীষিকাময় ঘটনা। রাম কুমার রায়ের স্ত্রী কনকপ্রভা রায় তার ছেলে চিত্তরঞ্জন রায়কে বাঁচাতে ঝাঁপ দিলে খান সেনাদের গুলিতে তার মুখের ডান অংশ উড়ে যায়। বিজয়ের কয়েক বছর পরে স্বামী ও সন্তানের শোকে বিনাচিকিৎসায় মারা যান তিনি।
নির্যাতিত লোকজন জানান, সংখ্যালঘু অধ্যুষিত পেরুয়া গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পরই নিরাপদ আশ্রয়ের খুঁজে চলে যান। এলাকার প্রভাবশালী ও অসাম্প্রদায়িক রামচন্দ্র রায়ের পরিবারসহ ১৫-২০টি পরিবার গ্রামে থেকে যায় আব্দুল খালেক রাজাকারের ভরসায়। ৬ ডিসেম্বর দৌলতপুর গ্রামের রাজাকার আব্দুল খালেক তারেদকে শ্যামারচর বাজারে ডাকায় তারা নির্ভয়ে গিয়েছিলেন। যাদের বেশিরভাগকেই বাজারের উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে কলেমা পড়িয়ে জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করা হয়েছিল। বাকিদের ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হয়েছিল।
লাইনে দাঁড় করানো হয়েছিল রামকুমার রায়ের ভাই হেমচন্দ্র রায়ের ছেলে হিমাংশু শেখর রায় ও হীরেন্দ্র শেখর রায় এবং অপর ভাই সচিন্দ্র রায়ের ছেলে সমর রায় ও শৈলেন রায়কে। শৈলেন রায় ও হীরেন্দ্র শেখর রায় সেন্টু ছোট থাকায় গুলি মাথার উপর দিয়ে চলে যায়। নদীতে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণে বেঁচে যান। এই দুই ভাই এখনো জীবিত আছেন। তাদের স্মৃতিচারণে জানা যায়, বিজয়ের মাস খানেক পরে শূন্যবাড়িতে ফিরে এসে দেখেন পুরো বাড়িই মৃতপুরী। লুটপাট আর অগ্নিসংযোগে ছিন্নভিন্ন বাড়িটি যেন শ্মশানভূমি। তখন এই পরিবারের নারী ও শিশুরা নদী তীরে এসে লাশ খোঁজাখুঁজি করে স্বজনদের কাউকে পাননি। সৎকার জুটেনি গ্রামের কোন শহীদের।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শ্যামারচর বাজারে গণহত্যা পর পেরুয়া গ্রামের আখালি দাশকে গুলি করে হত্যা করে তার চোখ তুলে নেয় রাজাকাররা। গ্রামের সুখলাল পুরকায়স্থকে গাছে ঝুলিয়ে শরীরের চামড়া ছিলে লবণ ছিটিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। স্বাধীনতার পর তার মুক্তিযোদ্ধা ছেলে ধীরেন্দ্রকে গ্রামে ফিরতে দেয়নি রাজাকাররা। মামলা-হামলা করে গ্রামছাড়া করা হয়েছিল। রাজাকারদের দেয়া মিথ্যা মামলা নিয়েই মৃত্যুবরণ করেন ওই মুক্তিযোদ্ধা।
গণহত্যায় বেঁচে যাওয়া হীরেন্দ্র শেখর রায় সেন্টু বলেন, একাত্তরের ৬ ডিসেম্বর আমি আর আমার কাকাতো ভাই শৈলেন রায় পুনর্জন্ম পেয়েছিলাম। অল্প বয়সের কারণে উচ্চতা কম থাকায় গুলি আমাদের মাথার উপর দিয়ে চলে যাওয়ায় প্রাণে বেঁচে যাই। আমাদের চোখের সামনেই আমাদের কাকা ও কাকাতো ভাইসহ পরিবারের ৬জন এবং গ্রামের মোট ২৬জনকে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করা হয়। আমাদের বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে জ্বালিয়ে ছারখার করার আগে লুটপাট করা হয়। শৈশবের সেই ভয়াল দৃশ্য এখনো আমাদের তাড়িয়ে বেড়ায়। উপেক্ষিত এই গণহত্যাস্থলে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণের দাবি জানান এই প্রত্যক্ষদর্শী।
শৈলেন রায় বলেন, আমি তখন ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। ঘটনার দিন চেয়ারম্যান সাহেবের কথা বলে আমাদেরকে শ্যামারচর বাজারে ডেকে নেওয়া হয়। আমাদের দাদার নামে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ের সামনে জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করা হয় আমাদের। পরে নদীর ঘাটে এনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ারে তাদের হত্যা করা হয়। তিনি বলেন, স্বাধীনতার ৪৭ বছর হলেও আমাদের শহীদ স্বজনদের স্বীকৃতি মিলেনি।
যুদ্ধকালীন কোম্পানি কমান্ডার সুধীর চন্দ্র দাস বলেন, শ্যামারচর বাজারে গণহত্যার আগের দিন আমি মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে শ্যামারচর বাজার লক্ষ্য করে পেরুয়া গ্রাম থেকে আক্রমণ করি। আমাদের দু’টি দল আক্রমণে যুক্ত না হওয়ায় রাজাকার ও পাঞ্জাবীরা আমাদের তিনদিক থেকে ঘিরে ফেলে। এসময় আমাদের চারজন মুুক্তিযোদ্ধা মারা যান। বাকিরা পালিয়ে প্রাণে বাঁচেন। তবে পরদিন মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতার অভিযোগে পেরুয়া গ্রামবাসীকে রাজাকাররা বাজারে ডেকে এনে লাইন ধরিয়ে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে গ্রামে লুটপাট অগ্নিসংযোগ করে। গ্রামে ঢুকেও হত্যাযজ্ঞ চালায়। আমাদের কোম্পানিগুলোর মধ্যে সমন্বয় না থাকায় ব্যর্থ অভিযানের কারণে পেরুয়া গ্রামবাসীর উপর মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তার অভিযোগে এই হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান খান (আইজিপি) বলেন, পেরুয়া গণহত্যাটি আমরা বিশেষভাবে আমলে নিয়েছি। এখানে ৭৫-এর পটপরিবর্তনের কারণে বলতে গেলে প্রতিবিপ্লব হয়ে গেছে। যুদ্ধাপরাধী ও তাদের স্বজনরা নানাক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। সম্প্রতি এ বিষয়ে আমাদের কাছে অভিযোগ দায়েরের পর আমরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। এ বিষয়ে শীঘ্রই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তিনি বলেন, বাদীদের কেউ হুমকি ধমকি দিলে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে স্থানীয় প্রশাসন ও মন্ত্রণালয়কে বলা আছে।